ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাফ অনুর্ধ-১৫ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপ

ঘরের মাঠে বাংলার মেয়েরাই ফেভারিট

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৪ অক্টোবর ২০১৭

ঘরের মাঠে বাংলার মেয়েরাই ফেভারিট

রুমেল খান আগামী ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে ফুটবল আসর ‘সাফ অনুর্ধ-১৫ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপ।’ এ উপলক্ষে গত ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে বাফুফে ভবনে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ অ-১৫ মহিলা দলের আবাসিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। ক্যাম্পে যোগ দিয়েছে ৩৭ ফুটবলার। তবে সাবিনা ইয়াসমীন যোগ দিতে পারেনি। ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার কলসিন্দুরের এই চতুর্দশী ফরোয়ার্ড মাত্র তিনদিনের জ¦রে নিজ গ্রামের বাড়িতে মারা যায়। আগামী ডিসেম্বরেই হয়তো বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে দেখা যেত সাবিনাকে। অনুর্ধ-১৫ মহিলা দলের সঙ্গে অনুশীলন ক্যাম্পে যোগ দেয়ার কথা ছিল তার। এবার সাফ অনুর্ধ-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপ হবার কথা ছিল গ্রুপ পদ্ধতিতে। তবে মালদ্বীপ নাম প্রত্যাহার করে নেয়ায় সাফের ফর্মেটে এসেছে পরিবর্তন। ফলে গ্রুপের বদলে এবার সাফ হতে যাচ্ছে লীগ পদ্ধতিতে। অংশ নিচ্ছে চার দল। এরা হলো : স্বাগতিক বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা। ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠেয় এই টুর্নামেন্টে প্রতিটি দল একে অপরের সঙ্গে ম্যাচ খেলবে। পয়েন্ট টেবিলের সেরা দুই দলের মধ্যে হবে ফাইনাল ম্যাচ। ২৩ জনের দলে সম্প্রতি এএফসি অনুর্ধ ১৬ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলে আসা দলের ১৩ ফুটবলার আছেন সাফের দলে। এরা হলেন- গোলরক্ষক মাহমুদা, রুপা, আঁখি শামসুন্নাহার, নীলা, আনাই এবং নাজমা, মারিয়া মান্দা, তহুরা, অনুচিং, মার্জিয়া, মনিকা, সুলতানা। শুধু পুরুষ ফুটবলের মাধ্যমেই এদেশের ফুটবলে জোয়ার আনলে হবে না, নজর দিতে হবে মহিলা ফুটবলেওÑ বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি পদে নির্বাচিত হবার পর এমনটাই ঘোষণা দিয়েছিলেন বাংলাদেশের জীবন্তু ফুটবল কিংবদন্তি কাজী মোঃ সালাউদ্দিন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিগত বছরগুলোতে ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মেয়েদের কয়েকটি ফুটবল আসর অনুষ্ঠিত হয়েছে। এগুলো দারুণ সাড়া জাগিয়েছে এদেশের ফুটবলপ্রেমীদের কাছে। সবচেয়ে নির্দোষ বিনোদন কি? মানুষের দেহ-মনকে চাঙ্গা রাখে কোনটি? কিসের মাধ্যমে একটি দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা যায় কিংবা একটি প্রায় অপরিচিত দেশকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তোলা যায়? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কিন্তু একটাই। সেটি হচ্ছে খেলাধুলা। অনেকেই বলেন, যারা খেলাধুলা পছন্দ করে না তারা সম্পূর্ণ মানুষই নয়। এই খেলাধুলা যদি কেবল পুরুষরাই করে তাহলে এটা কি যৌক্তিক হবে? শুধু পুরুষরাই খেলবে, আর মহিলারা ঘরে বসে থাকবে, কিংবা খেলাধুলা মেয়েদের জন্য নয়Ñ এমন উদ্ভট সব ধ্যান-ধারণা পোষণ করার দিন আজ আর নেই। বলা হচ্ছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটের কথা। মেয়েদের খেলাধুলারও দিন দিন প্রসার ঘটছে। তারা আজ ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনেক ক্ষেত্রে তাদের চেয়েও আশাতীত নৈপুণ্য প্রদর্শন করে দেশের জন্য সাফল্য ও সম্মান বয়ে আনছে। যেমন ২০১০ সাউথ এশিয়ান গেমসের (এসএ গেমস) কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশ যে ১৮টি স্বর্ণপদক অর্জন করে, তার ১০টি-ই আসে মেয়েদের হাত ধরে। এ থেকেই বোঝা যায় ধীরে হলেও এগুচ্ছে বাংলাদেশের মহিলা ক্রীড়াঙ্গন। এদেশে এখনও সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলার নাম ফুটবল। তবে পুরুষ ফুটবলের তুলনায় অনেক পিছিয়েই মহিলা ফুটবল। পারিবারিক ও সামাজিক বাধা, উদ্যোগ ও অর্থের অভাব, পেশা হিসেবে ফুটবলকে বেছে নেয়ার অনিশ্চয়তাÑ সবমিলিয়ে মেয়েদের ফুটবল এতদিন সাঁতার কেটেছে স্রোতের প্রতিকূলেই। প্রগাঢ় অমানিশার পর আসে ঝলমলে আলোকিত দিবস। তেমনি এবার পুরুষ ফুটবলের পূণর্জাগরণের পাশাপাশি মহিলা ফুটবলেরও সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এখন শুধু প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও ধারাবাহিতার। ২১ ডিসেম্বর, ২০১৫। নেপাল থেকে বাংলাদেশ বালিকা জাতীয় দল ফিরেছিল ‘এফসি অনুর্ধ-১৪ বালিকা চ্যাম্পিয়নশিপে’র শিরোপা জিতে। ৩ মে, ২০১৬। তাজিকিস্তান থেকে বাংলাদেশের একই দল ফিরল একই আসরের শিরোপা জিতে। ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬। ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ‘এএফসি অনুর্ধ-১৬ ওমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপ কোয়ালিফায়ার্সে’ ‘সি’ গ্রুপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হলো বাংলাদেশ দল। উল্লেখ্য, এই তিনটি দলেরই হেড কোচ ছিলেন গোলাম রব্বানী ছোটন। আসন্ন সাফ অনুর্ধ-১৫ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপেও তিনি থাকবেন বাংলাদেশ দলের হেড কোচ হিসেবে। এবারও কি তিনি সফলতা পাবেন? ছোটন নিজে এ ব্যাপারে অনেক আত্মবিশ্বাসী। তার অভিমত, ‘এখানে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা। তাজিকিস্তানে আমরা এএফসি অনুর্ধ-১৪ রিজিওনাল চ্যাম্পিয়নশিপ খেলেছি সেখানে ভারতকে দু’বার লীগে হারিয়েছি। নেপালকে বড় ব্যবধানে হারিয়েছি। বেশিরভাগ ওই টিমেরই খেলোয়াড়। শ্রীলঙ্কাও ওই টুর্নামেন্টে ছিল। ইরান, তাজিকিস্তানও ছিল। আমরা আটটা দলের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হয়ে এসেছি। তাই আশা করা যায় সাফেও চ্যাম্পিয়ন হতে পারব।’ তবে ফুটবলপ্রেমীরা মনে করছেন এই আসরে বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনে আরও অন্তত তিনটি কারণ আছে। সেগুলো হলো : ১. স্বাগতিক হওয়ার সুবিধা। নিজেদের পরিচিত মাঠ, আবহাওয়া, দর্শক... সবকিছুরই পূর্ণ সুবিধা নিয়ে মাঠে নামবে ছোটনের শিষ্যারা। ২. টিম কম্বিনেশন। কোচ ছোটনের অধীনে এই দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই দীর্ঘ চার বছর ধরে জাতীয় দলসহ বিভিন্ন জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে খেলেছে। একসঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে খেলার সুবাদে ছোটন যেমন তার খেলোয়াড়দের খেলা সম্পর্কে ভালভাবে অবগত, তেমনি ফুটবলাররাও পরস্পরের সঙ্গে খেলার সুবাদে পারস্পরিক জানাজোনা ও বোঝাপড়া খুবই ভাল। মাঠে এর সুপ্রভাব পড়েছে তিনবার (দু’বার অ-১৪ এবং একবার অ-১৬ আসরের শিরোপা জয়)। এবারও পড়ার সম্ভাবনা খুবই প্রবল। ৩. ফিটনেস, কৌশল ও আত্মবিশ্বাসের অভাবনীয় উন্নতি। একটা সময় ছিল, যখন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মাঠে নামার আগেই মানসিকভাবে হেরে যেত বাংলাদেশের মেয়েরা। আর ম্যাচে খেলতো ডিফেন্সিভ স্টাইলে। কিন্তু এখন সময়ের পরিক্রমায় এর উল্টোটাই ঘটছে অহরহ। কৌশল ও ফিটনেসের জায়গাটিতে ছোটনের দলের উন্নতি চোখে পড়ার মতো। কোন সন্দেহ নেই, এই আসরে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিপক্ষ হবে ভারতই। তবে এ নিয়ে মোটেও ভাবিত নন ছোটন, ‘ভারতকে এখন আমরা আর ভয় পাই না। সেদিন আর নেই। বরং ওরাই আমাদের ভয় পায় এবং সমীহ করে। অ-১৪ আসরে ওদের আমরা দু’বার হারিয়েছে সিনিয়র পর্যায়ে একবার ড্র করেছি। গত কয়েক বছরে একই দল নিয়ে খেলায় আমরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। এবার খেলতে গিয়ে প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তা বুঝে ফর্মেশন ঠিক করবেন ছোটন। অনুর্ধ-১৪ লেভেলে ৪-৩-৩ ফর্মেশনে খেলে দুটো আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ দল। তাছাড়া ৪-৪-২ এবং ৫-৩-২ এই দুটো ফর্মেশন নিয়েও কাজ করছেন ছোটন, দলও এতে অভ্যস্ত। প্রতিপক্ষ বুঝে এই তিনটি ফর্মেশনের কোন একটি খেলায় প্রয়োগ করবেন তিনি। তাছাড়া ম্যাচের গতি-প্রকৃতি অনুযায়ী ফর্মেশন বদলও হতে পারে। খেলায় আগে গোল হজম করলে বা আগে গোল করলে গেমের সিচুয়েশন বুঝে সেই অনুযায়ী দলকে খেলানোর চেষ্টা করবেন ছোটন। এএফসি অ-১৪ আসরে দু’বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগে ছোটন কখনই বলে যাননি যে তার দলই চ্যাম্পিয়ন হবে। কোনরকম অতি আত্মবিশ্বাসী হইনি, দম্ভ করেননি। বারবার বলেছেন ভাল খেললে তাদের শিরোপা জেতার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। কেননা তখন যে খেলোয়াড়দের তিনি পেয়েছিলেন, তারা ছিল অনেক সম্ভাবনাময়। তাই আত্মবিশ^াসী ছিলেন। এএফসি অ-১৬ আসরের বেলাতেও একই অবস্থা। তবে এই প্রথম ছোটন ঘোষণাই দিয়েছেন আসন্ন সাফ অ-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপে তার দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দাবিদার। ফুটবলামোদীদের একই মতÑ মারিয়া, মারজিয়া এবং মনিকারা যদি ঠিকমতো খেলতে পারে, সুযোগ কাজে লাগাতে পারে, তাহলে এবারও ওরা একটা কিছু ভাল ফল করতে পারে। এটা কি প্রত্যাশার চাপের সৃষ্টি করবে না? ‘আমি অতীতের সাফল্য নিয়ে মাথা ঘামাই না। কাজ করি বর্তমান নিয়ে, যাতে ভবিষ্যতে ভাল ফল পাওয়া যায়। তবে মিডিয়ায় বা বাইরে মেয়েদের সাফল্য নিয়ে যেভাবে নিউজ করা হয় বা প্রশংসা করা হয়, তাতে মেয়েদের মধ্যে অতি আত্মবিশ্বাস বা আত্ম অহঙ্কার বা প্রত্যাশার চাপ সৃষ্টি হতে পারে। এটাই স্বাভাবিক। এমনিতেই তারা বাচ্চা মেয়ে। তাই তাদের মধ্যে এসব যেন জন্ম নিতে না পারে, সেগুলো নিয়ে আমরা কোচিং স্টাফরা মাঠের বাইরে প্রচুর কাজ করি, করছি। যেমন ভিডিও সেশন ক্লাস, কাউন্সিলিং... এসব। তবে একটা কথা বলতে পারি, মেয়েরা খুবই আন্তরিক, পরিশ্রমী এবং আত্মনিবেদিত শেখার ব্যাপারে।’ ছোটনের অভিমত। এখন দেখার বিষয়, মেয়েদের বয়সভিত্তিক ফুটবলে চতুর্থ সাফল্য অর্জন করে দ্রোণাচার্য ছোটন আরেকবার মেতে উঠতে পারেন কি না বিজয়ের উল্লাসে।
×