ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রহমান মোস্তাফিজ

আগামী নির্বাচন এবং ধারাবাহিকতা

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ৩ অক্টোবর ২০১৭

আগামী নির্বাচন এবং ধারাবাহিকতা

বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দুটি বড় রাজনৈতিক দল। এ ছাড়া আরও প্রায় চল্লিশটি দল রয়েছে। সংসদ নির্বাচনে ওই দুটি দলে জোটবদ্ধ হয়। এটা দোষের কিছু নয়। প্রায় দেশেই রয়েছে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করার। এককভাবে নির্বাচন করে সিংহাসন পাওয়ার হিসাবটি তখন কঠিন। ফলে রেলগাড়ির বগির মতো একটির সঙ্গে আরেকটি জোড়া লাগিয়ে বিশাল দীর্ঘদেহী রূপ লাভ করে লড়াইয়ে নেমে পড়ে। আওয়ামী লীগের জন্ম ১৯৪৯ সালে। এই দলের তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জ্ঞানে নেতৃত্বদানের ক্ষমতায় যুক্তিতর্কে বাগ্মিতায় যিনি ছিলেন অসাধারণ। তার ৩২ বছর পর ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। এই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী দলটির ৬৮ বছর পেরিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ যেহেতু অনেক পুরনো রাজনৈতিক দল সেহেতু দেশজুড়ে রয়েছে এর বিশাল কর্মী বাহিনী। দেশের স্বাধীনতার পর নাগরিকদের মধ্যে একটি নীরব ধারণা ছিল আওয়ামী লীগ মুসলমান বিরোধী দল। আর এটার ব্যাপকতা প্রকাশ পায় যখন বিএনপি জন্মলাভ করে, তখন তাদের নবগঠিত দল এই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে মুসলমানের দল বলে চালিয়ে দিল। আর যায় কোথায়। দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমান। এখান থেকে বিপুল সংখ্যক লোকের ম্যাজিকের মতো দলে ভিড়াতে সক্ষম হয়। বিএনপি কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিক মঞ্চে গরমাগরম বক্তৃতা দিয়ে জনমনে একটা ধারণা দিতে পেরেছিল যা ছিল ডাহা মিথ্যা আর তা হলো, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশকে ভারতের কাছে বিক্রি করে দেবে, বাংলাদেশ একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হবে, মসজিদের পাশে উলুধ্বনি দেবে, মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির তৈরি করবে, মূর্তি পূজায় দেশ ছেয়ে যাবে, দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও ইত্যাদি। এসব কথা প্রচারে আওয়ামী লীগ জনগণের কাছে কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল। মিথ্যার জালে আটকে গিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে তাদের অনেক ধীরে ধীরে সাবধানে এগুতে হয়েছে এবং ২১ বছর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। অবশেষে অনেক ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে ১৯৯৬ সালে সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিল। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আমরা দেখেছি কোন দল ধারাবাহিকভাবে সরকার গঠন করতে পারেনি। জনসাধারণ ভোট দিয়ে সরকার পরিবর্তন করেছিলেন। এই দুই দলের মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ অর্থাৎ কোন দল ভাল কিংবা ভাল নয় দেখা হয়েছে এবং তার ফলাফল চোখের সম্মুখে স্পষ্ট যে, দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার ব্যাপারে নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে মনপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করে এগিয়ে নিয়ে যাবে এমন প্রত্যাশা মানুষের ছিল, কিন্তু তারা প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি। আসলে বলতে গেলে বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়ছে না সেই ব্রিটিশ আমল থেকে। এ প্রসঙ্গে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বিখ্যাত বই জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি ১৯০৫-৪৭ লেখা থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসের দুর্ভাগ্যের ট্র্যাজেডি মহাকাব্যের কথা জানা যায়। তারপর আরেক দুর্ভাগ্য পাকিস্তানের শাসনাধীনের আওতায় উদ্ভট ক্ষমতার বেড়াজালে শোষণ-নির্যাতনের মধ্যে ২৩ বছর আটকে পড়ে থাকা এবং সেখান থেকে মুক্তি পেতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীরত্বগাথা জয়ধ্বনির এক মহাকাব্য রচিত হয় আর বাংলার বীরত্বপূর্ণ সাফল্য এই একটি মাত্র অর্জিত হয়েছে যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এসেছে। কিন্তু পরবর্তী সময়কালে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকল্পে সোনার বাংলা গড়ার যে দৃঢ় প্রত্যয় ছিল তার অভাব প্রকট। অথচ সাধারণ মানুষের বদ্ধমূল ধারণা রাষ্ট্র পরিচালনায় যদি ব্যাপকভাবে দুর্নীতির আশ্রয় এবং প্রশ্রয় দেয়া না হতো তাহলে এতদিনে এ দেশ মালয়েশিয়াকে ছাড়িয়ে যেতে পারত। তাই স্বাভাবিকভাবেই এখানে একটি প্রশ্ন এসে যায় তা হলো, বাংলার মানুষ আর কতদিন ব্যর্থতা ও দুর্ভাগ্যের আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকবে? বর্তমানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, দেশের অর্থনীতিকে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে উন্নতি করতে পেরেছেন। সরকারের ধারাবাহিকতা না থাকলে উন্নয়নের গতি থেমে যাবে। এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে আওয়ামী লীগকে আবারও ক্ষমতায় আনতে হবে। কিন্তু একটি মহল এর উত্তরে মান্দাতা আমলের উদাহরণ টেনে বলে বেড়ায় একটানা ক্ষমতায় থাকলে দলের মধ্যে চিন্তা ঢুকে পড়ে তাদের ছাড়া বুঝি কোন বিকল্প নেই, তারা অপরিহার্য। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জবরদখল লাগামহীন হয়ে পড়ে। অনদিকে আবার এটাও সত্য যে, একবার এই দলকে তো আরেকবার অন্য দলকে ক্ষমতায় বসানোর যে পরিবর্তন তার ফল সব সময় ভাল হয় তা কিন্তু নয়। আজ এটা আমাদের জানতে এবং সতর্কতার সঙ্গে ভাবতে হবে বৈকি। কারণ এখন দুনিয়াজুড়ে চলছে ভিন্ন পথে। অনেক আগে থেকে উন্নত এমনকি উন্নয়নশীল দেশগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখছি। রাষ্ট্র পরিচালনা ধারাবাহিকতার মাধ্যমে চলার কারণে আজ তারা উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গেছে। যেমন, মালয়েশিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ অর্থনৈতিক কাঠামোকে বিশ্বের দরবারে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে উন্নীত করে গেছেন। এটা কারও অজানা নয়। তিনি এই সাফল্য পেয়েছেন ধারাবাহিকভাবে ৪ বার অর্থাৎ ২০ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতে পেরেছিলেন বলে। সম্প্রতি তুরস্কের জনগণ সামাজিক ও অর্থনীতিক শক্তিশালী করতে ২০৩৪ সাল পর্যন্ত নতুন আইনে নির্বাহী প্রেসিডেন্ট হিসেবে রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন। উল্লেখ্য, তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইতোমধ্যে ১৪ বছর অতিবাহিত করে ফেলেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশে রাষ্ট্র পরিচালনা ধারাবাহিকতার মধ্যে রয়েছে। ভিয়েতনাম, চীন, রাশিয়া একই পথে। ধারাবাহিকতার আর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো প্রেসিডেন্ট হিসেবে সারা দুনিয়ায় ছিলেন পরিচিত মুখ, তিনি ধারাবাহিকভাবে ৪৯ বছর আস্থার ও উন্নয়নের প্রতীক হয়ে দেশ পরিচালনা করে গেছেন। উল্লেখ্য, তাঁর এই ধারাবাহিকতা যেন অব্যাহত রাখতে না পারে সে জন্য বিশ্ব মাতাব্বর আমেরিকা হাজার বার চেষ্টা করেও সিংহাসন টলাতে পারেনি। তারপর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দেখছি, পর পর ২ টার্ম জনগণ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন। ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য ডেমোক্র্যাট লীগের বারাক ওবামা ২ টার্ম এবং এর পূর্বে বিল ক্লিনটন ২ টার্ম মোট ৪ টার্ম দেশ পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। এবার রিপাবলিকান দল থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা লাভ করেছেন। দুনিয়ার আর এক শক্তিধর রাষ্ট্র জার্মানির পার্লামেন্ট নির্বাচনে ২০০৫ সাল থেকে ক্ষশতাসীন অ্যাঙ্গেলা মার্কেল এবার নিয়ে মোট ৪ বার ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করে যাচ্ছেন। এমনিতেই তাদের দেশের উন্নয়ন ঘটেনি। এটা বহু দিন আগে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, ধারাবাহিকতার মধ্যেই দেশের উন্নতির চাবিকাঠি নিহিত রয়েছে। আমাদের পাশের দেশ ভারত ও পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই শত্রুভাবাপন্ন এবং চার চারবার যুদ্ধে জড়ায় ১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৭১ ও ১৯৯৯ সালে। ভারতের রাজনীতিতে দেখা গেছে, কংগ্রেস দল ধারাবাহিকভাবে ৩০ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে দেশের আর্থ- সামাজিক উন্নয়নে পৌঁছার পর আজ আমেরিকা রাশিয়া চীনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে। অথচ পাকিস্তানের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই অধিক সময় সামরিক বাহিনীর উচ্চাভিলাষী জেনারেলরা রাষ্ট্র ক্ষমতাকে বার বার পরিবর্তন করেছেন। এখনও কোন রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র পরিচালনায় শক্ত ভিত তৈরি করতে পারেনি। কমনওয়েলথ বিশ্ব মানব সম্পদ উন্নয়ন সেল ১৮৩টি দেশের জরিপ ২০১৬ পাকিস্তানে সে দেশের কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য নাগরিক ও রাজনৈতিক কর্মকা-ে সূচক অনুযায়ী সার্ক দেশসমূহের মধ্যে পাকিস্তান ৭ নম্বর অবস্থানে করছে। উদাহরণের জায়গা নেই। তবে এর প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে হয় না। এদিকে বাংলাদেশেও ঠিক একই অবস্থা চলছে। কোন দল সরকার পরিচালনায় ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেনি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই উন্নতির নাগাল পেতে দুরূহ হয়ে গেছে। সুতরাং ধারাবাহিকতা ছাড়া বিকল্প পথ নেই। আওয়ামী লীগের দেশ পরিচালনার মেয়াদ শীঘ্র শেষ হতে চলেছে। খুব সম্ভবত ২০১৯ সালে ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিংবা এর আগেও হতে পারে এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও তার প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির মধ্যে বাকযুদ্ধ দেখছি, শুনছি। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য উভয় দল খুব হুঁশিয়ার হয়ে নানাবিধ কৌশল অবলম্বন করে চলেছে। আগামী নির্বাচনে কোন্ দল ক্ষমতায় যাবে সে সিদ্ধান্ত নেবেন নাগরিকরা একটি নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য ও স্বাধীনভাবে যাকে খুশি তাকে ভোট দেয়ার মাধ্যমে। এবারের নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন পরীক্ষা। শুধু ইচ্ছে প্রকাশে কতটুকু ফল দেবে? বর্তমানে বিপক্ষ প্রধান দল বিএনপি ছত্রখান ও হীনবল। কিন্তু আওয়ামী লীগ দলের রাষ্ট্র পরিচালনা আহা মরি কিছু না হলেও দেশের মূল শক্তি অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোটামুটি সন্তোষজনক পর্যায়ে আনয়ন করতে পেরেছেন। এটা সত্যি সরকারের ভাবমূর্তি প্রশংসনীয়। কিন্তু দুর্নীতি? সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বলা হচ্ছে, তাদের আমলে এ পর্যন্ত অনেকটাই কমিয়ে আনতে পেরেছে। এটা অনেক পুরনো এবং বিস্তৃত গভীরভাবে জেঁকে বসা একে মুলোৎপাটন করতে পারাটাই চ্যালেঞ্জ এবং আমরা তা অবশ্যই করে দেখাতে চাই, কিন্তু এ জন্য আরও কিছু সময় প্রয়োজন। এই দল যেহেতু অর্থনৈতিক উন্নতিতে সফল হয়েছে সেহেতু দুর্নীতিমুক্ত সরকার উপহার দেয়ার ব্যাপারেও তাদের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখা যেতে পারে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনায় ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে পারবে কি না তা জানা যাবে আগামী নির্বাচনে। লেখক : ব্যাংকার (অব)
×