ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গাদের ঢল থামছে না, দুদিনে এসেছে আরও ১২ হাজার

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৫ অক্টোবর ২০১৭

রোহিঙ্গাদের ঢল থামছে না, দুদিনে এসেছে আরও ১২ হাজার

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের সেনা অভিযানের মাধ্যমে বর্বরোচিত কায়দায় গণহত্যা চালানোর পর এখন গ্রামের পর গ্রামে ঘেরাও দিয়ে ঘরছাড়া করা হচ্ছে। এ কাজে আগে থেকে যুক্ত হয়ে আছে মগ সন্ত্রাসীরাও। ফলে নাফ নদী ও সমুদ্র পথে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ অব্যাহতই রয়েছে। মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার পর্যন্ত নতুন করে এসেছে আরও ১২ সহস্রাধিক রোহিঙ্গা নরনারী ও শিশু। এদের সবাই আসছে টেকনাফের নাইটংপাড়া, শাহপরীর দ্বীপ, লম্বারবিলসহ উপকূলের বিস্তৃত বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে। বর্তমানে রোহিঙ্গা আগমন ঘটছে মংডুর রইগ্যারবিল, বুচিদং ও টাইমানখালী এলাকা থেকে। অপরদিকে, লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে তাড়ানোর পর তাদের বসতি এলাকাগুলোতে মগ সন্ত্রাসীরা তিনটি ঘোষণা সংবলিত সাইনবোর্ড গেড়ে দিয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে লাল পতাকাও। এসব সাইনবোর্ডে লেখা হয়েছেÑ এক, রোহিঙ্গামুক্ত এলাকা। দুই, এখানে রোহিঙ্গাদের অবস্থানের অনুমতি নেই। তিন, কোন রোহিঙ্গাকে বিয়ে এবং তাদের সম্পত্তি বেচাকেনার অনুমতি নেই। মগ সন্ত্রাসীদের এই লাল পতাকা ও সাইনবোর্ড টাঙ্গানোয় সহায়তা করছে সে দেশের সেনারা। অপরদিকে, সীমান্ত নিয়ে আন্তর্জাতিক সকল রীতিনীতি উপেক্ষা করে মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার খুব কাছ দিয়ে সেনা টহল অব্যাহত রয়েছে। এর সঙ্গে চলছে নতুন করে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ। বুধবার সকাল থেকে নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তের ওপারে তমব্রুর চাকমাপাড়া দিয়ে নতুন করে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করতে দেখা গেছে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বিজিপিকে। এছাড়া সীমান্তের এপারে বিজিবি সদস্যদের শান্তির পতাকা হাতে নিয়ে টহল দিতে প্রত্যক্ষ করা গেছে। মিয়ানমারে সৃষ্ট রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল ও বিশ্ব সম্প্রদায় সোচ্চার হলেও মিয়ানমারের পক্ষে বুধবার পর্যন্ত প্রায় ৪২ দিন গায়ে পড়ে সহিংসতার পাশাপাশি যুদ্ধংদেহী মনোভাবই পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দান এবং মানবতার দিকগুলোর সবটুকু সম্প্রসারিত করার পাশাপাশি কোন ধরনের উস্কানিমূলক ফাঁদে পা না দেয়ার নীতিই অবলম্বন করে চলেছে। কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে এ সঙ্কট সমাধানে বাংলাদেশ যতই সোচ্চার তৎপরতায় রয়েছে বিপরীতে মিয়ানমার বাহিনীর আচরণ ঠিক তার উল্টো। সে দেশের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের গণহারে হত্যা রাখাইন সন্ত্রাসী দিয়ে জাতিগত দাঙ্গা সৃষ্টির ক্রমাগত তৎপরতা, সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া এবং সর্বশেষ রোহিঙ্গাদের বসতিগুলোতে ঘেরাও করে তাদের বাংলাদেশে চলে যেতে বাধ্য করার ঘটনাবলীতে প্রতীয়মান হচ্ছে যে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের সমূলে উৎখাত করে ছাড়বে। সীমান্তের ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে, শুধু রাখাইন নয়, বর্তমানে সেখানকার শান রাজ্যেও মুসলমান অধ্যুষিত এলাকাগুলোতেও সহিংসতা শুরু করতে পারে। শান রাজ্যের প্রদেশগুলোতে লাল পতাকা টাঙ্গানো হচ্ছে। মুসলমানদের সে দেশে বসবাসের অনুমতি নেই সংবলিত সাইনবোর্ডও গেড়ে দেয়া হচ্ছে। সঙ্গত কারণে, পুরো মিয়ানমারের সবকটি রাজ্যের রোহিঙ্গা বসতিগুলোতে শঙ্কা ও উদ্বেগ বেড়ে চলেছে। মানসিক চাপে ভুগছে তারা। নতুন ১২ সহস্রাধিক অনুপ্রবেশ মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত নাফ নদী ও সাগর পথে আরও ১২ সহস্রাধিক নতুন রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। টেকনাফের নাইট্যংপাড়া, শাহপরীর দ্বীপ, উলুবুনিয়া, লম্বাবিল পয়েন্ট দিয়েই মূলত রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের যে ঢল নেমেছে তা কমছে না। বর্তমানে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অীধকাংশ রাখাইনের বুচিদং এলাকার। এ পারে চলে আসা বহু রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বুচিদং এলাকার রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলো গেল দুই সপ্তাহ ধরে সেনা সদস্যরা অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। তারা ঘর থেকে বের হতে পারেনি। কাজে কর্মে যাওয়ার উপায়ও ছিল না। ফলে রোহিঙ্গা বসতিগুলোতে খাদ্যাভাব সৃষ্টি হয়। ইতোমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে অনেকে। এখন তাদের বাংলাদেশে চলে যাওয়ার সুযোগ দিচ্ছে সেনা সদস্যরা। বিজিবির বক্তব্য টেকনাফ বিজিবির উপঅধিনায়ক শরীফুল ইসলাম জানিয়েছেন, উলুবুনিয়া সীমান্ত দিয়ে বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গা প্রতিদিন ঢুকছে। কী হারে রোহিঙ্গা ঢুকছে তা বলার উপায় নেই। তবে এ দেশে পৌঁছার পর তাদের সরাসরি উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে এবং পাঠানোও হচ্ছে। ১০ হাজার একর বনভূমিতে রোহিঙ্গা বসতি কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের উখিয়া, টেকনাফ ও হোয়াইক্যং রেঞ্জের প্রায় ১০ হাজার একর বনভূমিতে রোহিঙ্গাদের বসতি গড়ে উঠেছে। নয়াপাড়া ও কুতুপালং রেজিস্টার্ড ক্যাম্পসহ পুরনো রোহিঙ্গাসহ নতুন আসা রোহিঙ্গারা দশ হাজার একর বনভূমি দখল করে ঝুপড়ি তৈরি করেছে। কক্সবাজার বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আলী কবির জানান, প্রতিদিনই নতুন নতুন পাহাড়ী জমি দখল করে রোহিঙ্গারা ঝুপড়ি ঘর তৈরি করছে। ফলে সেখানকার বনভূমি উজাড় হচ্ছে। আরও সাড়ে ৩ হাজার একর ভূমি বরাদ্দ হচ্ছে সরকার পক্ষে রোহিঙ্গাদের জন্য ইতোমধ্যে ২ হাজার একর জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে আশ্রয়স্থল গড়ে তোলার জন্য। কিন্তু বরাদ্দের এ জমিতে রোহিঙ্গার সঙ্কুলান হবে না বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে আরও সাড়ে ৩ হাজার একর জমি কুতুপালং এলাকায় বরাদ্দ দেয়া হবে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে। প্রথম দফায় যে দুই হাজার একর জমি বরাদ্দ দেযা হয়েছে সেখানে অস্থায়ী বসতি গড়ে উঠছে। নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে রোহিঙ্গাদের সরানো শুরু বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে বর্তমানে ১৫ সহস্রাধিক রোহিঙ্গার অবস্থান রয়েছে। এদের পর্যায়ক্রমে সরিয়ে কুতুপালং এলাকায় সরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু করেছে বুধবার থেকে। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পরিদর্শনে এসে অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, নিরাপত্তাসহ সীমান্ত পরিস্থিতি বিবেচনায় রখে এদের দ্রুততম সময়ে একটি পয়েন্টে অর্থাৎ কুতুপালং এলাকায় ক্যাম্পে রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ৩৯ রোহিঙ্গা মাঝিমাল্লা আটক রোহিঙ্গাদের এপারে নিয়ে আসার কাজে তিন শতাধিক ছোট-বড় নৌযান যুক্ত রয়েছে। মঙ্গলবার রাতে পুলিশ ও বিজিবি অভিযান চালিয়ে এসব নৌকার ৩৯ মাঝিমাল্লাকে আটক করেছে। বিজিবি সূত্রে জানানো হয়েছে, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পার করে আনার সময় এদের আটক করা হয়। এছাড়া টেকনাফ থানা পুলিশ আটক করেছে আরও ৫ রোহিঙ্গা নৌকার মাঝি। চালানে চালানে পৌঁছছে ত্রাণ আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতিদিন চালানে চালানে পৌঁছছে বিভিন্ন ত্রাণ সাহায্য। সরকারী, বেসরকারী, দেশী-বিদেশী ত্রাণ চালানের পাশাপাশি বেসরকারী পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে। ফলে রোহিঙ্গাদের মাঝে খাদ্যাভাব নেই। বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষে রোহিঙ্গাদের প্রাণ বাঁচাতে রীতিমতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে। চিকিৎসাসেবা আরও বৃদ্ধি আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য চিকিৎসাসেবা আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে তা আরও বাড়বে বলে কক্সবাজারের সিভিল সার্জন দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে। রোহিঙ্গা শিশু ও নারীরা বিশেষ করে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। গর্ভবতী রোহিঙ্গা নারীর সংখ্যা অগণন, যা ইতোমধ্যে প্রায় ৮০ হাজার বলে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার পক্ষে জানান দেয়া হয়েছে।
×