ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ইসির সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আলোচনার দিকে সবার নজর

প্রকাশিত: ০৪:৪৭, ৪ অক্টোবর ২০১৭

ইসির সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আলোচনার দিকে সবার নজর

শাহীন রহমান ॥ নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সংলাপ চললেও সবার নজর থাকছে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি ঘিরেই। বিশেষ দল দুটির পক্ষ থেকে আগামী নির্বাচন নিয়ে কি ধরনের প্রস্তাব তুলে ধরা হবে তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে সবাই। আগামী ১৫ অক্টোবর বিকেলে বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসছে নির্বাচন কমিশন। এর দুদিন পরেই ১৮ অক্টোবর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপ রয়েছে ইসির। তবে ইসির সঙ্গে আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে দল দুটির পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে কিছু না বলা হলেও দলীয় এজেন্ডা অনুযায়ী আলোচনার বিষয়বস্তু চূড়ান্ত করা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজ, গণমাধ্যমের সঙ্গে আলোচনায় যে সব বিষয় উঠে এসেছে তাও মাথায় রাখছে। জানা গেছে. অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়, ইভিএমের ব্যবহার, নির্বাচনী আইন সংস্কার, সংসদীয় আসনের সীমানার ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। তবে উভয় দলই চায় অবাধ সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন দলীয় প্রভাবের বাইরে গিয়ে শক্তিশালী এবং স্বাধীন ভূমিকা পালন করবে। তবে জানা গেছে বিএনপি সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেয়ার প্রস্তাব করলে আওয়ামী লীগ এর বিরোধিতা করবে। আওয়ামী লীগ চায় ইসির প্রয়োজন অনুযায়ী ইসিকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে ব্যবহার। অপর দিকে বিএনপি ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন ইভিএমের বিপক্ষে কথা বললেও আওয়ামী লীগ এর পক্ষে প্রস্তাব তুলে ধরবে। এছাড়া অন্যান্য বিষয়ে দল দুটির পক্ষ থেকে পক্ষে বিপক্ষে নানা মতামত আসতে পারে বলে না গেছে। বিএনপি নির্বাচনকালীন সরকার চাইলেও এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ ছাড় দিতে নারাজ বলে জানা গেছে। তবে দল দুটি আলোচ্য বিষয় প্রকাশ্যে না বললে এ কয়েকটি বিষয়ের ওপর আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি বেশি জোর দেবে। জানা গেছে, সংলাপে বিএনপি যে বিষয়টির ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করছে তা হলো নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা। দলের পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তে এখন নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন বিএনপি সহায়ক সরকারের কথা বললেও এ বিষয়ে ইসির করার কিছুই নেই। যেহেতু আইনে যেভাবে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে তার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা ইসির নেই। তাদের সংবিধান বা আইনের মধ্য থেকেই সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ বের করতে হবে। এর আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা সাংবাদিকদের বলেন, সংলাপে নির্বাচন নিয়ে যে সব সুপারিশ করা হচ্ছে তার সবগুলোই ইসি গ্রহণ করতে পারবে না। বিশেষ করে আইনের ভেতর বা ইসির এখতিয়ার আছে এমন বিষয়ে প্রস্তাবনার বিষয়ে কেবল ইসি বিবেচনা করতে পারে। তারপরও ইসির এখতিয়ারের বাইরে কোন বিষয় আলোচনায় আসলে তা সংশ্লিষ্ট পক্ষকে ইসি অবহিত করতে পারে। এর বাইরে ইসির করার কিছু নেই। জানা গেছে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ইসির সঙ্গে সংলাপে আলোচনার মূল বিষয় থাকবে অবাধ সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এর বাইরে সেনাবাহিনী মোতায়েন, ইভিএম ভোটিং মেশিন ব্যবহারের বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে প্রস্তাব আসতে পারে। সেনাবাহিনীকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবেই ব্যবহারের পক্ষ আওয়ামী লীগ। অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতোই এ বাহিনীকে ব্যবহার করার পক্ষে দলটি। তাদের মত হলো নির্বাচন কমিশন যদি প্রয়োজন মনে করে তবে নির্বাচনে সেনাবাহিনী ব্যবহার করতে পারে। আর প্রয়োজন না হলে ব্যবহার করবে না। এছাড়া দলটির পক্ষ থেকে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহারের পক্ষে প্রস্তাব আসতে পারে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। এছাড়াও জানা গেছে, বিএনপির দাবি অনুযায়ী নির্বাচনে সহায়ক সরকার ব্যবস্থা এবং সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেয়ার যে দাবি করা হচ্ছে ইসির সঙ্গে সংলাপে এর চরম বিরোধিতা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে করা হতে পারে। তারা মনে করছেন সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান থাকবেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। এ বিষয়ে তারা ছাড় দিতে নারাজ। তারা মনে করে সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারই অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব পালন করবে। তাই তফসিল ঘোষণার পর সরকারের কাজ হবে রুটিন ওয়ার্ক। কোন প্রকল্প নেয়া হবে না। তফসিলের পর সব ক্ষমতা থাকবে নির্বাচন কমিশনের হাতে। কমিশনের প্রয়োজন অনুযায়ী সাপোর্ট দেবে সরকার। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কমিশন যা যা প্রয়োজন করতে পারবে। জানা গেছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ার বিষয় নিশ্চিত হওয়ায় সংলাপ নিয়ে আওয়ামী লীগ অনেকটা নির্ভর। তাই নির্বাচন সুষ্ঠু করতে অন্য যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ মনে করে সেসব বিষয়ই দলের পক্ষ থেকে প্রস্তাবাকারে তুলে ধরা হবে। দলীয় প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর আলোচনার বিষয়বস্তু চূড়ান্ত করা হবে বলে জানা গেছে। এছাড়া সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ, আরপিও বিধানসহ নির্বাচনী আইনের সংস্কার, সবার জন্য নির্বাচনে সমান সুযোগ তৈরিসহ বিভিন্ন প্রস্তাব ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে করা হতে পারে বলে জানা গেছে। বিএনপির প্রস্তাবনা এদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে ইসির সংলাপের বিষয়বস্তু চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রকাশ্যে না বললেও নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার ওপর তারা বেশি জোর দিয়েছে। জানা গেছে, নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার যেহেতু রাজনৈতিক আলোচনার বিষয় তাই তারা ইসির কাছে বিষয়টি তোলার পাশাপাশি সরকারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বোঝাপড়া করতে চায় যদিও তারা জানে বিষয়টি ইসির এখতিয়ার বহির্ভূত। এরপরও জনগণের সামনে এ বিষয়ে তাদের জোরালো অবস্থান তুলে ধরতেই আলোচনায় বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিএনপি চায় আগামী নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ করতে ইসির শক্তিশালী অবস্থান। কমিশনকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করার আহ্বান জানাবে তারা। এছাড়া নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ইসির কাছ থেকে আশ্বাস চায়। বর্তমান ইসি সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে যে উদ্যোগ নিয়েছে তারও বিরোধিতা করবে বিএনপি। তারা চায় অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেভাবে হয়েছে সে অনুযায়ী নির্বাচন করতে হবে। এছাড়াও নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি, বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখা, নির্বাচনের অন্তত এক মাস আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের সকল স্তরে রদবদল করা, আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) সংশোধন, প্রিসাইডিং অফিসারসহ ভোট কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনরত সকল কর্মকর্তাকে নির্ভয়ে দায়িত্ব পালনের নিশ্চয়তা প্রদান, ভোট কেন্দ্রে সকল প্রার্থীর এজেন্টের উপস্থিতি নিশ্চিত করা, দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকদের জন্য ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনের অবাধ সুযোগ রাখা, ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ না করা ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের মামলার নামে হয়রানি না করার বিষয় বিএনপির প্রস্তবে থাকছে। গত ২৪ আগস্ট থেকে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপ শুরু হয়েছে। এই সংলাপে বেশিরভাগ দলের পক্ষ থেকেই নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার বিষয় আলোচনায় উঠে এসেছে। এর বাইরে হা বা না ভোটের পক্ষে বিপক্ষে বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে। প্রবাসীদের ভোটাধিকারের বিষয়ে প্রায় রাজনৈতিক দল একই ভাষায় কথা বলেছে। জানা গেছে, এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির পক্ষ থেকে একই ধরনের প্রস্তাব আসতে পারে। এছাড়া ইসির পক্ষ থেকে আরপিওসহ নির্বাচনী আইন বাংলায় করার যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে দল দুটির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সমর্থন পাওয়া যেতে পারে বলে জানা গেছে। গত ৩১ জুলাই থেকে একাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সংলাপ শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। এখন পর্যন্ত সংলাপে সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলের আস্থা অর্জনে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এছাড়াও কালো টাকার ব্যবহার রোধ, নির্বাচনী প্রচারে ধর্মের অপব্যবহার রোধ করার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এছাড়াও সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে ভিন্ন ভিন্ন মত দেয়া হয়েছে। সংসদ ভেঙ্গে নির্বাচন করার বিষয়ে ভিন্ন মত এসেছে। তবে এ পর্যন্ত আলোচনায় যেসব মতই আসুক না কেন সংশ্লিষ্ট সবাই আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির আলোচনাকেই বেশি গুরুত্ববহ মনে করছে। এ কারণে আগামী ১৫ অক্টোবর বিএনপি এবং ১৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগের সঙ্গে যে সংলাপ রয়েছে সেদিকেই সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ।
×