ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দেহঘড়ির সন্ধান

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ৫ অক্টোবর ২০১৭

দেহঘড়ির সন্ধান

দেহঘড়ির সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। অর্থাৎ এতদিনে তা প্রমাণ করে তিন বিজ্ঞানী জিতে নিয়েছেন বিজ্ঞানে সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার নোবেল। ২০১৭ সালে শারীরবিদ্যায় নোবেলপ্রাপ্ত এই তিন বিজ্ঞানী হলেন জেফ্রি হল, মাইকেল রসব্যাশ ও মাইকেল ইয়ং। অবশ্য বিজ্ঞানের আবিষ্কারের অনেক আগেই মানুষের দেহ ঘড়ির সন্ধান পেয়েছিলেন বাংলার বাউল ও দেহতত্ত্ববাদী ফকিরÑলোক গায়করা। উদাত্ত কণ্ঠে মাঠে-ঘাটে-পথে-প্রান্তরে একতারা-দোতরা বাজিয়ে গেয়ে শুনিয়েছিলেন, ‘মন আমার দেহ ঘড়ি সন্ধান করি ...’। তবে তখন প্রকৃতই দেহ ঘড়ির সন্ধান পাওয়া তো দূরের কথা, এমনকি তত্ত্ব-তালাশ করাও ছিল দুরূহ ও দুঃসাধ্য। বিজ্ঞানের দীর্ঘ সাধনা ও গবেষণার পথ ধরে এতদিনে তা বুঝি ধরা দিতে শুরু করেছে। বিশ্বব্যাপী দিনের পরে রাত হয়, রাতের পরে ফুটে ওঠে সকাল। সময়ের এই আবর্তন ও বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আবর্তিত হয় মানুষের দেহ ঘড়িও, ইংরেজীতে যাকে বলে সার্কাডিয়ান রিদম। অবশ্য সময়ের এই আবর্তন বিবর্তন শুধু মানুষের মধ্যেই অনুভূত হয় না, বরং সমগ্র জীবজগত এবং উদ্ভিদজগত মেনে চলে এই নিয়ম। বলা যায়, সার্কাডিয়ান রিদম হলো একটি জৈব প্রক্রিয়া যা প্রাকৃতিকভাবে আবর্তন করে থাকে দিন রাত ২৪ ঘণ্টাব্যাপী। আলো-অন্ধকারের এই ঘড়ি সমানভাবে সক্রিয় থাকে। জীব ও উদ্ভিত জগতের ঘুম ও খাদ্যাভ্যাস, হরমোন ও শারীরিক তাপমাত্রা, ক্লান্তি-শ্রান্তিÑ সবই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এই ঘড়ি। এর সঙ্গে এমন কি পৃথিবীর আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতিও কমবেশি জড়িত। মানুষ ও পশুপাখি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করে থাকে সর্বদাই। এক্ষেত্রে কাছেধারে হলে সমস্যা নেই, তবে এক গোলার্ধ থেকে অন্য গোলার্ধে, এক টাইমজোন থেকে আরেক টাইমজোনে প্রবেশ করলেই দেখা দেয় সমস্যা, যাকে বলে জেট ল্যাগ। যে কারণে দেখা দেয় শারীরিক-মানসিক সমস্যা, বিষণœতা, বমিভাব, অনিদ্রাসহ মানসিক সমস্যা। পরিবর্তিত সমস্যার সঙ্গে পারিপার্শ্বিক সময়ের দেহ ঘড়ি খাপ খাওয়াতে না পারলেই ঘটে এমনটি। দীর্ঘদিন ধরে জীবনযাপন পদ্ধতির সঙ্গে দেহ ঘড়ির অসামঞ্জস্য চলতে থাকে এমনকি ক্যান্সার-¯œায়বিক অসুখবিসুখ, বিপাকে ত্রুটি, প্রদাহ ইত্যাদি হতে পারে। নোবেলপ্রাপ্ত তিন বিজ্ঞানী তিন দশক আগে ফলের মাছির ওপর গবেষণা করে আবিষ্কার করেছেন সেই জিন, যা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে দেহ ঘড়ি। ওই দিন রাতের বেলা ছড়িয়ে পড়ে কোষের ভেতরে, যাতে ক্লান্তি আসে, নিদ্রা নেমে আসে চোখে। আবার দিনের বেলায় তা কমে আসে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। রাতে জীব ও উদ্ভিদজগত জেগে ওঠে নবকর্মোদ্যমে। বিজ্ঞানীরা দেহঘড়ির আরেকটি প্রোটিন উপাদানও শনাক্ত করেছেন, যা কোষের ভেতর স্বনিয়ন্ত্রিত ঘড়িটি পরিচালনায় সহায়তা করে। অতঃপর প্রশ্ন উঠবে, এই আবিষ্কারের ফল কী? যে কোন আবিষ্কারের নিট ফল তাৎক্ষণিক বিচার করা যায় নাÑ বরং বলা যায়, এই আবিষ্কারের প্রাপ্তি হবে সুদূরপ্রসারী এবং জীব ও উদ্ভিদ জগতের জন্য অবশ্যই ইতিবাচক। কেননা প্রতিদিনকার জৈব প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে শরীর-স্বাস্থ্য-মন ঠিক রাখাসহ চিকিৎসার বিধান পাওয়াও হবে সহজসাধ্য। দেহঘড়ি মিলিয়ে রোগীকে ওষুধ খাওয়ানো যাবে উপযুক্ত সময়ে। ফসল ফলানো ও ওঠানোর সময় বের করা যাবে সহজে। অচিরেই হয়ত বাজারে পাওয়া যাবে মানুষের আহার, নিদ্রা, বিশ্রাম ও ওষুধ খাওয়ার সঠিক সময় জানানোর জৈব ঘড়ি। সর্বোপরি দীর্ঘদিনের জন্য যে বা যারা মহাশূন্য পরিক্রমায় যান অথবা আগামীতে যাবেন মঙ্গলগ্রহ ও অন্যত্র, দেহঘড়ি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তাদের শরীর-স্বাস্থ্য-মন সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হবে।
×