ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মগের মুলুকের রোহিঙ্গারা

প্রকাশিত: ০৪:১২, ৪ অক্টোবর ২০১৭

মগের মুলুকের রোহিঙ্গারা

মিয়ানমারের উত্তর-পূর্ব দিকে আরাকান পর্বতের পশ্চিমে রাখাইন রাজ্য বা প্রদেশ অবস্থিত। এই অঞ্চলে রাখাইন মুসলিমদের (সংখ্যাগরিষ্ঠ) ও হিন্দুদের (স্বল্প সংখ্যক) বাস। এরা কালক্রমে রোহিঙ্গা নামে অভিহিত ও পরিচিত হয়ে এসেছেন। এরা হাজার বছর ধরে এই এলাকায় বসবাস করে আসছিলেন। ভাষা ও সংস্কৃতিতে এদের সঙ্গে মগদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পূরক উপকরণ হিসেবে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এলাকার ভাষা, বেশভূষা ও চালচলন। কিন্তু এরা কখনই বাংলাদেশের বা তার আগের পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী বা নাগরিক ছিলেন না। এদের বাইরে, বিশেষত দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে স্বল্প সংখ্যক বৌদ্ধরা, রাখাইন বৌদ্ধ পরিচিতিতে বাস করেন। ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে ১০ লাখ রোহিঙ্গাদের বাস বলে বিদিত হয়। ১৯৩৫ সালে বার্মার শাসন যখন ভারতবর্ষের শাসন থেকে পৃথক হয়ে যায়, তখন তৎকালীন ইংরেজ শাসকরাও এই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রেক্ষিতে রাখাইন রাজ্য বা প্রদেশকে বার্মার অংশ এবং সেখানে বসবাসরত রোহিঙ্গাসহ সকলকে বার্মার বা আজকের মিয়ানমারের অধিবাসী ও নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে যান। রাখাইন রাজ্য তেল, গ্যাস, মূল্যবান পাথর ও অন্যান্য খনিজ দ্রব্য এবং বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ। এখানকার ভূমি উর্বর, মৎস্য সম্পদও বিশাল। এসবের উন্নয়ন ও ব্যবহার বাড়ানোর জন্য তৎকালীন ব্রিটিশরা তেমন কোন পদক্ষেপ নেয়নি। সাম্প্রতিককালে প্রধানত চীনের সহায়তায় এই এলাকার সম্পদ আহরণের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে অস্ত্রের বলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন। তিনি ও তার সশস্ত্র সহযোগীরা দেশের ৮টি প্রধান উপজাতীয় এলাকায় গোষ্ঠীগত সংহতির বলে তাদের আধিপত্য সংরক্ষণ করার উদ্দেশ্যে রাখাইন এলাকার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেন। ফলত রাখাইন থেকে ক্রমান্বয়ে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রাম এলাকায় নিরাপদ আশ্রয় লাভের উদ্দেশ্যে নাফ নদী অতিক্রম করে বসতি স্থাপন করেন। কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা ভারতের মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও মনিপুরে আশ্রয় নেন। এভাবে তাদের নাগরিকত্ব হরণ এবং পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় গ্রহণের প্রতিকূলে পাকিস্তানের তৎকালীন স্বৈরশাসক আয়ুব খান কোন প্রতিবাদ করেননি। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাখাইন থেকে উদ্বাস্তুদের আগমন বন্ধ করার লক্ষ্যে ভারতের নাগাল্যান্ড, মিজোরাম ও মনিপুর রাজ্য কর্তৃক অনুসরণীয় রোহিঙ্গা সম্পর্কিত কার্যক্রমের সঙ্গে বাংলাদেশের নীতি সমন্বিত করে নির্ধারণ এবং তৎকালীন মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে রোহিঙ্গাদের বার্মার নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতির ভিত্তিতে তাদের বাংলাদেশ ও ভারত আগমন বন্ধ করতে নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ের পর এই নির্দেশ অনুযায়ী তেমন কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এর ফলে ১৯৭৮, ১৯৯১ ও ১৯৯২ সালে মিয়ানমারে সেখানকার সামরিক সরকার কর্তৃক অনুসৃত দমননীতির ফলশ্রুতিতে নাফ নদী অতিক্রম করে দফায় দফায় রোহিঙ্গারা চট্টগ্রামের কক্সবাজার এলাকায় আশ্রয় নিতে থাকেন। এই সময়েও জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও খালেদা এই বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে কোন ফলপ্রসূ আলোচনা করা বা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে কোন কার্যক্ষম পদক্ষেপ নেননি। ১৯৯৩ সালে তৎকালীন বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে একটি একপেশে চুক্তি হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী কেবল মাত্র মিয়ানমার সরকারের শনাক্তকরণের ভিত্তিতে অল্প সংখ্যক রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে যেতে সক্ষম হন। এই সময়ে স্বল্প সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তান ও সৌদি আরবে যেতেও সমর্থ হন। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার রোহিঙ্গাদের রাখাইন থেকে বিতাড়িতকরণের প্রতিবাদ করে এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত সকল রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার দাবি জোরালোভাবে উত্থাপন করে। ২০০২ থেকে শুরু করে ২০০৮ পর্যন্ত এক্ষেত্রে উদ্ভূত সমস্যা সম্পর্কে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকার তাদের তথাকথিত পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির মোড়কে বা বাহানায় কোন পদক্ষেপ নেয়নি। ২০১২ সালে আবারও নিরাপত্তা বাহিনী ও রাখাইন বৌদ্ধদের নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়ে ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ তীব্র প্রতিবাদ জানায়। হিউম্যন রাইটস ওয়াচসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানসমূহ মিয়ানমার সরকারের এরূপ তৎপরতাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসাবে বিদিত করে। ফলত মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশ থেকে তাদের ভাষায় যথার্থ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়। এই সময়ে স্বল্প সংখ্যক উগ্রবাদী রোহিঙ্গা মৌলবাদী পাকিস্তানী আতাউল্লাহর নেতৃত্বে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (বা আরসা) নামে সশস্ত্র ও সন্ত্রাসী প্রতিরোধ সংস্থা প্রতিষ্ঠিত করে। পাকিস্তান এই সংস্থাকে অস্ত্র এবং সৌদি আরব অর্থ দিয়ে সহায়তা করে বলে জানা যায়। ২০১৭ এর জুলাই মাসের দিকে এই সন্ত্রাসী ও সশস্ত্র সংস্থা রাখাইন রাজ্যের ৩০টি পুলিশ ফাঁড়ি ও একটি সামারিক ঘাঁটি জ্বালিয়ে দেয় এবং সেখানে কর্মরত অধিকাংশ অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী ও মগ সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা প্রহরীদের হত্যা করে। প্রতিক্রিয়ায় এ বছরের আগস্ট মাসে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী (বা তাতসাদাও) রাখাইনবৌদ্ধ উগ্রবাদীদের নিয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর নারকীয় অত্যাচার শুরু করে। আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির সন্ত্রাসীদের যথা আইনে দমন না করে মিয়ানমারের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা ও তাদের বাড়ি পোড়ানো, নারীদের ধর্ষণ এবং ধনসম্পদ লুণ্ঠনে নির্মমতম অত্যাচারীর খ—গ কৃপাণ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পিতার সামনে কন্যাকে, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে, পুত্রের সামনে মাকে ধর্ষণ, মার সামনে পুত্রকে, স্ত্রীর সামনে স্বামীকে হত্যাসম নারকীয় অপরাধের হোতা হয়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এই শতাব্দীর নিকৃষ্টতম নরপিশাচের পর্যায়ে নেমে আসে। ফলত ৩ সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। একটি পরিবারের গড় সংখ্যা ৫ জন এবং পরিবার প্রতি ১ জন পুরুষ হত্যা করা হয়েছে বলে ধরলে এই অত্যাচারে ন্যূনপক্ষে ১ লাখ রোহিঙ্গা এই সময়ে খুন হয়েছে বলে বলা চলে। এই হিসাবের আলোকে সুস্পষ্টভাবে বলা চলে যে, এই নিধনযজ্ঞ অব্যাহত থাকার ফলশ্রুতিতে রাখাইনের অবশিষ্ট ৪ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিলে এবং প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গা তেমনি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হাতে নিহত হলে রোহিঙ্গারা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী হিসেবে মিয়ানমার থেকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। মানবতার এই বিশাল ও নিষ্ঠুর বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে দেশে প্রাচুর্যের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও মানবতার সূত্র অনুযায়ী যে ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়ে নাফ নদী অতিক্রম করতে থাকেন, জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার মানবতা বোধে সচেতন থেকে তাদেরকে এদেশে প্রবেশ করতে ও আশ্রয় দেয়। মানবতার এই নির্মম বিপর্যয়ের সময়ে শেখ হাসিনা ‘মানবতার মা’ হিসেবে সারা পৃথিবীর কাছে নিজেকে তুলে ধরেন। বাংলাদেশ সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে এসব রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ার কার্যক্রমকে জাতীয় গর্ব হিসেবে বৈশিষ্ট্যম-িত করেন। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মম অত্যাচারের প্রেক্ষিতে আমাদের জাতীয় সংসদে সেপ্টেম্বর ১১-এ মানবতার বিপর্যয়ের নিরিখে রোহিঙ্গা সমস্যা আলোচিত হয়। আলোচনার উপসংহারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক্ষেত্রে বাংলাদেশ কর্তৃক অবলম্বনীয় নীতি হিসেবে বলেন যে, (ক) মানবতার মানদ-ে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে ও দেবে; (খ) মিয়ানমার সরকারকে এ সমস্যা সমাধানে রোহিঙ্গাদের সসম্মানে এবং যথার্থ নাগরিক মর্যাদা দিয়ে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে হবে; (গ) এই লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমার সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করতে হবে এবং (ঘ) রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার প্রত্যাবর্তন, পুনর্বাসন ও নাগরিকত্ব নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি নিরাপদ বলয় বা এলাকা সৃষ্টি ও প্রশাসিত করতে হবে। আলোচনার পর জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক উল্লিখিত এসব পদক্ষেপ পূর্ণাঙ্গভাবে সমর্থন করা হয়। এই প্রস্তাব সংসদে গৃহীত হওয়ার পর বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশের নেতারা বাংলাদেশের সমর্থনে এগিয়ে আসেন। ভারত বাংলাদেশের পক্ষে এই ইস্যুতে সবসময় থাকবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। যুক্তরাজ্য রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান সমর্থন করে এবং সুস্পষ্টভাবে বলে যে, মিয়ানমার সরকারকে বাংলাদেশে আগত সকল শরণার্থী রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তারা রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার বন্ধকরণে চাপ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে আগের চুক্তি অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দেয়া বন্ধ করে দেয়। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রো রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনকে গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করে এই সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারকে সত্বর এগিয়ে আসতে আহ্বান জানান। জাতিসংঘের তরফ হতে রোহিঙ্গাদের ওপর আরোপিত এই নির্যাতন পাঠ্যপুস্তকে সংজ্ঞায়িত গণহত্যা বলে বিশেষায়িত করা হয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচারের জন্য মিয়ানমার সরকারকে দায়ী করে সত্বর তা বন্ধ করার জন্য প্রস্তাব গ্রহণ করে। জাতিসংঘের মহাসচিব রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে দ্রুততম পদক্ষেপ নেয়ার জন্য নিরাপত্তা পরিষদ ও সকল দেশকে আহ্বান জানান। চলবে... লেখক: সাংসদ ও সাবেক মন্ত্রী
×