ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

পোচেফস্ট্রুমে দ্বিতীয় ইনিংসে ৯০ রানে অলআউট বাংলাদেশ, ৩৩৩ রানে জয়ী দক্ষিণ আফ্রিকা

ব্যাটিং ব্যর্থতা তাই বলে এমন হার?

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ৩ অক্টোবর ২০১৭

ব্যাটিং ব্যর্থতা তাই বলে এমন হার?

মোঃ মামুন রশীদ ॥ প্রথম ইনিংসে নিজেদের সেরা নৈপুণ্য প্রদর্শন আর দ্বিতীয় ইনিংসে সবচেয়ে বাজে নৈপুণ্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টে নিজেদের সেরা সংগ্রহ গড়েও অনেকখানি পিছিয়ে ছিল সফরকারীরা। আর দ্বিতীয় ইনিংসে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে সবচেয়ে কম রানে গুটিয়ে যাওয়ার লজ্জাজনক রেকর্ড গড়েছে। এই প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টে ১০০ রানের নিচে মাত্র ৯০ রানে অলআউট হয়ে যায় বাংলাদেশ দল দ্বিতীয় ইনিংসে। সে কারণে ৩৩৩ রানের বিশাল পরাজয় জুটেছে পোচেফস্ট্রুমে অনুষ্ঠিত সিরিজের প্রথম টেস্টে। গৌরবজনক এক মাইলফলক অর্জিত হওয়ার আত্মবিশ্বাস জানিয়ে গিয়েছিলেন অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম। সেখানে লজ্জাজনক এক অভিজ্ঞতা অর্জন করল বাংলাদেশ। ব্যাটসম্যানদের চরম ব্যর্থতায় ডেকে আনল বিশাল হার। ফলে দুই টেস্টের সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল স্বাগতিক প্রোটিয়ারা। ম্যাচের চতুর্থ দিনেই বিশাল রানের নিচে চাপা পড়ে বাংলাদেশ। ২ উইকেটে ৫৪ রান নিয়ে খেলতে নেমে চতুর্থ দিন বোলারদের ওপর চড়াও হন দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যানরা। তবে এদিন ব্যাটিং করাটা সেনওয়েস পার্কে প্রথমদিনের মতো সহজ হয়নি। বাংলাদেশের বোলাররা বেশ ভাল বোলিং করেছেন। খুব বড় জুটি গড়তে না পারলেও দ্রুত রান করার দিকেই মনোযোগী ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। সেটিতে তারা সফলও হয়। ৬ উইকেটে ২৪৭ রান তুলে ইনিংস ঘোষণা করে দেয়। ব্যাট হাতে নিজের সামর্থ্য প্রমাণের পর বল হাতেও নিজের যোগ্যতা দেখিয়েছেন মুমিনুল হক সৌরভ। বোলিং নৈপুণ্যে দলের সেরা তিনিই। মাত্র ৬ ওভার বোলিং করে ২৭ রান দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৩ ব্যাটসম্যান টেমবা বাভুমা, ফাফ ডু প্লেসিস ও কুইন্টন ডি ককের উইকেট ঝুলিতে পোরেন বাঁহাতি অর্থোডক্স মুমিনুল। অথচ দলের অন্যতম স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজ করেছেন পুরোপুরি হতাশ। দ্বিতীয় ইনিংসেও থেকেছেন উইকেট শূন্য। ১০ টেস্টের ক্যারিয়ারে এই প্রথম তার এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। বিষাদের বিষয় আছে আরও। সবচেয়ে বেশি রান দিয়ে উইকেটশূন্য থাকার রেকর্ডে মিরাজের অবস্থান হয়েছে টেস্ট ইতিহাসে তিন নম্বরে। সবমিলিয়ে ৬৭ ওভার বোলিং করে (৫৬ ও ১১ ওভার) ২৪৭ রান দিয়ে কোন উইকেট পাননি মিরাজ। তালিকার এক নম্বরে প্রোটিয়া স্পিনার ইমরান তাহির। তিনি ২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এডিলেড টেস্টে ২৬০ রান দিয়ে কোন উইকেট পাননি। দুইয়ে সাবেক পাকিস্তানী পেসার খান মোহাম্মদ, ১৯৫৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জ্যামাইকা টেস্টে ২৫৯ রান দিয়ে ছিলেন উইকেটশূন্য। পেসস্তম্ভ মুস্তাফিজুর রহমান অবশ্য দারুণ বোলিং করেছেন। তিনি দুই উইকেট তুলে নেন। এরপরও টেমবা বাভুমার ৭১ ও প্লেসিসের ৮১ রানে লিডটাকে ৪২৩ রানের করে ফেলে দক্ষিণ আফ্রিকা। চতুর্থ দিনের শেষ ভাগে ৪২৪ রানের বিশাল লক্ষ্য নিয়ে খেলতে নেমে শুরুতেই বিপাকে পড়ে বাংলাদেশ। প্রথম ওভারেই বিদায় নেন অন্যতম ভরসা তামিম ইকবাল (০) ও প্রথম ইনিংসে দারুণ অর্ধশতক হাঁকানো মুমিনুল (০)। পেসার মরনে মরকেলে জোড়া আঘাতে ০ রানেই দুই উইকেট হারায় বাংলাদেশ। এরপরও খুব একটা সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি ইমরুল কায়েস। প্রথম ইনিংসে ব্যর্থ এ ব্যাটসম্যান আক্রমণাত্মক মেজাজে ব্যাটে চালিয়েছেন। তবে মুশফিক ছিলেন দারুণ সুস্থির। তিনি দুর্ধর্ষ মরকেল ও কাগিসো রাবাদার গতি মোকাবেলা করে যাচ্ছিলেন ঠা-া মাথায়। দিনের শেষ ওভারে স্পিনার কেশব মহারাজ আঘাত হানেন, ফিরিয়ে দেন ওয়ানডে মেজাজে ব্যাট চালাতে থাকা ইমরুলকে। অথচ ২ রানের সময় তিনি সহজ ক্যাচ দিয়ে প্লেসিসের কাছে জীবন ফিরে পেয়েছিলেন। ৪২ বলে ৫ চারে ৩২ রান করে সাজঘরে ফেরেন ইমরুল। সঙ্গে সঙ্গে চতুর্থ দিনেরও সমাপ্তি টানা হয়। ৪৯ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে ভীত-তটস্থ বাংলাদেশ দল মাঠ ছাড়ে পরাজয়ের শঙ্কা মাথায় নিয়ে। অবশ্য এর আগেই ভয়ানক মরকেল সাইড স্ট্রেইনে (শরীরের পার্শ্ব) মাঠ ছাড়েন ইনিংসের ১১তম ওভারে। তিনি আর মাঠে নামেননি। চতুর্থ দিন কিছুটা বৃষ্টি আসায় বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তরা যেন মনে কিছুটা শান্তি পেতে শুরু করেছিলেন। কারণ, প্রোটিয়ারা যে বিশাল লিড নিয়েছে তাতে করে ড্র করার জন্য বৃষ্টির আশীর্বাদের বিকল্পই নেই। তবে সেটা আর পঞ্চম দিনে দেখা যায়নি। আগের দিনের বিপদ মাথায় নিয়ে খেলতে নামলেও বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানদের জন্য সুখবর ছিল মরকেলের অনুপস্থিতি। পিঠের ব্যথার কারণে আর নামতে পারেননি তিনি। কিন্তু বিপদ বাড়তে সময় লাগেনি বেশি। দিনের দ্বিতীয় ওভারেই রাবাদার বলে সাজঘরে ফেরেন মুশফিক (৫৫ বলে ১৬)। মরকেলের পরিবর্তে এদিন যেন গতি নিয়ে জ্বলে ওঠেন এই পেসার। দ্রুতই ফিরিয়ে দেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ (৯) ও লিটন দাসকে (৪)। উইকেট ছুড়ে দিয়ে সাজঘরে ফেরার যে মিছিল শুরু হয় সেখানে যোগ দেন সাব্বির রহমানও। তিনি মহারাজের ঘূর্ণিতে এলবিডব্লিউ হয়ে (৪) যান। এরপর আর ভাল কিছু করার আশা শেষ হয়ে যায়। দলের রান তখন মাত্র ৬৭, উইকেট চলে গেছে ৭টি। বিশাল পরাজয়ের প্রহর গুণতে শুরু করে সবাই। মহারাজের স্পিন সেটাকে দ্রুততর করেছে। তিনি বাংলাদেশ ইনিংসের লেজ মুড়িয়ে দেন। মাত্র ২৫ রানে ৪ উইকেট নিয়ে লজ্জায় ফেলেন বাংলাদেশকে। ৯০ রানেই গুটিয়ে যায় সফরকারীদের দ্বিতীয় ইনিংস। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এটিই বাংলাদেশের সর্বনিম্ন টেস্ট ইনিংস। প্রথম ইনিংসে ৩২০ রান ছিল প্রোটিয়াদের বিপক্ষে টেস্টে সর্বোচ্চ সংগ্রহ। এই বিশাল উত্থান-পতনের জন্যই ৩৩৩ রানের বড় পরাজয় জুটেছে মুশফিকদের ললাটে। প্রোটিয়াদের বিপক্ষে খেলা ৯ টেস্টের মধ্যে ৭টিতেই ইনিংস ব্যবধানে হেরেছিল বাংলাদেশ। ২০০৮ সালে ঢাকা টেস্টে হেরেছিল ৫ উইকেটে। এবার সেটার চেয়েও বাজে ফলাফল হলো। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে এই প্রথম ইনিংস হার ঠেকিয়েছে বাংলাদেশ দল এটাই হয়তো সান্ত¦নার কথা হতে পারে। কিন্তু দলের উন্নতি খুব কমই হয়েছে সেটাও পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। পেসবান্ধব উইকেটে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা কতটা অসহায় সেই চিত্রই পরিষ্কার হয়েছে সেনওয়েস পার্কে। কারণ সর্বশেষ ২০০৭ সালের জুলাইয়ে কলম্বো টেস্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৬২ রানে গুটিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের ইনিংস। এরপর এটাই প্রথম ১০০ রানের নিচে গুটিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ ১০ বছর আগের দুঃসহ স্মৃতি মুশফিকদের ফিরিয়ে দিল পোচেফস্ট্রুম। ৩০০ রানের বেশি ব্যবধানে এর আগে ৪ বার হেরেছে বাংলাদেশ। সবচেয়ে বড় পরাজয় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চট্টগ্রামে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ৪৬৫ রানে। এরপর ২০১৩ সালের এপ্রিলে হারারেতে জিম্বাবুইয়ের কাছে ৩৩৫ রান। এরপরই তৃতীয় অবস্থানে এই হার। পুরনো সেই দুর্দশাগ্রস্ত বাংলাদেশের কঙ্কালসার ব্যাটিং চিত্রটা ভালভাবেই প্রদর্শিত হলো সেনওয়েস পার্কে।
×