ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সেই ভাসানচর যেখানে হবে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ৩ অক্টোবর ২০১৭

সেই ভাসানচর যেখানে হবে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন

গিয়াস উদ্দিন ফরহাদ/ ইসমাইল হোসেন কিরণ নোয়াখালী থেকে ॥ নির্জন চরে আলোর ঝলকানি, ইট-পাথরের স্তূপ, সুসজ্জিত হেলিপ্যাড, ঘাটে সদ্য নির্মিত জেটি, চারদিকে কেওড়াবাগান মাঝখানে নৌবাহিনীর অর্ধশতাধিক সদস্যের কর্মব্যস্ততা, জনমানবহীন গহিন চর যেন অন্যরকম হয়ে উঠেছে ধাপে ধাপে। নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার পূর্বদিকে অবস্থিত ভাসানচরের সদ্য চিত্র এটি। এখানে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের চিন্তাভাবনা করছে সরকার। এর ফলে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক টিম চরটি পরিদর্শন করছে। এক সপ্তাহে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালসহ উচ্চ পর্যায়ের একাধিক টিম এ চর পরিদর্শন করে। এখানে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের উদ্দেশে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্ম পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করে তারা। ভাসানচরের নাম আগে ছিল ঠেঙ্গারচর। বন বিভাগের নথিতে জালিয়ারচর। নৌবাহিনী চরে কার্যক্রম শুরুর পর সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তে চরটির নাম করা হয় ভাসানচর। নৌবাহিনী ভাসানচর নাম দিয়ে চরে একাধিক সাইনবোর্ড স্থাপন করেছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী মগদের অমানবিক নির্যাতনে আগে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ৫ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে এবার ইতোমধ্যে যুক্ত হয়েছে আরও ৫ লাখ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়েছে। এতে বর্তমান কক্সবাজারের উখিয়ায় চরম মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয়ায় সরকার রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছে। বছরের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের কথা আলোচনায় আসে। সে মোতাবেক প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব ও নৌবাহিনীর একটি টিম ভাসানচর পরিদর্শন করে। তখন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হাতিয়া উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে এক আলোচনায় চরে রোহিঙ্গাদের পুনবাসনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়। এর পর দীর্ঘদিন এ সিদ্ধান্তের কোন কর্মকান্ড দৃশ্যমান হয়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চাপ সামলাতে না পেরে ভাসানচরের বিষয়টি পুনরায় আলোচনায় উঠে আসে। এরই অংশ হিসেবে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সরকারী কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ভাসানচরে অবস্থানরত নৌবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে সরেজমিনে একাধিক মতবিনিময় সভা করে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের টিম। হাতিয়া উপজেলার মূল ভূখ- থেকে ২০ কি.মিটার পূর্বে নদীপথ পেরিয়ে ভাসানচরের অবস্থান। বর্তমানে ভাসানচরের আয়তন প্রায় ৬০ বর্গকিলোমিটার অর্থাৎ হাতিয়ার মূল ভূখ-ের আয়তনের প্রায় সমান। এছাড়া দ্বীপটির চতুর্থদিকে প্রতিবছর গড়ে ৩৫-৪০ বর্গকিলোমিটার ভূমি জাগছে। জেলেরা জানান, ৮০’র দশকে এখানে একটি ডুবোচরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। পরবর্তী পাঁচ বছরে ডুবোচরটির আয়তন বৃদ্ধির পাশাপাশি একই সময় দক্ষিণে আরও একটি নতুন চর জেগে ওঠে। স্থানীয় জেলেদের কাছে এটি জালিয়ার চর নামে পরিচিত হলেও সরকারী উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক এর নাম পরিবর্তন করে বর্তমানে ভাসানচর বলা হচ্ছে। হাতিয়ার মূল ভূখ- থেকে ট্রলারযোগে ভাসানচর যেতে সোয়া ঘণ্টা সময় লাগে। কয়েক বছর আগে হাতিয়ার বন বিভাগ এখানে বনায়ন শুরু করে। এখন ভাসানচরের বিভিন্ন অংশে কেওড়া গাছে ভরে গেছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার আবদুল মান্নান, ডিআইজি এসএম মনির-উজ-জামান, নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের কর্মকর্তাসহ একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল ভাসানচর পরিদর্শন করে। এ সময় ভাসানচরে নৌবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পে ভাসানচরের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালক ক্যাপ্টেন আমিনুল হক লিখিত বক্তব্যে ভাসানচরের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যত কর্ম পরিকল্পনার সারসংক্ষেপ বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে সেখানে প্রথমে নৌবাহিনীর একটি ঘাঁটি করা হবে, এরপর রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণসহ অন্যান্য কাজ শুরু করবে নৌবাহিনী। ইতোমধ্যে নৌবাহিনী একটি হেলিপ্যাড ছাড়াও নিজেদের থাকার এবং অতিথিদের বসার ঘর, রাস্তা, গভীর নলকূপ নির্মাণ করে। তিনি লিখিত বক্তব্যে জানান, রোহিঙ্গাদের জন্য ঘর নির্মাণ, মসজিদ, মন্দির, খেলার মাঠ, বিদ্যালয়, পুকুর, গ্রামীণ হাট-বাজারসহ সকল অবকাঠামো তৈরি করা হবে। ভাসানচরে যে পরিমাণ জায়াগা রয়েছে তাতে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে জায়গা দেয়া যাবে। তবে এখনও চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত চলতি বছরের প্রথম দিকে হয়। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে চলতি বছর জানুয়ারিতে ভাসাচর পরিদর্শন আসেন প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন। সঙ্গী ছিলেন হাতিয়ার সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ইউএনও, পৌর মেয়র ও ওসিসহ কর্মকর্তারা। এ সময় তারা ঠেঙ্গারচরের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখেন। এবং তাদের নির্দেশে নৌবাহিনী হেলিপ্যাড, দুটি গভীর নলকূপ, দুটি বিশ্রামাগার, একটি জেটি ও অভ্যন্তরীণ একটি সড়ক নির্মাণ করেন। জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের পূর্বে রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিদর্শনে কক্সবাজার যান। কক্সবাজার থেকে আসার পর জাতীয় সংসদের অধিবেশনে তার বক্তব্যে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের বিষয় সরকারের ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন। এর পরই ভাসানচরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পুনর্বাসনের বিষয়টি ফের আলোচনা আসে। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সামাজিকভাবে নেতিবাচক মনোভাব থাকলেও স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায় হাতিয়ার ভাসাণচরে রোহিঙ্গাদের পূর্ণবাসন করা হলে এর সুফল পাবে হাতিয়ার বাসিন্দা। হাতিয়ার মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি আক্তার হোসেন জানান, ভাসানচরের চারদিকে সমুদ্রে প্রচুর সামদ্রিক মাছ পাওয়া যায়। জেলেরা মাছ ধরতে গেলে জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করা হলে সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভাল হবে। তাতে জেলেরা নিরাপদে সমুদ্রে মাছ শিকার করতে পারবে। একইভাবে বাংলাবাজার ঘাটের মালবাহী ট্রলার এমভি বারো আউলিয়ার মাঝি সালাউদ্দিন জানান, চট্টগ্রাম থেকে মাল নিয়ে ভাসানচরের পাশ দিয়ে আসতে হয়। এ সময় বিভিন্ন সময় জলদস্যুদের হামলার শিকার হয়ে অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে। ভাসাণচরে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিত থাকলে জলদস্যু নির্মূল হবে। ভাসানচরের উত্তর পাশে জাইজ্জারচর (স্বর্ণদ্বীপ) অবস্থিত। এই স্বর্ণদ্বীপ এক সময় ভাসানচরের মতো জনমানবহীন ছিল। এখন সেখানে সেনাবাহিনীর বিশাল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। স্বর্ণদ্বীপের ভেতরে অভ্যন্তরীণ পাকা সড়ক, নদীর তীররক্ষা বাঁধ, নদী ভাঙ্গন রোধ, সুসজ্জিত দালান তৈরি করে স্বর্ণদ্বীপকে আধুনিক জনবসতিপূর্ণ এলাকা তৈরি করা হয়েছে। তেমনি ভাসানচরকে এসব উন্নয়ন কর্মকা-ের আওতায় এনে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের কর্ম পরিকল্পনা সরকারী কাগজেকলমে তৈরি হচ্ছে। গত ২৮ সেপ্টেম্বর ঠেঙ্গারচর পরিদর্শনে এসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল স্থানীয়দের উদ্দেশে বলেন, রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের বিষয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছুই নেই। এখানে রোহিঙ্গাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আওতায় রাখা হবে। যাতে তারা কোনরূপ অনৈতিক কাজে জড়িয়ে না পড়ে। ভাসানচরকে একটি সুন্দর আবাসন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এজন্য নৌবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সব কিছুই এখনও পরিকল্পনা পর্যায়ে রয়েছে। শিক্ষা, চিকিৎসা ,আবাসনসহ সকল আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে শরণার্থী শিবির গড়ে তোলা হবে। এসময় উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র সচিব কামাল উদ্দিন আহমেদ কোস্টগার্ডের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন, র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি ড. মনিরুজজামান, প্রকল্প পরিচালক ক্যাপ্টেন আমিনুল ইসলাম খান প্রমুখ। হাতিয়া আসনের এমপি আয়েশা ফেরদাউস জানান, মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত এবং এ দেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে সরকারের উদ্যোগকে আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করব। তিনি বলেন, আশা করি ভাসানচরের চারদিকে মাছের যে অভয়ারণ্য তাতে তাদের জীবিকা নির্বাহ হবে। রোহিঙ্গাদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা হলে তারা কোন অনৈতিক কাজে জড়াবে না বলে আমার বিশ্বাস। এদিকে হাতিয়া উপজেলার বিভিন্ন পেশাজীবীর সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, মানবিক দিক বিবেচনা করে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করা উচিত। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়টিকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিতে হবে। প্রয়োজনে ভাসানচরে নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড মোতায়েন ছাড়াও পুলিশের স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করতে হবে।
×