ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দিদার হাসান

মানবতার জননী থেকে প্রাচ্যের তারকা

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ৬ অক্টোবর ২০১৭

মানবতার জননী থেকে প্রাচ্যের তারকা

মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টার দফতর থেকে মঙ্গলবার ৩ অক্টোবর এক বিবৃতির মাধ্যমে জানানো হয়েছে, ‘১৯৯২ সালের যৌথ ঘোষণার ভিত্তিতেই রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন হবে।’ মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা আউং সান সুচির দফতরের মন্ত্রী চ টিন্ট সোয়ের সঙ্গে সোমবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলীর বৈঠকের বিষয়ে এ তথ্য জানানো হলো। ঢাকায় বসে চ টিন্ট সোয়ের বলেছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত নেয়া এবং তা কার্যকরের একটি যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের কথা। একদিন বাদেই বলা হলো ১৯৯২ সালের যৌথ ঘোষণার কথা। বিষয়টি কেমন যেন রহস্যময় মনে হয়! কারণ মিয়ানমারের সাবেক জান্তা সরকার এবং বর্তমানের নির্বাচিত ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারের (নেপথ্যে সামরিক জান্তাদেরই কর্তৃত্ব) রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে আন্তরিকতায় যে ঘাটতি আছে তা সহজেই বোধগম্য। তা না হলে এই সেদিন বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার ঘোষণা ছিল ‘পরিচয়পত্র ছাড়া কোন নাগরিকের দায়ভার তারা নেবে না।’ মৌলিক মানবাধিকার তথা নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার পর রোহিঙ্গারা যেখানে রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক সেখানে এই নিষ্ঠুর পরিহাসপূর্ণ উক্তি এবং মন্ত্রী রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টার দফতরের বক্তব্য-বিবৃতির প্রতি আমরা কিভাবে আস্থা রাখব? তাদের সৃষ্ট সমস্যা তারা যে সমাধানে ‘আন্তরিক’ সেটাইবা আমরা কিভাবে বুঝব? মঙ্গলবারের ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা ও আউং সান সুচির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ‘যাচাই’ ও প্রত্যাবাসনে প্রস্তুত রয়েছে। ১৯৯২ সালের ২৮ এপ্রিল বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের যৌথ ঘোষণা অনুসারে তাদের ফিরিয়ে নেয়া হবে। বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই যৌথ ঘোষণা অনুসারে ১৯৯২ থেকে ২০০৫ সালের জুলাই পর্যন্ত ২ লাখ ৩৬ হাজার ৪৯৫ জনকে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিদ্যমান ভয়াবহ, উদ্বেগজনক পরিস্থিতে এখন সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন-‘রোহিঙ্গাদের যাচাই’ কিভাবে করা হবে? এই ‘যাচাই’ করার প্রক্রিয়া কি হবে? ওই যে নিরাপত্তা উপদেষ্টা ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘পরিচয়পত্র’ ছাড়া কোন নাগরিকের দায়ভার তারা নেবে না, সেইদিকেই কি ‘যাচাই’ কথাটি ইঙ্গিত করে না? এখানেই তো সব রহস্য এবং সব কূটকৌশলের অন্ধিসন্ধি! প্রথম প্রশ্ন যে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাধ্য হয়ে পালিয়ে এসেছেন তাদের যাচাইয়ের মানদ- কি শুধু ‘পরিচয়পত্র’? প্রাণ বাঁচানোর যেখানে আকুতি, সংগ্রাম সে অবস্থায় নিঃস্ব-রিক্ত অসহায় মানুষগুলোর কী পরিচয়পত্রের খেয়াল থাকে, সঙ্গে নিয়ে পালায়? আর সবচেয়ে বড় কথা রোহিঙ্গাদের পরিচয়পত্র আছে কি? রোহিঙ্গাদের ভাষা, পারিপার্শ্বিক অবস্থান, নিজস্ব সংস্কৃতি, আবাসস্থল, বংশপরম্পরার ইতিহাস এসব বিবেচ্য নয়, বিবেচ্য হবে তথাকথিত ‘পরিচয়পত্র’? আর এই পরিচয়পত্রই হবে তাদের ‘যাচাই’ বা শনাক্তের মাপকাঠি তারা মিয়ানমারের অধিবাসী কিনা! এখানেই রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের আন্তরিকতা এবং সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। চাপে পড়ে তারা যে লোক দেখানো উদ্যোগ নিয়েছে এটা বুঝতে গবেষণার প্রয়োজন নেই। তাদের প্রস্তাবের মধ্যে যেমন আন্তরিকতা এবং সদিচ্ছার বহির্প্রকাশ দেখতে পাচ্ছি না, তেমনি তাদের প্রতি বিশ্বাস রাখাও কঠিন। কারণ তারা কোন ন্যায় এবং মানবিকতার ধার ধারে এমন প্রমাণ পাইনি। সুতরাং দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় কোন কাজ হবে বলে মনে হয় না। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সংস্থা, সংগঠন এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপ অব্যাহত রাখার কোন বিকল্প নেই। আর তাতেই যদি কাজ হয় মিয়ানমারের চেতনা ফেরানোর ব্যাপারে। তবে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে বিশ্বকে এ সত্য বোঝাতে যে, সমস্যার সমাধানে আমরা আন্তরিক। ব্রিটেনের অক্সফোর্ড সিটি কাউন্সিল মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলের পক্ষ থেকে আউং সান সুচিকে দেয়া ১৯৯৭ সালে ‘ফ্রিডম অব দ্য সিটি’ খেতাব কেড়ে নেয়া হয়েছে। কারণ সুচি মিয়ানমারে সশস্ত্র বাহিনীর দ্বারা বিদ্যমান রোহিঙ্গা নিধনে নীরব ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে এবং বিষয়টি অস্বীকার বা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এর আগে অক্সফোর্ড এর সেন্ট হিউজ কলেজ থেকে সুচির পোট্রেট অপসারণ করা হয়েছে। অবস্থাদৃৃষ্টি মনে হচ্ছে ‘গণতন্ত্রে’র জন্য দীর্ঘ লড়াইয়ের নেত্রী সুচির আবেদন, ভাবমূর্তি বিশ্বে চরম বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু এতে তার সম্বিত ফিরবে কি? বিপন্ন মানবতার জন্য মানবীয় দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্প্রতি মাদার অব হিউম্যানিটি বলে আখ্যায়িত করেছে। আর একই কারণে ৩০ সেপ্টেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের বহুল প্রচারিত প্রভাবশালী ইংরেজী দৈনিক খালিজ টাইমস তাকে প্রাচ্যের নতুন তারকা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এ কথা সত্য, বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মানবিক ভূমিকার জন্য বিশেষ আলোচিত ও প্রশংসিত। মিয়ানমার সরকার তথা সেনাবাহিনীর দ্বারা অন্যায় ও নৃশংসভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর যে জাতিগত নিধন চালানো হচ্ছে এবং বিপন্ন মানুষগুলো প্রাণ বাঁচানোর আশায় অনন্যাপায় হয়ে যেভাবে প্রতিবেশী বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত আশ্রয় নিচ্ছে এবং বাংলাদেশের মানবদরদী প্রধানমন্ত্রী যে ঔদার্য দেখিয়ে তাদের আশ্রয় দিচ্ছেন নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা জেনে-বুঝেও, তার দৃষ্টান্ত সমসাময়িক বিশ্বে বিরল। শুধু মানবিক কারণে এসব উদ্বাস্তুদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের সর্বপ্রকার দায়িত্ব নেয়া, সাহায্য-সহায়তা দেয়া যে কত বড় মহৎ হৃদয়ের দরকার তা ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে কি? বর্তমান বিশ্বে শেখ হাসিনার অনন্যতা এখানেই যে, তিনি নিপীড়িত, বঞ্চিত, শোষিত মানুষের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর আর অভিভাবক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে ও প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। একটি উন্নয়নশীল দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই যে তার সহানুভূতি এর জন্যই তিনি ইতিহাসে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন। দেশ পরিচালনায় শুধু দক্ষতা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতাই যে যথেষ্ট নয়, এর জন্য আরও বেশি দূরদর্শী এবং মানবিক দায়িত্ব পালনের অভিপ্রায় থাকা জরুরী, বাঞ্ছনীয় তার প্রমাণই তিনি দিয়ে যাচ্ছেন। আর বিশ্ব নেতৃত্বকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন নিজ নিজ কর্তব্য পালনে মানবতার জন্য আরও বেশি সচেষ্ট ও সক্রিয় হওয়ার। প্রধানমন্ত্রী নিজেকে এমন এক উচ্চতা, অবস্থানে নিয়ে গেছেন এবং বাংলাদেশকে মেলে ধরেছেন যা বাংলাদেশের জন্য গৌরবের। তার অনন্যসাধারণ ভূমিকা বিশ্বে বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে আসীন করেছে। আর এজন্যই তিনি এখন সাম্য-শান্তি-মানবতার এক উজ্জ্বল প্রতীক হয়ে উঠেছেন। যে কারণেই খালিজ টাইমসে কলামিস্ট এ্যালন জ্যাকব লিখেছেনÑ ‘প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গার জীবন রক্ষায় সীমান্ত খুলে দিয়ে শেখ হাসিনা তার যে সহমর্মিতা ও সহানুভূতি দেখিয়েছেন সেজন্য এ সপ্তাহে তার চেয়ে বড় কোন হিরো দেখছি না।’ সত্যি, তার এই পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্য যে কতটা সঠিক এবং সময়োপযোগী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘শেখ হাসিনা জানেন সহমর্মিতার নৈপুণ্য’ শিরোনামের এই কলামে এ্যালন জ্যাকব লিখেছেনÑ স্বৈরাচারী, ঘৃণিত গুরু এবং নামগোত্রহীন লোকদের নিয়ে লেখার আগেই আমাদের উচিত ছিল শেখ হাসিনাকে এই পাতায় উপস্থাপন করা...’ এর চেয়ে গভীর ও খাঁটি উপলব্ধি আর কি হতে পারে? এ্যালনকে ধন্যবাদ তার এই বোধোদয়ের জন্য। আসলে সংকীর্ণ এবং অকৃতজ্ঞ এক শ্রেণীর বাঙালী যারা তারা শেখ হাসিনাকে তার যোগ্য স্বীকৃতি দিতে সর্বদা কুণ্ঠিত। দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে, এমনকি দল পরিচালনায়ও তার নেতৃত্ব, দূরদৃষ্টি, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা যে কত ব্যাপক এবং সময়োচিত তা এখন প্রমাণ হচ্ছে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মন্তব্যে ও স্বীকৃতিতে। রাজনীতিতে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় শেখ হাসিনার যে কোন বিকল্প নেই অন্তত সমসাময়িক বাংলাদেশে এ সত্যের প্রতিই এখন সবার চিন্তা স্থির হওয়া দরকার। এতে আমাদের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি যেমন পাবে, তেমনি আমরাও পারব উন্নয়নের নতুন অভিযাত্রায় শামিল হতে। সদিচ্ছা, দৃঢ় সংকল্প, আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা থাকলে যে অনেক দূর যাওয়া যায় তারই প্রমাণ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি বাংলাদেশ এবং বিশ্বের অহঙ্কার। তার কীর্তিই তাকে চিরজীবী করবে। এ্যালন তার কলামে আরও লিখেছেন, জার্মান চ্যান্সেলর এ্যাঞ্জেলা মের্কেল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলো থেকে ১২ লাখ শরণার্থী গ্রহণের সাহস দিখেয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যতিক্রম, এর সম্পদ সীমিত। এটি বাংলাদেশ সরকারের কারণে সৃষ্ট কোন জনস্রোত নয়, তথাপি শেখ হাসিনা তার মানবিকতার জায়গা থেকে সরে যাননি। এ্যালনের এ মন্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে আরও বলা যায়Ñ কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে জার্মানি একটি উন্নত সমৃদ্ধশালী দেশ। আয়তন, লোকসংখ্যা, সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থান বাংলাদেশের মতো নয়। তথাপি প্রায় সমপরিমাণ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যে সাহস, উদারতা দেখিয়েছেন এবং ঝুঁকি নিয়েছেন তা নজিরবিহীন। এখানেই শেখ হাসিনার মাহাত্ম্য ফুটে ওঠে তিনি মানবতার প্রয়োজনে যে কোন ত্যাগ, ঝুঁকি নিতে পারেন। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা বহুমুখী সেতুর কাজ হাতে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিকট অতীতে যে সাহস এবং দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন আর এখন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে হৃদয়বৃত্তির যে ঐদার্য ও সহানুভূতি দেখিয়েছেন তা ইতিহাস মান্য হয়ে থাকবে। লেখক : সাংবাদিক
×