ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের সিদ্ধান্ত

রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার প্রতিশ্রুতি মিয়ানমারের

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ৩ অক্টোবর ২০১৭

রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার প্রতিশ্রুতি মিয়ানমারের

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে মিয়ানমার। এছাড়া রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই গ্রুপ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে একযোগে কাজ করবে। রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে ঢাকা সফররত মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের বৈঠকে সোমবার এই সিদ্ধান্ত হয়। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় দুই ঘণ্টাব্যাপী এই বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী ও পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক। আর মিয়ানমার প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন দেশটির স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সুচির দফতরের মন্ত্রী কিয়া তিন্ত সোয়ে। বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের বলেন, অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা হয়েছে এবং সেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে মিয়ানমার। এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সার্বিক তত্ত্বাবধানে দুই দেশ একটি ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠনের প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা উভয়ে সম্মত হয়েছি। এই জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ কিভাবে কি কাজ করবে- সেটা আমরা বাংলাদেশও ঠিক করব, ওরাও ঠিক করবে। সম্মতিটা হয়েছে এই আলোচনায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার জন্য বৈঠকে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলকে ওই চুক্তির খসড়াও হস্তান্তর করা হয়েছে। বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয়েও ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ পুনর্ব্যক্ত করেছে বলে মাহমুদ আলী জানান। পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, এ বিষয়ে আরও আলোচনার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শীঘ্রই মিয়ানমার সফরে যাবেন। আমরা যেটা বলে আসছি প্রথম থেকে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে আমরা এই সমস্যার সমাধান করতে চাই। দুই পক্ষই তাতে একমত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া কবে শুরু হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটা সভা দিয়েতো সব সমাধান হবে না। জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপটা তৈরি করতে হবে। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে দেব, ওরা ওদের পক্ষ থেকে দেবে। এটা খুব তাড়াতাড়ি করেছি। যে বিষয়গুলো বাকি রয়েছে, আলোচনার মাধ্যমে সেগুলোর সমাধান করা যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ কবে নাগাদ গঠন হবে জানতে চাইলে তিনি শুধু বলেন, খুব শীঘ্রই হবে। এই বৈঠকের মধ্যে দিয়ে মিয়ানমার সময়ক্ষেপণ করছে কিনা সে বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আলোচনার আগেই যদি নাকচ করে দেন, তবে আলোচনা হবে না। অপেক্ষা করতে হবে। আমরা আশাবাদী। আনান কমিশনের রিপোর্টের বিষয়টি আলোচনায় তোলা হয়েছিল বলেও জানিয়েছেন মন্ত্রী। মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনীর দমন অভিযানের মুখে গত ২৫ আগস্ট থেকে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তারা বলছেন, সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে মানুষ মারছে। রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। মিয়ানমারের নেত্রী সুচি সেনাবাহিনীর এই অভিযানকে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই হিসেবে বর্ণনা করলেও জাতিসংঘ একে চিহ্নিত করেছে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি দেখতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে সেখানে যেতে দিচ্ছে না দেশটির সরকার। এমনকি সেখানে আইসিআরসি ছাড়া অন্য কোন সংস্থাকে ত্রাণ দিতেও বাধা দেয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় তিনি বলেন, রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে রোহিঙ্গাদের উপর যে সহিংসতা হয়েছে তা মধ্যাঞ্চলেও বিস্তৃত হতে পারে এবং সেখানে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। পাঁচ দশকের বেশি সময় সামরিক শাসনে থাকা মিয়ানমারে গত বছর সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সুচির দল ক্ষমতায় এলেও এখনও দেশটির স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক মন্ত্রণালয় দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে। সম্প্রতি মিয়ানমার ঘুরে আসা ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, আউং সান সুচি সব রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নিতে চান বলে তাকে আশ্বস্ত করেছেন। সুচি একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে আছেন এবং তিনি আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ চাপের মধ্যে একটি সঠিক পথ বের করার চেষ্টা করছেন। এদিকে মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী উ উইন মিত আয়ে রাখাইনের মংডু এলাকায় যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন ও পুনর্বাসন শুরু করার ঘোষণা দিয়েছেন বলে মিয়ানমারের ইরাবতী পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন ও পুনর্বাসনের জন্য দুই বিলিয়ন কিয়াটের একটি কর্মসূচী নেয়া হয়েছে, যাতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যকার ১৯৯৩ সালের প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় শরণার্থীদের নিবন্ধন করা হবে। মংডুর দার গি জার গ্রামে পুনর্বাসনের আগে তাংপিও লেতওয়ে ও না খুয়ে ইয়া গ্রামে তাদের নিবন্ধন হবে। মিয়ানমারের শ্রম, অভিবাসন ও জনসংখ্যা মন্ত্রণালয়ের পার্মানেন্ট সেক্রেটারি উ মিন্ট কেইং ওই দিন ইরাবতীকে বলেন, দেশে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য যাদের মনোনীত করা হবে তাদের ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) দেয়া হবে। রোহিঙ্গা স্বীকৃতি না থাকায় এই মুসলিম জনগোষ্ঠী ওই এনভিসি নিতে আপত্তি জানিয়ে আসছিল।
×