ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ

বৃদ্ধাশ্রম : শেষ বয়সের ঠিকানা নাকি অভিশপ্ত জীবন

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ৪ অক্টোবর ২০১৭

বৃদ্ধাশ্রম : শেষ বয়সের ঠিকানা নাকি অভিশপ্ত জীবন

১৯৯০ সালে জাতিসংঘের সিদ্ধান্তে ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালিত হয়ে আসছে। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য ‘আগামীর পথে, প্রবীণের সঙ্গে।’ জাতিসংঘের কথায়, জীবনের সঙ্গে আমরা অতিরিক্ত বছর যোগ করতে পেরেছি কিন্তু বাড়তি বছরগুলোতে জীবন যোগ করতে পারিনি! প্রবীণদের প্রতি বৈষম্য সমাজ সংস্কৃতিতে একটি নিত্যকার নিদারুণ চ্যালেঞ্জ। কর্মক্ষেত্র, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা, সামাজিক সেবাসুবিধা, গণমাধ্যম, বিনোদন, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, নীতিনির্ধারণ এবং পরিবার ও রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রবীণরা হরহামেশাই বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এখন অনেকেই ওল্ডহোম বা বৃদ্ধদের জন্য আবাসিক ভবনে এসে আশ্রয় নেন। কেউ হয়ত স্বাধীনভাবে থাকার জন্য স্বেচ্ছায় চলে যান বৃদ্ধাশ্রমে, কেউ বা নিতান্ত বাধ্য হয়েই এই ভাগ্যকে বরণ করে নেন। এই ওল্ডহোম নিয়ে আজকের লেখাটি শুরু করতে চাই একটি বিখ্যাত জনপ্রিয় গানের কলি দিয়েÑ ‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা, এপার ওপার। নানা রকম জিনিস আর আসবাব দামী দামী সবচেয়ে কম দামী ছিলাম একমাত্র আমি। ছেলের আমার, আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।’ ওল্ডহোম বা বৃদ্ধনিবাস ধারণাটি পশ্চিমা বিশ্বের। বিগত শতকের শুরু থেকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক, ‘আধুনিক’ গতিশীল জীবনযাত্রার উত্তরণ এবং একান্ন পরিবারভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার ক্রমাগত ক্ষয়প্রাপ্তির প্রত্যক্ষ ফল এসব বৃদ্ধাশ্রম। পশ্চিমা বিশ্বে একদিকে ব্যাপক মুনাফা প্রত্যাশী পুঁজিবাদী ব্যবস্থা অনুৎপাদনশীল জনসংখ্যাকে রাখতে চায় মূল কাঠামোর বাইরে, অন্যদিকে ন্যায়ভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার দায় সারতে চায় সহজেই। এর সঙ্গে আছে তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। তাই শেষ জীবনের আনন্দাশ্রম হিসেবে বৃদ্ধাশ্রমই হলো তাদের কাছে সুন্দর-স্বাভাবিক ব্যবস্থা। আর এই ব্যবস্থা এখন তাদের সংস্কৃতিরই অংশ। সন্তানের বয়স যখন ১৮ পার হয়, তখন থেকেই শুরু হয় তার স্বাধীন স্বতন্ত্র কার্যক্রম আর পিতামাতার সংসার ছেড়ে নিজের জীবন গড়ে তোলার সংগ্রাম। আবার সুদীর্ঘ কর্মজীবন শেষে বৃদ্ধ বয়সে অবসরে সবাই নিজের মতো করেই স্বাধীনভাবে শেষ দিনগুলো কাটাতে চান, সন্তানের গলগ্রহ হয়ে থাকতে চান না। তাই কেউ কেউ নিজের মতো একাই থাকেন, কেউ বা ওল্ডহোমে সমবয়সী অন্য বয়স্কদের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করেন। জীবনের শুরুতে স্কুলে যাবার মতোই শেষ জীবনে বৃদ্ধাশ্রমে থাকা তাদের অনেকের কাছেই খুব স্বাভাবিক পরিণতি এবং তারা এ জন্য মানসিকভাবে তৈরিই থাকেন। আজকাল আমাদের দেশেও বয়স্কদের জন্য এমন নিবাস গড়ে তোলা হচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমে যা স্বাভাবিক জীবনযাত্রার উপকরণ, আমাদের দেশে তার বাস্তবতা ভিন্ন। এখানে এখনও ব্যক্তি থেকে পরিবারের গুরুত্বই বেশি। পূর্বের একান্নবর্তী ব্যবস্থা এখন খুব একটা না দেখা গেলেও অন্তত পিতামাতাকে নিজের পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হিসেবেই গণ্য করা হয়। ব্যক্তি স্বাধীনতার স্বাচ্ছন্দ্যের চেয়ে পরস্পরের সান্নিধ্যের শান্তিটুকুর মূল্য এখানে অনেক বেশি। তাই ছেলে বা মেয়ে স্বাবলম্বী হলেই পিতামাতাকে ত্যাগ করে নিজে একা একা চলবে বা পিতামাতাকে আলাদা রেখে নিজে আলাদা থাকবে, এটা প্রত্যাশিত নয়। এখানে যেমন সন্তান সাবালক হলেই পিতামাতার দায়িত্ব শেষ হয় না, তেমনি পিতামাতা বৃদ্ধ হলে এবং কর্মক্ষম না হলে, তার দেখাশোনা করার সামাজিক দায়ভার সন্তানের ওপরই বর্তায়। তাই পশ্চিমের ওল্ডহোম আমাদের জীবন ধারায় অনুপস্থিত থাকাটাই কাম্য ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এর বিপরীতটাই দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমের ন্যায় আমাদেরও জীবনযাত্রার ব্যস্ততা যেমন বাড়ছে, তেমনি ধীরে ধীরে একটি-দুটি করে বেশকিছু বৃদ্ধাশ্রমও গড়ে উঠছে। উন্নত বিশ্বের তুলনায় অনেক বেশি পারিবারিক বন্ধনসমৃদ্ধ সমাজ ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও এভাবে বৃদ্ধাশ্রম তৈরি হওয়া চিন্তার কারণ বৈকি। বৃদ্ধাশ্রম আমাদের দেশে সংস্কৃতির অংশ নয়, বরং কিছুটা প্রয়োজন এবং অনেকটাই মূল্যবোধের অবক্ষয়ের প্রকাশ। আমাদের এখানে যারা বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন, তাদের বেশিরভাগই যে স্বেচ্ছায় থাকেন, তা নয়। অনেকেই সন্তানের অবহেলা বা অযতেœর কারণে, কখনও কখনও দুর্ব্যবহারের শিকার হয়ে আশ্রয় নেন এসব নিবাসে। আজ যারা বৃদ্ধ, তারা নিজেদের জীবনের সকল সময়, ধনসম্পদ বিনিয়োগ করেছিলেন সন্তানের জন্য, নিজের জন্য রাখেননি কিছুই। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের কাছ থেকে এর একটি ক্ষুদ্র অংশও তারা পাচ্ছেন না। কখনও দেখা যায়, সন্তান তার নিজের পরিবারের খরচ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছে, তাই পিতামাতাকে মনে করছে বোঝা। নিজে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে একটু ভাল থাকার জন্য বাবা-মার ঠাঁই করে দিচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রমে। আবার এমনও দেখা যায় যে, সন্তানের টাকা-পয়সার অভাব নেই, কিন্তু পিতামাতাকে নিজের কাছে রাখার প্রয়োজনবোধ করছেন না, বা বোঝা মনে করছেন। ভাবছেন, ‘এরা আসলে বুড়া-বুড়ি’, হয় নিজেই পাঠিয়ে দিচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রমে, নয়ত অবহেলা আর দুর্ব্যবহার করে এমন অবস্থার সৃষ্টি করছেন যেন তাদের পিতামাতা নিজেরাই সরে যান তার সাধের পরিবার থেকে। কেউ কেউ আবার এমনও বলেন, তার টাকার অভাব না থাকলেও সময়ের অভাব আছে, পিতামাতাকে দেখভাল করা বা তাদের সঙ্গে কথা বলার মতো পর্যাপ্ত সময় তার নেই। তাই বাবা বা মা একা একা নির্জন থাকার চেয়ে বৃদ্ধনিবাসে অন্যদের সঙ্গে একত্রে সময় কাটানোই তাদের জন্য ভাল। একবার বৃদ্ধনিবাসে পাঠাতে পারলেই যেন সকল দায়মুক্তি। এভাবে নানা অজুহাতে পিতামাতাকে দূরে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। অনেক নামীদামী বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, চাকরিজীবী যারা একসময় খুব বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন, বৃদ্ধ বয়সে এসে নিজের সন্তানের দ্বারাই অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়ে বৃদ্ধাশ্রমের স্থায়ী বাসিন্দা হতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেক সন্তান বা আত্মীয়স্বজন আর তাদের কোন খবরও নেন না। তাদের দেখতে আসেন না, এমনকি প্রয়োজনীয় টাকা-পয়সা বা জিনিসপত্রও পাঠান না। বাড়িতে কোন অনুষ্ঠানে বা ঈদের আনন্দের সময়ও পিতামাতাকে বাড়িতে নেন না। এমনও শোনা যায়, অনেকে পিতা বা মাতার মৃত্যুশয্যায় বা মারা যাবার পরও শেষবার দেখতে যান না। বৃদ্ধনিবাসের কর্তৃপক্ষই কবর দেয়া বা যে কোন শেষকৃত্য সম্পন্ন করার সকল ব্যবস্থা করেন, অথচ তার প্রিয় সন্তানরাই কোন খবর রাখেন না। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, অনেকের জন্য বৃদ্ধনিবাস আসলেই অতি প্রয়োজনীয় বিকল্প। অনেক বৃদ্ধ আছেন যার সন্তান নেই এমনকি নেই কোন নিকটাত্মীয়, যার কাছে তিনি শেষ দিনগুলো কাটাতে পারেন। আবার অনেকের সন্তান থাকলেও দেখা যায়, তার আর্থিক সামর্থ্য নেই পিতামাতার ভরণপোষণ করার। বৃদ্ধাশ্রমে তাদের জীবন আরেকটু আনন্দময় হবে চিন্তা করেই হয়ত তারা বুকে পাথর বেঁধেই পিতামাতাকে সেখানে পাঠিয়ে দেন। কারও কারও সন্তান চাকরির কারণে অবস্থান করেন দেশের বাইরে এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। পিতামাতাকে বাইরে নেয়া সম্ভব হয় না এবং তারাও বিদেশে যেতে চান না। ফলে, তার সন্তানরা টাকা-পয়সা পাঠাতে পারলেও পিতামাতাকে সময় দেয়া আসলেই সম্ভব হয় না। এ ছাড়া অনেকেই জীবন সায়াহ্নে এসেও স্বাধীনচেতাই থাকতে চান, সন্তানের ওপরে নির্ভরশীল থাকাকে এক ধরনের বোঝা মনে করেন, তাই নিজেরা স্বেচ্ছায় বৃদ্ধনিবাসে চলে যান। তাদের জন্য বৃদ্ধনিবাস এক চমৎকার ব্যবস্থা। থাকা খাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে, শেষ জীবনের অবসর সময়টাকে উপভোগের সুযোগ করে দেয় এসব বৃদ্ধাশ্রম। এখানে যারা থাকেন, তারা সবাই মিলে একটা নতুন পরিবার গড়ে তোলেন। সমবয়সীদের সঙ্গে হেসে খেলে, স্মৃতিচারণ করে তাদের সময়টা ভালই কেটে যায়। আবার প্রয়োজনমতো নিজের পরিবারের সঙ্গেও দেখা সাক্ষাত করেন, নানা পালা-পার্বণে সন্তান নাতি-নাতনিদের সঙ্গে আনন্দমুখর সময় কাটান। বাস্তবতার নিরিখে বিচার করলে দেখা যায়, বৃদ্ধাশ্রম অবহেলিত বৃদ্ধদের জন্য শেষ আশ্রয়স্থল। তাদের সারাজীবনের অবদানের যথার্থ স্বীকৃতি, শেষ সময়ের সম্মান ও নিরাপত্তা দেয়া হয় এসব বৃদ্ধাশ্রমে। এখানে তারা নির্ভাবনায়, সম্মানের সঙ্গে, আনন্দের সঙ্গে বাকি দিনগুলো কাটাতে পারেন। প্রয়োজনে অনেক বৃদ্ধাশ্রমে চিকিৎসারও সুন্দর ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সকল প্রাপ্তির মাঝেও এখানে যা পাওয়া যায় না, তা হলো নিজের পরিবারের সান্নিধ্য। বৃদ্ধ বয়সে মানুষ তার সন্তান, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে একত্রে থাকতে চান আর তাদের সঙ্গেই জীবনের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে চান। সারাজীবনের কর্মব্যস্ত সময় পার করার পর অবসরে তাদের একমাত্র অবলম্বন এই আনন্দটুকুই। বলা যায়, এর জন্যই মানুষ সমগ্র জীবন অপেক্ষা করে থাকে। বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় পাওয়া যায়, সঙ্গী-সাথী পাওয়া যায়, বিনোদন পাওয়া যায়, কিন্তু শেষ জীবনের এই পরম আরাধ্য আনন্দটুকু পাওয়া যায় না। আর তাই তারা এই সময়টাতে প্রবল মানসিক যন্ত্রণা আর ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন। নেহায়েত অনন্যোপায় হয়ে, ইচ্ছার বাইরে যারা বাবা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠান, তাদের কথা ভিন্ন। কিন্তু যারা নিজের পর্যাপ্ত সম্পদ ও সময় সুযোগ থাকার পরও শুধু অবহেলা আর অবজ্ঞা করে পিতামাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়ে তাদের ভুলে যান আর খোঁজখবর রাখার প্রয়োজন অনুভব করেন না, তাদের স্মরণ রাখা দরকার যে, এমন সময় তাদের জীবনেও আসতে পারে। যে বাবা মা এক সময় নিজে না খেয়েও সন্তানকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন, তারা আজ কোথায় কেমন আছেন সেই খবর নেয়ার সময় যাদের নেই, তার নিজের সন্তানও হয়ত একদিন তার সঙ্গে এমনই আচরণ করবে। বিভিন্ন উৎসবে, ঈদের দিনে বা পূজাপার্বণে যখন তারা তাদের সন্তানদের কাছে পান না এমনকি একটি ফোনও পান না, তখন অনেকেই বৃদ্ধাশ্রমে বসে বসে নীরবে অশ্রুপাত করেন আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। এমনকি সেই সন্তানকে অভিশাপ দিয়ে কামনা করেন যে, সন্তান তার সঙ্গে যে আচরণ করেছে, ভবিষ্যতে তার ছেলের সন্তানও যেন তাদের সঙ্গে একই আচরণ করে। ওপরের গানের শেষের কলির মতো Ñ ‘খোকারও হয়েছে ছেলে, দু’বছর হলো। আর তো মাত্র বয়স পঁচিশ, ঠাকুর মুখ তোলো। এক শ’ বছর বাঁচতে চাই এখন আমার সাধ পঁচিশ বছর পরে খোকার হবে ঊনষাট। আশ্রমের এই ঘরটা ছোট, জায়গা অনেক বেশি। খোকা আমি দু’জনেতে থাকব পাশাপাশি। সেই দিনটার স্বপ্ন দেখি ভীষণ রকম। মুখোমুখি আমি, খোকা আর বৃদ্ধাশ্রম।’ এখন সময় এসেছে এটা অনুধাবন করার, আমরা প্রবীণদের প্রতি বৈষম্য করছি এবং তা আর চলতে দেয়া যায় না। যারা আজ নবীন, তারাও একদিন প্রবীণ হবেন এবং এই নিয়তি তাদের জন্যও আসবে, এটি ভেবে আমাদের প্রবীণ বাবা-মায়ের প্রতি যতœ নেয়া জরুরী। তাদের অধিকার রয়েছে আমাদের ভালবাসা পাবার। লেখক : অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×