ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

৯১ লাখ বেল পাট উৎপাদনের আশা

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ৪ অক্টোবর ২০১৭

৯১ লাখ বেল পাট উৎপাদনের আশা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ অর্থকরি ফসল পাট উৎপাদন নিয়ে সরকার ও সরকারী সংস্থাগুলো এ বছর ছিল দারুণ তৎপর। গত দু’বছর কৃষকও পাটের ভাল মূল্য পেয়েছেন। যে কারণে এবার তারা রেকর্ড পরিমাণ জমিতে পাট চাষ করেছেন। আশা করা হচ্ছে এবার রেকর্ড পরিমাণ পাটের উৎপাদন হবে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এবারই (২০১৭ সাল) প্রথম রেকর্ড পরিমাণ জমিতে অর্থাৎ আট দশমিক ১৭ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এবার রেকর্ড পরিমাণ অর্থাৎ ৯১ দশমিক ৭২ লাখ বেল পাট আঁশ উৎপাদন হবে। ২০১০ সালে সারাদেশে প্রায় সাড়ে সাত লাখ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়। তখন প্রায় ৭০ থেকে ৮০ লাখ বেল পাট আঁশ উৎপাদিত হয়। বিজেআরআই আশার কথা শোনালেও পাটের ন্যায্য দাম পাওয়া নিয়ে হতাশ চাষীরা। তারা বলছেন, গত দু’বছর ভাল মূল্য পেলেও এবার তারা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে ১২শ’ থেকে ১৬শ’ টাকা (প্রকারভেদে) মণ দরে পাট বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে বাজারে যে দরে পাট বেচাকেনা হচ্ছে তাতে কৃষকের উৎপাদন খরচ উঠছে না। ফলে হতাশ হয়ে পড়ছেন চাষীরা। আলাপকালে বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকরা জানান, বেসরকারী পর্যায় থেকে শুরু করে সরকার ও সরকারী সংস্থাগুলোর তৎপরতায় নানা প্রতিকূল আবহাওয়া উপেক্ষা কৃষকরা এবার নতুন উদ্যোমে পাট চাষ করেন। কিন্তু বাজারে এখন ১২ থেকে ১৬শ’ টাকা মণ দরে (প্রকারভেদে) বিক্রি হচ্ছে পাট। এই দামে পাট বিক্রি করে কৃষকদের উৎপাদন খরচ উঠছে না। বরং পাট উৎপাদন করে লোকসান গুনতে হচ্ছে। বর্তমান দামই যদি থাকে তাহলে আগামীতে আর পাট উৎপাদন করবেন কি না, তা নিয়ে চিন্তিত পাট চাষীরা। বগুড়ার ধুনট উপজেলার চরপাড়া গ্রামের আদর্শ কৃষক আকিমুদ্দিন শেখ। এক বিঘা জমিতে পাট চাষ বাবদ খরচ ও বিক্রি করে যে অর্থ পাওয়া যায় তার একটি চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এক বিঘা জমিতে পাট বপনের জন্য চাষ বাবদ খরচ হয়েছে ৮০০ টাকা, বীজের দাম ২০০ টাকা, নিড়ানি ২০০০ টাকা, সার ১০০০ টাকা, পাট কাটা বাবদ ১৬০০ টাকা, পরিবহন ও জাগ দেয়া ১৬০০ টাকা, পাট ধোয়া ১৬০০ টাকা, শুকানো ও বাজারজাত করার জন্য প্রস্তুত করতে আরও ১৬০০ টাকা ব্যয় হয়েছে। এক বিঘা জমিতে মোট উৎপাদন ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৪০০ টাকা। আর পাট উৎপাদন হয়েছে সাড়ে পাঁচ মণ। ১৫০০ টাকা মণ দরে পাটের বাজার মূল্য দাঁড়ায় আট হাজার ২৫০ টাকা। এ ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ ও পাট বিক্রি, অর্থাৎ আয়-ব্যয়ের হিসাব করলে কৃষকের নিট লোকসান দাঁড়ায় দুই হাজার ১৫০ টাকা। মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার কৃষক আকবর আলী জানান, বর্তমানে পাট ১৩০০-১৪০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেন, এ উপজেলায় পাট ক্রয়ে সরকারী কোন কেন্দ্র না থাকায় বাধ্য হয়ে কৃষক এলাকার ফড়িয়াদের কাছে তাদের ধার্য করা দামে পাট বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। তিনি বলেন, ১৫ দিন আগেও প্রতি মণ পাট ১৬ থেকে ১৮শ’ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। এখন আর আগের দামে পাট বিক্রি হচ্ছে না। পাট উৎপাদন করে আমরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। ‘পাটের উৎপাদন বাড়াচ্ছি আমরা, বিক্রির দায়ও কি আমাদের? সব দায় নিয়ে তো পাট চাষ করা যাবে না’- ক্ষোভ প্রকাশ করেন কৃষক আকবর আলী। রাজশাহীর পবা উপজেলার তেঘর গ্রামের কৃষক আফাজ উদ্দিন সরকার জানান, এবার বিঘাপ্রতি শ্রমিক, চাষ, নিড়ানি, জাগ, ধোয়া ও বাজারজাতসহ প্রায় ১১ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এ হিসাবে প্রতি মণ পাটের দাম দুই হাজার টাকা কম হলে লোকসান হবে। গেল বছর মণপ্রতি পাটের দাম ছিল আড়াই হাজার থেকে দুই হাজার ৭০০ টাকা। পাট চাষীরা যে কথা বলছেন তার সঙ্গে একমত নন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিজেআরআই) কর্মকর্তারা। একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ হলে তারা জানান, শুধু পাটের আঁশ হিসাব করলেই হবে না। পাটখড়ির বিষয়টিও অর্থনৈতিক মানদ-ে আনতে হবে। কারণ পাটখড়ি জ্বালানি ছাড়াও ঘরের বেড়া দেয়া, চালকল মিলে ব্যবহার, পানের বরজে ব্যবহার, পারটেক্স কোম্পানিসহ নানাবিধ কাজে ব্যবহার করা হয়। সুতরাং শুধু পাট আঁশের অর্থনৈতিক অংশটাই যথেষ্ট নয়। পাটখড়ি হিসেবে ধরলে কৃষকের লোকসান হবে না। তারা বিজেআরআই কর্মকর্তাদের এমন বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন পাট চাষীরা। তারা জানান, লাভের কথা চিন্তা করে তারা পাট উৎপাদন করেছেন। এখন যদি লোকসান হয় তাহলে এত কষ্ট করে পাটের আবাদ (চাষ) করার কোনো প্রয়োজন নেই। সরকারী কর্মকর্তারা পাটখড়ি বিক্রিসহ যে অর্থের কথা বলছেন সেটা গ্রামগঞ্জের জন্য প্রযোজ্য নয় বলেও জানান তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের পাট চাষীরা ভারতীয় পাট চাষীদের চেয়ে কম মূল্য পেয়ে থাকেন। কারণ বাংলাদেশের পাটের ন্যূনতম কোন বাজারমূল্য নির্ধারণ করা হয় না। অন্যদিকে ভারতে মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইজ প্রথা চালু রয়েছে। ফলে বাংলাদেশের কৃষকরা পাটের প্রকৃত মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পাটের দামের বিষয়ে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিউটের মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্বে) ড. মোঃ মনঞ্জুরুল আলম বলেন, ১৪শ’ থেকে ১৬শ’ টাকা মণ, পাটের জন্য এটা যথেষ্ট। এর সঙ্গে পাটখড়ির মূল্য যোগ করলে কৃষকের লোকসান হবে না। তিনি বলেন, বর্তমান বাজারে পাটের যে দাম আছে তাতেই পাট চাষ লাভজনক। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাট চাষের জমির পরিমাণ বাড়ছে। আগামীতে ১০ লাখ হেক্টর জমিতে আমরা পাট উৎপাদনের পরিকল্পনা করছি। বাংলাদেশ জুট মিলস এ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি এম বারিক খান বলেন, আমাদের পাট রফতানির জন্য প্রধান দেশ হচ্ছে ভারত। ভারত পাট রফতানির ওপর এ্যান্টি-ডাম্পিং ডিউটি বসানোর ফলে পাটের রফতানি কমে গেছে। এছাড়া পণ্যের মোড়ক হিসাবে পাটের বস্তার যে ব্যবহার ছিল তাও এখন কমে গেছে। দেশে চালের ক্রাইসিস চলার কারণে জরুরী ভিত্তিতে চাল আমদানি করা হচ্ছে। ফলে তারাও প্লাস্টিকের বস্তায় চাল পাঠাচ্ছে। পাটের ব্যবহারও কম হচ্ছে। এ জন্য এবার পাটের দাম কম। তবে কিছুদিন যাওয়ার পর পাটের দাম আরও বাড়বে। এক প্রশ্নের জবাবে বারিক খান বলেন, পাটের উৎপাদন ভালো হচ্ছে, দেশের পাটকলগুলোর জন্য এটা সুসংবাদ। সরকার প্রতি বছরই কৃষকের কাছ থেকে পাট কিনে থাকে। এ সময় এক শ্রেণীর ফড়িয়া দাম কম দিয়ে কৃষকদের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করে। কৃষকরা বঞ্চিত হলে পাটের উৎপাদন বাড়বে না। সরকারের উচিত হবে কৃষকের পাটের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা।
×