ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রাবনী আক্তার সান

অধিনায়ক কোহলি এখনই ইতিহাসের সেরা

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৪ অক্টোবর ২০১৭

অধিনায়ক কোহলি এখনই ইতিহাসের সেরা

অধিনায়ক হিসেবে একের পর এক সাফল্য এনে দিচ্ছেন কোহলি। ফাইল ছবি বিরাট কোহলি যে ভাল অধিনায়ক, সেটা ভারতের খেলা দেখলেই বোঝা যায়। অধিনায়কের আগ্রাসী মানসিকতা ছড়িয়ে পড়েছে পুরো দলেই। ভারতের সফলতম অধিনায়কদের সঙ্গে এখনই তুলনা টানা হচ্ছে তাঁর। পরিসংখ্যান কিন্তু ইঙ্গিত দিচ্ছে এর চেয়েও বেশি কিছুর। সব সংস্করণ মিলে কোহলি সাফল্যে ছাড়িয়ে গেছেন রিকি পন্টিং কিংবা ক্লাইভ লয়েডদের! কোহলি ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব বুঝে পেয়েছেন মাত্র দুই বছর হলো। সব সংস্করণ হিসাব করলে অবশ্য সেটা ছয় মাসের একটু বেশি। এই সময়ে ভারতীয় দল দারুণ খেলছে। টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ের শ্রেষ্ঠত্ব বুঝে নিয়েছে গত বছর। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টানা সিরিজ জিতে ওয়ানডে র‌্যাঙ্কিংয়েও এখন এক নম্বরে ভারতীয় দল। কিন্তু এমন সাফল্যেই দুটি বিশ্বকাপ জেতা দুই অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড কিংবা রিকি পন্টিংকে ছাড়িয়ে গেছেন এতটা বলা বাড়াবাড়ি। কোহলি আসলে এঁদের ছাড়িয়ে গেছেন জয়-পরাজয়ের আনুপাতিক হারে। সব সংস্করণ মিলে কমপক্ষে ৬০ ম্যাচ অধিনায়কত্ব করেছেন, এমন খেলোয়াড়দের মধ্যে কোহলির চেয়ে এগিয়ে নেই কেউ। টেস্ট, ওয়ানডে ও টি২০ মিলিয়ে ৭৪ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছেন কোহলি। এই ৭৪ ম্যাচে ৫৩ বারই জিতেছে কোহলির দল। হার মাত্র ১৩ ম্যাচে। বাকি ৮ ম্যাচের ভাগ্যে হয় ড্র লেখা হয়েছে কিংবা ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়েছে। এর মানে ৭২.২২ ভাগ ম্যাচেই সফল কোহলি। তাঁর চেয়ে বেশ পিছিয়ে কিংবদন্তি লয়েড (৬৩.২৯ ভাগ)। অস্ট্রেলিয়ার সোনালি প্রজন্মকে নেতৃত্ব দেওয়ার সৌভাগ্য হওয়া পন্টিংয়ের সাফল্যও কোহলির চেয়ে কম (৬৭.৯০)। জয়-পরাজয়ের অনুপাতেও কোহলি এগিয়ে। প্রতিটি হারের বিপরীতে ৪.৩৩৩টি ম্যাচে জিতেছে কোহলির ভারত। সর্বজয়ী লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্ষেত্রে এই অনুপাত ৩.৩৩৩। পন্টিং এদিক থেকে অনেক পিছিয়ে (২.৮৫৭)। ফিটনেস এবং পরিশ্রম করার ক্ষমতা ধরে রাখতে পারলে ভারতের হয়ে আরও ১০ বছর খেলতে চান ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলি। দুই মাস পরেই ২৯ বছর বয়স হয়ে যাবে বিরাটের। তবে আরও এক দশক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেকে দেখতে চাইছেন চাইছেন ভারতের অধিনায়ক। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, আমরা অনেকেই ঠিকমতো জানি না, ঠিক কতদূর পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত। অনেক সময় অজান্তেই আমরা নিজেদের দক্ষতার ৭০ শতাংশ প্রয়োগ করতে পারি। তাই ফুরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত প্রত্যেকেরই চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত। আমি এখন যেভাবে অনুশীলন করি, তাতে আশা করি আরও ১০ বছর খেলতে পারব। শ্রীলঙ্কার মাটিতে বিরাটের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক সাফল্য পেয়েছে ভারতীয় দল। এই সফরে তিনটি টেস্ট, পাঁচটি একদিনের ম্যাচ এবং একটি টি-২০ ম্যাচের প্রতিটিতেই জয় পেয়েছে ভারত। ঘরের মাটিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৪-১এ ওয়ানডে জয় কোহলিকে বসিয়েছে আরও উঁচুতে। ও হ্যাঁ তার আগে গত জুলাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে দারুণ এক রেকর্ড গড়েন ব্যাটসম্যান কোহলি। কিংবদন্তি প্রাক্তন ব্যাটসম্যান শচীন টেন্ডুলকারকে ছাড়িয়ে নতুন রেকর্ড গড়েছেন বিরাট কোহলি। চেজ মাস্টার বিরাট কোহলি টপকে গেলেন কিংবদন্তি প্রাক্তন ব্যাটসম্যান শচীন টেন্ডুলকারকে। ভারতের রান মেশিন কোহলি রান তাড়া করার ক্ষেত্রে দারুণ সফল। এজন্য তাকে ‘চেজ মাস্টার’ বলা হয়। চার মাস আগে গত ৬ জুলাই জামাইকার সাবাইনা পার্কে সিরিজের শেষ একদিনের ম্যাচে জিতেছিল ভারত। সেইসঙ্গে সিরিজও জিতেছে টিম কোহলি। অধিনায়ক কোহলির শতরানের ইনিংসে ভর করে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৮ উইকেটে হারিয়েছে ভারত। দলকে জেতানোর পাশাপাশি কোহলি ভাঙ্গেন শচীনের রেকর্ড। একদিনের ক্রিকেটে রান তাড়া করতে নেমে সেঞ্চুরি সংখ্যায় শচীনকে টপকে গেছেন কোহলি। রান তাড়া করতে নেমে কোহলি ১৮ টি সেঞ্চুরি হাঁকান। শচীন করেছেন ১৭টি। তবে রেকর্ড নয়, জয়ের ধরনেই খুশি ভারত অধিনায়ক, ‘পরিসংখ্যান মাথায় রেখে ব্যাটিং করি না। আমার কাছে দলের জয়টাই সবার আগে। সিরিজ জয়ের ম্যাচে রান করতে পেরে ভাল লাগছে। অধিনায়ক হিসেবে দলকে এভাবে জিততে দেখাটা বেশ তৃপ্তিদায়ক’ বলেন কোহলি। এতটুকু শোনার পর অনেকে কোহলিকে হেয়ালি ভাবতে পারেন। তবে পরের বাক্যেই পূর্বসূরি গ্রেট সম্পর্কে মন্তব্য কবনত সময়ের ক্রেজি হিরো, ‘শচীনের রেকর্ড স্পর্শ করা অসম্ভব। দুই যুগের ক্যরিয়ারে ২০০টি টেস্ট, সাড়ে ৪শ’র ওপরে ওয়ানডে খেলেছেন। ১০০টি আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি। ভাবা যায়? কী অসাধারণ ব্যাপার! আমার মনে হয় না তার মতো এতদিন খেলে যেতে পারব। কিন্তু আমি ভারতীয় ক্রিকেটে পার্থক্য গড়ে দিয়ে তবেই ছাড়ব।’ শচীন যদি মাস্টার ব্লাস্টার হন, কোহলিকে চেজ মাস্টারই বলতে হবে। জ্যামাইকায় রান তাড়া করতে নেমে সেঞ্চুরির ক্ষেত্রে ‘ক্রিকেট ঈশ্বরকেও’ ছাড়িয়ে গেছেন। রান চেজ করতে গিয়ে ২৩২ ইনিংসে শচীনের সেঞ্চুরি ১৭টি, ১০২ ইনিংসেই কোহলির ১৮। ১১৬ ইনিংসে ১১ সেঞ্চুরি নিয়ে তালিকায় তৃতীয় স্থানে লঙ্কান তিলকারতেœ দিলশান। টেস্টে কোহলির অধিনায়কত্বের বীরত্ব বাদ যাবে কেন? ব্যাট হাতে গড়েছেন একাধিক রেকর্ড। তবে রেকর্ড হিসেবে ব্যাটসম্যান কোহলিকেও ছাপিয়ে গেছেন অধিনায়ক কোহলি। এ বছরই বাংলাদেশের বিপক্ষে হায়দ্রাবাদের একমাত্র টেস্টে ২০৮ রানের জয়ের মধ্যদিয়ে অধিনায়ক কোহলি গড়েছেন একগাদা রেকর্ড। সে পর্যন্ত ২৩ টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে ১৫টিতেই দলকে জয় এনে দেন কোহলি। নেতৃত্বের প্রথম ২৩ টেস্টে জয়ের হিসেবে কোহলিই এখন ভারতের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক। নেতৃত্বের প্রথম ২৩ টেস্টে জয়ের হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসেই কোহলির উপরে মাত্র একজন। অস্ট্রেলিয়ার স্টিভ ওয়াহ নেতৃত্বের প্রথম ২৩ টেস্টে জিতেছিলেন ১৭ ম্যাচে। তবে প্রথম ২৩ টেস্টে কোহলির সমান ১৫টি করে জয়ের কৃতিত্ব আছে অস্ট্রেলিয়ার আরেক সাবেক অধিনায়ক রিকি পন্টিং ও ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক মাইকেল ভনেরও। নেতৃত্বের প্রথম ২৩ টেস্টে ভারতীয়দের মধ্যে কোহলির পর রয়েছেন মহেন্দ্র সিং ধোনি, তিনি দলকে জিতিয়েছিলেন ১৪ ম্যাচে। ওই টেস্ট নিয়ে টানা ১৯ টেস্টে অপরাজিত কোহলির ভারত। এটাই ভারতের টানা সবচেয়ে বেশি ম্যাচে অপরাজিত থাকার রেকর্ড। ভারত সর্বশেষ টেস্ট হেরেছিল ২০১৫ সালের আগস্টে, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। এখানে কোহলি পেছনে ফেললেন সুনীল গাভাস্কারকে। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ১৮ ম্যাচে অপরাজিত ছিল গাভাস্কারের ভারত। টেস্ট ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি টেস্টে অপরাজিত থাকার রেকর্ডটি ওয়েস্ট ইন্ডিজের দখলে। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত সময়ে ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ অপরাজিত ছিল টানা ২৭ ম্যাচে। সেটি নিয়ে টানা ছয়টি টেস্ট সিরিজে জেতে ভারত। যা ভারতের টানা সবচেয়ে বেশি টেস্ট সিরিজ জয়ের রেকর্ড। এর আগে ভারত টানা পাঁচটি সিরিজ জিতেছিল ধোনির নেতৃত্বে, ২০০৮-২০১০ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে। হায়দ্রাবাদের বাংলাদেশের বিপক্ষে জয়ে কোহলি আজহারউদ্দিনকে টপকে পৌঁছে গেছেন ভারতের সবচেয়ে বেশি টেস্ট জয়ী অধিনায়কদের তালিকার তিন নম্বরে। ম্যাচ জয়ের হিসেবে তার উপরে কেবল ধোনি (২৭ জয়) ও সৌরভ গাঙ্গুলী (২১ জয়)। তবে জয়ের শতকরা হারের হিসেবে কোহলিই ভারতের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক। ২৩ ম্যাচে ১৫ জয়, ২ হার, ৬ ড্র। জয়ের হার শতকরা ৬৫.২১। ধোনির ২৭ জয় ৬০ ম্যাচে, জয়ের হার শতকরা ৪৫.০০। গাঙ্গুলীর ২১ জয় ৪৯ ম্যাচে। জয়ের হার শতকরা ৪২.৮৬। তার সঙ্গে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ যোগ কলে সাফল্যের হার আরও বাড়বে। যেভাবে সাফল্যের পতাকা উড়িয়ে চলেছে কোহলির ভারত, তাতে কোহলির রেকর্ড লিপিবদ্ধ করার জন্য আলাদা একটা অধ্যায়ই সংযোজন করতে হয় কিনা কে জানে!
×