ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

স্বপ্নের অভিযাত্রী এলেন মাস্ক

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৩ অক্টোবর ২০১৭

স্বপ্নের অভিযাত্রী এলেন মাস্ক

বর্তমান বিশ্বের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতে অন্যতম সুপরিচিত নাম হলো এলেন মাস্ক। আপনি যদি বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বের খবর রাখেন তবে দেখবেন সপ্তাহের দুই থেকে তিন দিনের মতো কোন না কোন খবরের শিরোনামে আছেন এলেন মাস্ক, তিনি একাধারে উদ্যোক্তা, প্রকৌশলী, উদ্ভাবক ও বিনিয়োগকারী। দক্ষিণ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত এলেন মাস্কের জন্ম ২৮ জুন, ১৯৭১। শৈশব ও স্কুল জীবন খুব একটা ভাল কাটেনি। কিন্তু শেখার আগ্রহ ছিল প্রচুর। দিনে ১০ ঘণ্টার উপরে বই পড়তেন। পড়ার ধাত এতোই বেশি ছিল যে লাইব্রেরীর সব বই শেষ করে পুরো এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাই পড়ে ফেললেন। মাস্ক একটা মানুষকে কম্পিউটারের সঙ্গে তুলনা করেন। মানুষের হার্ডওয়ার হলো তার শরীর আর মাথা। সফটওয়ার হলো তার জ্ঞান আহরণ ক্ষমতা, স্বভাব, ব্যক্তিত্ব। আর শেখাটা হচ্ছে সহজ ভাষায় মাথায় তথ্য আর বিচার-বিশ্লেষণ করে মাথায় ঢুকিয়ে রাখা। ক্লাসরুম শিক্ষার প্রতি তাই তার প্রধান অভিযোগ ছিল যে এটার ‘ডাউনলোড স্পিড অসম্ভব রকমের কম!’ তার বেশিরভাগ শিক্ষাই বাসায় বসে পড়ে। নয় বছর বয়সে যখন প্রথম কম্পিউটার হাতে পান, সেটির মেমরি ছিল ৫ কিলোবাইট । ‘ঐড়ি ঃড় চৎড়মৎধস’ গাইড মাত্র তিনদিনে আত্মস্থ করে ছোট্ট মাস্ক একটা ভিডিও গেম বানিয়ে ফেললেন ‘ব্লাস্ট’ নামে, যেটা তার মতে- ফ্ল্যাপি বার্ডের চেয়ে বহুগুণে ভাল। ১৯৮৩ সালে গেমটি ৫০০ ডলারে কিনে নিয়েছিল একটি কম্পিউটার ম্যাগাজিন যখন মাস্কের বয়স মাত্র ১২। মায়ের কানাডার নাগরিকত্বের সুযোগে মাস্ক ১৯ বছর বয়সে আফ্রিকা ছেড়ে কানাডা চলে আসেন। এবং কিছু বছর পর কলেজ পরিবর্তন করে আমেরিকার পেন্সিলভানিয়া ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। এলেন মাস্কের আর একটি পরিচয় হচ্ছে, তিনি টেসলা মটরসের প্রধান নির্বাহী ও মালিক। মার্কিন গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি মডেল এস নামের গাড়িটি ৯০ হাজার ইউনিট বিক্রি করেছে। গাড়ি ছাড়াও রকেট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্পেস এক্সের প্রধান নির্বাহী ও প্রতিষ্ঠাতা মাস্ক। ইন্টারনেটভিত্তিক অর্থ আদান-প্রদান সেবাপ্রদানকারী ওয়েবসাইট পেপালের সহপ্রতিষ্ঠাতা তিনি। পেপেল হচ্ছে পৃথিবী বিখ্যাত অনলাইন মানি ট্র্যান্সেকশন কোম্পানি। ২০১২ সালের ১৫ জুন ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সমাবর্তনে তিনি বক্তব্য প্রদান করেন। তার বক্তব্যের পুরো অংশ জুড়ে উঠে আসে সাফল্যের কাহিনী। তিনি বলেন, আমি ভাবছিলাম, আপনাদের ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় এমন কী বললে আপনাদের উপকার হবে। আমি এখন যে অবস্থানে আছি, তার কথা আপনাদের শোনালে, সেই জীবনের গল্প আপনাদের জন্য অনুপ্রেরণার হবে। কী শিক্ষণীয় আছে সেই গল্পে? তরুণ বয়সে আমাকে যখন সবাই জিজ্ঞেস করত, আমি কী হতে চাই। তখন আমি জানতামই না, বড় হয়ে আমি কী হতে চাই। তার পরও ভাবতাম, কোন কিছু উদ্ভাবনের মতো অদ্ভুত কাজ আর হতে পারে না। আমার এই অদ্ভুত ভাবনার পেছনের কারণ ছিল, বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর লেখক আর্থার সি ক্লার্ক। তাঁর লেখায় জেনেছিলাম, ‘একটি পরিপূর্ণ উন্নত প্রযুক্তি সহজেই জাদু থেকে আলাদা করা যায়।’ এখন আকাশে ওড়া সম্ভব। আপনি যদি ৩০০ বছর আগে ফিরে গিয়ে আকাশে ওড়ার গল্প কাউকে বলতেন, তা হলে আপনাকে নির্ঘাত আগুনে পোড়ানো হতো। ইন্টারনেট এমনই একটি মাধ্যম, যা দিয়ে আপনি সহজেই অনেক দূরের জিনিস দেখতে পারেন, যোগাযোগ করতে পারেন। নিমেষেই চোখের পলকে প্রবেশ করতে পারেন পৃথিবীর তথ্যের জ্ঞানভা-ারে। ইন্টারনেটকে আপনি জাদুই বলতে পারেন। পৃথিবী কিভাবে কাজ করে, অর্থনীতি কী করে এবং সাধারণ মানুষকে একসঙ্গে আনার কৌশল জানতে হবে। এগুলো দিয়েই তৈরি হবে আপনার উদ্ভাবন। এককভাবে আপনার পক্ষে এখন কোন কিছু করা প্রায়ই অসম্ভব। ১৯৯৫ সালে আমার চিন্তা ছিল, ইন্টারনেট নামের নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করার চেষ্টা করা। সফলতা আসবে কি না, আমি জানতাম না। কারণ, সফলতা বেশ কঠিন একটি চক্কর। আপনার হাতে সে ধরা দেবে কি না, আপনি কখনোই জানবেন না। আমি শুধু প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হতে চেয়েছিলাম। সে জন্য আমি যা করেছিলাম, তা আপনাদের কখনোই অনুকরণের পরামর্শ দেব না। আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড্রপ আউটের সিদ্ধান্ত নিই এবং ইন্টারনেট নিয়ে কাজ শুরু করি। এ রকমই আমার একটা কাজ ছিল, ইন্টারনেটে অর্থ আদান-প্রদানের জন্য পেপাল প্রতিষ্ঠা। এখন পেপাল অনেক জনপ্রিয় হলেও শুরুটা কিন্তু এমন ছিল না। প্রথমে আমরা সব ধরনের আর্থিক সেবা এই সাইটের মাধ্যমে দিতে শুরু করলাম। কেউ আমাদের কথা শুনল না। আমরা তখন অনেক সময় নিয়ে সবাইকে ই-মেইলের মাধ্যমে লেনদেনের কথা বোঝালাম। সেই চেষ্টার ফল আপনারা এখন পেপালের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন। পেপালের পর আমি চিন্তা করেছিলাম, কোন সমস্যাগুলো মানুষের ভবিষ্যতের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। মানুষের জীবনকে এক পৃথিবীকেন্দ্রিক না রেখে বহু গ্রহকেন্দ্রিক করলে ভবিষ্যতের মানুষের উপকার হবে। এ জন্য আমি উদ্যোগ নিলাম স্পেসএক্স প্রতিষ্ঠার। আমি মঙ্গলে অবতরণ করার কথা না ভবে সহজলভ্য মহাকাশ যোগাযোগ ব্যবস্থায় মনোযোগ দিলাম। সেই থেকে শুরু স্পেসএক্সের। আমি একা কিছুই করতে পারব না। একাকী কঠিন পথ পার হওয়া বেশ হতাশাজনক। আত্মপ্রত্যয়ী কয়েকজন মানুষ নিয়ে আমার দল গঠন করলাম। যাত্রা শুরু করলাম দুর্জয়কে জয় করার। ২০০৮ সালে আমরা প্রথম রকেট উৎক্ষেপণ করি। আমরা সফল হই। না হলে সর্বনাশ ছিল। কারণ, সব টাকা-পয়সা আমরা বিনিয়োগ করে ফেলেছিলাম। আমাদের সব টাকার বিনিয়োগের ফলাফল রকেটটি যখন পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছাল, তখন আমরা বিশ্বজয়ের সাধ পেয়েছিলাম। গুরুত্বসহকারে মহাকাশে গমন নিয়ে কাজ শুরু করলাম। আমরা ফ্যালকন ১ নভোযানকে আকাশে পাঠাতে সক্ষম হই। সবশেষে ড্রাগন নভোযান নির্মাণে মনোযোগ দিই।
×