ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জেএমবির অর্থায়নকারী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল শিক্ষিকা গ্রেফতার

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ৪ অক্টোবর ২০১৭

জেএমবির অর্থায়নকারী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল শিক্ষিকা গ্রেফতার

গাফফার খান চৌধুরী ॥ খোদ ঢাকা থেকে জেএমবির অর্থায়নকারী ও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক তৈরিতে সহায়তাকারী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের এক শিক্ষিকা গ্রেফতার হয়েছে। প্রায় তিন বছর ধরে ওই শিক্ষিকা শিক্ষকতার আড়ালে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জঙ্গীবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছিল। পাশাপাশি জেএমবিকে বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করার জন্য কয়েক দফায় অর্থায়ন করেছে। সেই সঙ্গে জঙ্গী সংগঠনটিকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক তৈরিতে দীর্ঘদিন ধরেই সহায়তা করে আসছিল। এই শিক্ষিকা নিজে আত্মঘাতী জঙ্গী কিনা তা জানার চেষ্টা চলছে। তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে পেয়ে কড়া জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রেখেছে র‌্যাব। র‌্যাব-৩-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইমরানুল হাসান জনকণ্ঠকে জানান, গত ২১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর খিলগাঁও থানাধীন দক্ষিণ বনশ্রী এলাকা থেকে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবির (জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ) সারোয়ার-তামিম গ্রুপের আদ্-দার-ই-কুতনী ব্রিগেডের কমান্ডার ইমাম মেহেদী হাসান ওরফে আবু জিব্রিল র‌্যাব-৩-এর হাতে গ্রেফতার হয়। ইমাম মেহেদী হাসান মূলত একজন র‌্যাম্প মডেল। তিনি মডেলিংয়ের আড়ালে জেএমবির হয়ে কাজ করছিলেন। মেহেদী হাসান জিজ্ঞাসাবাদে জানান, জেএমবি একটি অপারেশন চালানোর জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করছিল। অস্ত্র কেনার জন্য সাত লাখ টাকার প্রয়োজন ছিল। সেই টাকা সে জেএমবির বিভিন্ন সদস্যের কাছ থেকে সংগ্রহ করছিল। অর্থদাতাদের নাম প্রকাশ করে মেহেদী। তার মধ্যে সাদিয়া আমিন নামে গ্রেফতারকৃত এই নারীরও নামও রয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় সোমবার বিকেলে রাজধানী ঢাকার চকবাজার থানাধীন সোয়ারী ঘাটের ৯/১০ নম্বর বাড়ি থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন জেএমবির সারোয়ার-তামিম গ্রুপের ব্রিগেড আদ্Ñদার-ই-কুতনীর সক্রিয় সদস্য শিক্ষিকা সাদিয়া আমিনকে (২১) গ্রেফতার করা হয়। সাদিয়াকে মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে রাজধানীর বনানী মডেল থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। তাকে ৫ দিনের রিমান্ডে পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র‌্যাব-৩-এর অধিনায়ক জানান, সাদিয়ার স্বামীর নাম মোহাম্মদ নওরোজ রাইয়্যাত আমিন ওরফে আবু আতার (২৪)। ২০১৪ সালের নবেম্বরে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী আবু আতার ওরফে নওরোজের সঙ্গে পারিবারিকভাবে সাদিয়ার বিয়ে হয়। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আবু আতার ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারটি ১৯৯৫ সাল থেকে সপরিবারে অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। বিয়ের পর ২০১৪ ও ২০১৫ সালে আবু আতার দুই দফায় ৬ মাস বাংলাদেশে অবস্থান করে। বিয়ের আগ থেকেই আবু আতার জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী। ২০১৫ সালে বাংলাদেশে অবস্থানকালে আবু আতারের সঙ্গে এক জঙ্গীর পরিচয় হয়। তার মাধ্যমে আবু আতার পরিচয় হয় ইমাম মেহেদী হাসানের সঙ্গে। বিয়ের পর নওরোজ তার স্ত্রী সাদিয়া আমিনকে জঙ্গীবাদে উদ্ধুদ্ধ করেন। সাদিয়া জেএমবিতে যোগ দেন। জঙ্গীদের সঙ্গে গোপনে টেলিগ্রাম, থ্রিমারসহ বিভিন্ন এ্যাপসে যোগাযোগ করতেন। এই র‌্যাব কর্মকর্তা জানান, চকবাজারের ৯/১০ নম্বর ছয়তলা যে বাড়ি থেকে গ্রেফতার হয়েছে, সেটির মালিক ওই নারী জঙ্গীর পরিবার। সাদিয়ারা দুই বোন এক ভাই। সবার বড় বোন। দ্বিতীয় সাদিয়া। স্বামীর সঙ্গে সাদিয়া বাড়িটির ছয়তলায় বসবাস করতেন। তাদের সংসারে কোন সন্তান নেই। তিনি ২০১৫ সালে রাজধানীর ম্যাপল লীফ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে ও লেভেল পাস করেন। এরপর রাজধানীর চকবাজারে অবস্থিত একটি স্বনামধন্য ইংরেজী মাধ্যম স্কুলের শিক্ষিক হিসেবে যোগ দেন। এই র‌্যাব কর্মকর্তা বলছেন, আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের সন্তান হওয়ায় এবং নিজে যথেষ্ট অর্থ রোজগার করায় স্বামীর হাত ধরেই জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ার পর থেকেই তিনি জেএমবিকে আর্থিকভাবে সহায়তা করে আসছিলেন। তিনি র‌্যাম্প মডেল ইমাম মেহেদীর মাধ্যমে জেএমবিকে আর্থিকভাবে সহায়তা করতেন। ইমাম মেহেদীর কথামতো, জেএমবির একটি অপারেশন পরিচালনা করার জন্য সাত লাখ টাকার প্রয়োজন ছিল। পুরো টাকাই সাদিয়ার দেয়ার কথা ছিল। ইতোমধ্যেই তিনি নগদ এক লাখ টাকা ইমাম মেহেদীকে দিয়েছেন। যা সাদিয়া এবং ইমাম মেহেদী স্বীকার করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন সময় নানা অঙ্কের টাকা জেএমবির অন্যান্য সদস্য এবং ইমাম মেহেদীর সঙ্গে থাকা জেএমবির সদস্যদের দিয়েছেন। তবে তার পরিমাণ কম। অর্থ দেয়ার পাশাপাশি যে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, সেই স্কুলের শিক্ষার্থীদের জঙ্গীবাদে উদ্ধুদ্ধ করার চেষ্টা করতেন। তবে সে কাজটি তিনি করে আসছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও গোপনীয়তার সঙ্গে। স্কুলে নয়, তার কাছে যেসব শিক্ষার্থী একান্ত যোগাযোগ রাখত বা প্রাইভেট পড়ত তাদেরই তিনি টার্গেট হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তবে কতজন শিক্ষার্থী বা শিক্ষক-শিক্ষিকা তার মাধ্যমে জঙ্গীবাদে উদ্ধুদ্ধ হয়েছে, তা এখনও জানা যায়নি। সে বিষয়ে তদন্ত এবং অনুসন্ধান চলছে। সাদিয়ার পরিবার জঙ্গীবাদ বা অন্য কোন রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী কিনা, তাও জানার চেষ্টা চলছে। সাদিয়া জেএমবিতে যোগ দেয়ার পর থেকেই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক তৈরির ইংরেজী ফর্মুলার বাংলা অনুবাদ করে আসছিলেন। অনুবাদগুলো তিনি অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে জেএমবির সামরিক শাখার সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করতেন। সাদিয়া নিজে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক তৈরিতে বিশেষ জ্ঞান রাখেন। তবে নিজে সরাসরি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক তৈরি করেছেন কিনা তা জানা যায়নি। জিজ্ঞাসাবাদেও সাদিয়া সে সম্পর্কে কোন তথ্য দেননি। তিনি নিজে জঙ্গী প্রশিক্ষণের জন্য দেশের বাইরে যাননি। তবে তার স্বামী বা তার সহযোগীরা গেছেন কিনা, সে সর্ম্পকেও সাদিয়া পরিষ্কার কোন তথ্য দেননি। সাদিয়া আত্মঘাতী জঙ্গী কিনা এবং আত্মঘাতী হামলার জন্য তিনি বা তার অনুসারীরা কোন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন কিনা, সে সম্পর্কেও সাদিয়া বিশদ কোন তথ্য দেননি। তা জানতে বিস্তর অনুসন্ধান চলছে। জিজ্ঞাসাবাদে সাদিয়া এমন সব স্পর্শকাতর বিষয় এড়িয়ে যাচ্ছেন। এমনকি সাদিয়ার দেয়া অর্থে এখন পর্যন্ত জেএমবি কতটি অপারেশন চালিয়েছে বা ভবিষ্যতে কোথায় কি ধরনের অপারেশন চালানোর পরিকল্পনা ছিল এবং সাদিয়ার সঙ্গে কতজন নারী জঙ্গীর যোগাযোগ রয়েছে সে সম্পর্কেও সাদিয়া স্পষ্ট কোন তথ্য দেননি। জিজ্ঞাসাবাদে সাদিয়ার কাছ থেকে এসব বিষয়াদি ছাড়াও আরও অনেক তথ্য জানার চেষ্টা চলছে। সেসব তথ্য সম্পর্কে আগাম জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন এই র‌্যাব কর্মকর্তা।
×