ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সপক্ষে

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ৫ অক্টোবর ২০১৭

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সপক্ষে

অবশেষে মিয়ানমার রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে আগ্রহী হয়েছে। যে রোহিঙ্গাদের তারা নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না, সেই তাদের ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়েছে। বৈশ্বিক চাপে সামরিক জান্তা শাসিত মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ অনেকটা নমনীয় হয়েছে বলা যায়। রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানের নামে গণহত্যা শুরুর পর বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার জন্য বাংলাদেশ বার বার যে দাবি জানিয়ে আসছে সে দাবি পূরণে তারা সম্মত হয়েছে। উভয় দেশ দ্বিপক্ষীয় ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান যে চায় তা স্পষ্ট হয়েছে দু’দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের ঢাকায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে। কিভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় ও কবে নাগাদ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়া হবে, সেসব বিষয় চূড়ান্ত করবে দু’দেশের একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সুনির্দিষ্ট করতে দুদেশ একটি চুক্তি সই করবে। কূটনৈতিক যে তৎপরতা বাংলাদেশ চালিয়ে আসছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে, তারই সাফল্যের প্রাথমিক স্তর এই সিদ্ধান্ত। বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা অবশ্য বলছেন, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান নির্যাতন নিপীড়ন, গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ বন্ধ হলে এবং নাগরিক ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিলে তারা ফিরে যেতে আগ্রহী। হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য ও রক্ত যে মাটিতে মিশে আছে, সেখানকার পরিস্থিতি ভাল হলে তারা ফিরে যাবে জন্মভূমিতে। ২৫ আগস্ট থেকে অদ্যাবধি পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বর্বরতার শিকার হয়ে বাঁচার আশায় বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগে ১৯৭৮ সাল থেকে দফায় দফায় আরও পাঁচ লাখ এসেছে। জাতিগত নিধন কার্যক্রম ও বাংলাদেশে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক সমালোচনা ও চাপের মুখে পড়ে মিয়ানমার সরকার। এ অবস্থায় আলোচনায় বসার জন্য বাংলাদেশে আসেন সুচির দফতরের মন্ত্রী। দীর্ঘদিনের এই সমস্যা সমাধানের মানদ- ঠিক করতে মিয়ানমারের কাছে একটি চুক্তির খসড়া দিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ বলছে, ১৯৯২ সাল থেকে এ পর্যন্ত আশ্রয় নেয়া নয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার সবাইকে ফেরত নিতে হবে। যদিও মিয়ানমার এই মুহূর্তে গত বছরের অক্টোবরের পর থেকে এখন পর্যন্ত আসা প্রায় ছয় লাখ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা আর অতীতে নিবন্ধিত দুই হাজার চার শ’ পনেরো জন শরণার্থীকে ফেরানোর কথা বলছে। এর আগে সুচি বলেছিলেন, নাগরিকত্ব যাচাই-বাছাই করে ফেরত নেয়া হবে। মিথ্যাচারে আকীর্ণ সুচির ভাষ্য। যাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছে, এমনকি সব মৌলিক অধিকারও, সেই তাদের নাগরিকত্ব বাছাই প্রশ্ন কেন আসবে। একই সময়ে জেনেভায় অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার নির্বাহী কমিটির বৈঠকে মিয়ানমারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী বলেছেন, শরণার্থীদের ফেরত নেয়াই এখন তাদের প্রধান অগ্রাধিকারের বিষয়। মিয়ানমার যে সন্ত্রাসের কথা বলছে, বাংলাদেশ সে বিষয়ে তার ‘জিরো টলারেন্স’-এর কথা পুনর্ব্যক্ত করে সীমান্ত ও নিরাপত্তা সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। গ্রাম আর ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে সেসব স্থান জান্তারা দখল করে নিয়েছে। এখন বলছে, বাস্তুচ্যুতরা পাড়া ও গ্রামের নাম বলতে পারলে ফেরত নেয়া হবে। যখন মন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনা চলছিল, তখনও রাখাইন থেকে দলে দলে বাস্তুচ্যুতরা বাংলাদেশে আসছিল সেনা নির্যাতনের মুখে। জাতিসংঘ জাতিগত নিধন রোধে সেনা অভিযান বন্ধ করার কথা বলে আসছে। কোফি আনান কমিশন যে সুপারিশ করেছে তা বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে পাঁচ দফা পেশ করেছেন। এটা আশার কথা অবশ্য যে, আলোচনা শুরু হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার বিষয়ে মিয়ানমার কতটা আন্তরিক, তাদের অবস্থান কী হবে, তা এখনও স্পষ্ট হয়নি। এমনটাও মনে হতে পারে যে, দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হলে আন্তর্জাতিক চাপ কমে যাবে এবং এর সমাধান দীর্ঘমেয়াদী হবে। তাই দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পাশাপাশি বহুপক্ষীয় উদ্যোগ নেয়া হলে এই সমস্যার দ্রুত সমাধান সম্ভব হতে পারে। আলোচনার যে সূত্রপাত হয়েছে, তা ইতিবাচকভাবে দেখা সঙ্গত। এ বিষয়ে বাংলাদেশকে আরও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতে পারে। মানবিকতার উজ্জ্বল উদাহরণ বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের দীর্ঘদিন ভরণপোষণ দিতে পারবে না। সম্ভবও নয়। মিয়ানমারের সৃষ্ট সঙ্কট সে দেশটিকেই সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে।
×