ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পশ্চিমা কোম্পানি নিজেদের বিনিয়োগ স্থগিত অথবা পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে;###;সঙ্কট তৈরি হয়েছে দেশটির পর্যটন খাতে

মিয়ানমারের অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ৩ অক্টোবর ২০১৭

মিয়ানমারের অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সমালোচনা ও চাপের মুখে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর রাখাইন রাজ্যসহ মিয়ানমারের অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে। সামরিক শাসন অবসানের পর দেশটিতে ব্যাপক বিদেশী বিনিয়োগের প্রত্যাশা করেছিল সরকার। তবে রাখাইনে রোহিঙ্গা সঙ্কটের কারণে এরই মধ্যে বেশকিছু পশ্চিমা কোম্পানি নিজেদের বিনিয়োগ স্থগিত করেছে অথবা পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সঙ্কট তৈরি হয়েছে দেশটির পর্যটন খাতে। এছাড়া রাখাইনের রাজ্য সরকার ও কেন্দ্র সরকারের মধ্যে বড় বড় প্রকল্পগুলো নিয়েও টানাপড়েন তৈরি হয়েছে। গত সপ্তাহে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা সঙ্কটে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়। জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে সংস্থাটির মহাসচিব রাখাইনে অবিলম্বে সেনা অভিযান বন্ধের আহ্বান জানান। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করার আহ্বান জানানো হয়। এর আগে ‘চলমান সহিংসতা এখনই বন্ধ’ করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে আঞ্চলিক ও আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো। ক্ষতিগ্রস্ত সব সম্প্রদায়ের মানুষের কাছেই মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেয়া প্রয়োজন বলেও সংস্থাটির সদস্যদের মধ্যে মতৈক্য হয়েছে। যুক্তরাজ্য দেশটির সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়া বাতিল করেছে। মিয়ানমারের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে মালদ্বীপ। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কথিত গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার হওয়ার পর বিপুল আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের আশা করেছিল মিয়ানমার। বিদেশী কোম্পানিগুলোর মধ্যে বিনিয়োগের আগ্রহও দেখা গিয়েছিল। তবে রাখাইন রাজ্যে শোচনীয় মানবাধিকার পরিস্থিতির কারণে অনেক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানই পিছু হটছে। মিয়ানমারে বিনিয়োগ করলে সুনাম ক্ষুণœ হওয়ার আশঙ্কা করছে এসব আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো। রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুসারে, এসব বিদেশী কোম্পানির মধ্যে রয়েছে মার্কিন ফুড এ্যান্ড বেভারেজ কোম্পানি, বহুজাতিক জ্বালানি কোম্পানি শেভরন ও নরওয়েভিত্তিক টেলিকম কোম্পানি টেলিনর। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট কমিটি অন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডের প্রধান বার্নড লানগে বলেন, গত সপ্তাহে তার প্রতিনিধি দল মিয়ানমারে অনির্দিষ্টকালের জন্য একটি সফর স্থগিত করেছে। কেননা, বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতির কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন-মিয়ানমারের মধ্যকার সম্ভাব্য বিনিয়োগ চুক্তি নিয়ে একটি ফলপ্রসূ আলোচনা করা যাচ্ছে না। মিয়ানমার ট্যুরিজম ফেডারেশনের ভাইস চেয়ারম্যান খিন অং তুন ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, যেসব আন্তর্জাতিক ফার্ম মিয়ানমারে সম্মেলন করতে চেয়েছিল তারা এখন স্থান পরিবর্তনের কথা ভাবছে। সুচির সরকার সমর্থক সংবাদমাধ্যম মিয়ানমার টাইমস এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ভৌগোলিকভাবে প্রাণকেন্দ্র না হলেও দেশটির অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাখাইন। সুপরিচিত নাগাপালি সৈকত ছাড়াও রাখাইনে রয়েছে বেশ কয়েকটি তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস। এছাড়া বঙ্গোপসাগরে রয়েছে ব্যাপক পরিমাণে সামুদ্রিক সম্পদ। রাখাইনের অর্থনীতি সঙ্কট ও প্রতিবন্ধকতার মুখে রয়েছে উল্লেখ করে মিয়ানমার টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সর্বশেষ সহিংসতার পর সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ‘সঠিক’ তথ্য তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। রাখাইনের ইয়েথেটাউং শহরের এমপি ইউ উও থান নাইং জানান, ১৯ সেপ্টেম্বর ভাষণে সুচি ভুল তথ্য উন্মোচন করলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। মিয়ানমারের অর্থনৈতিক কলাম লেখক ইউ খিন মাউং নিয়ো উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, রাখাইনের সহিংসতা নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপের কারণে অঞ্চলটির স্থিতিশীলতা নিয়ে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা চিন্তিত হতে পারে। যা রাখাইনের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে ব্যাহত করতে পারে। রাখাইনের মৎস্য বিভাগের পরিচালক ড. নাইয়ুন্থ ওয়াই মাউং জানান, আঞ্চলিক সংঘাতের কারণে মংডু অঞ্চলের সামুদ্রিক খাদ্যপণ্যের কারখানাগুলো প্রভাবিত হচ্ছে। সংঘাত শুরুর পর উৎপাদন কমে গেছে। ২২ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার টাইমস আরেকটি প্রতিবেদনে দেশটির পর্যটনশিল্প হুমকির মুখে পড়েছে বলে উল্লেখ করেছে। রোহিঙ্গা সঙ্কটের কারণে অনেক পর্যটন কোম্পানি তাদের নির্ধারিত সফর ও হোটেল বুকিং বাতিল করেছে। ইউনিয়ন অব মিয়ানমার ট্রাভেল এ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ইউ থেট জানান, নগাপালি ও ম্রাউকে পর্যটকদের বুকিং বাতিলের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ইয়াঙ্গুন, নগাপালি সৈকত ও বাগান অঞ্চলের হোটেল সংশ্লিষ্টদের মতে, গত বছরের তুলনায় এই বছর একই সময়ে অনেক কম হোটেল বুকিং হচ্ছে। মিয়ানমার ট্যুরিজম মার্কেটিং কমিটির চেয়ারম্যান ও চাত্রিয়াম হোটেলের মহাব্যবস্থাপক ডাউ মিয়াত মন উইন বলেন, এই মুহূর্তে বুকিংয়ের হার কমেছে। ২১ সেপ্টেম্বর নিক্কেই এশিয়া রিভিউতে প্রকাশিত এক সাক্ষাতকারে আউং সান সুচি নিজেও স্বীকার করেছেন রাখাইনের সহিংসতায় বিদেশী বিনিয়োগকারীদের উদ্বিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক। তবে তিনি বার বার জোর দিয়ে বলেন, দারিদ্র্যপূর্ণ রাখাইনের দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান করার অন্যতম চাবিকাঠি হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন। তার দাবি, রাখাইনের পরিস্থিতি উন্নয়নে বিনিয়োগ একটি সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। উল্লেখ্য, ২৫ আগস্ট ৩০টি পুলিশ ফাঁড়িতে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) হামলার জবাবে রাখাইনে সামরিক অভিযান জোরদার করে মিয়ানমার। সামরিক অভিযানের মুখে ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ ও গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। জাতিসংঘ সেনাবাহিনীর অভিযানকে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা রাখাইনে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে।
×