ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অরুণ কুমার বিশ্বাস

ব্র্যান্ড ভ্যালু ও গোল আলু

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ৩ অক্টোবর ২০১৭

ব্র্যান্ড ভ্যালু ও গোল আলু

মোদ্দা কথায় ব্র্যান্ড মানে লোগো, চিহ্ন বা কোন স্পেশাল ট্রেডমার্ক যা দিয়ে একটি পণ্যকে অন্য পণ্য থেকে আলাদা করা যায়। যেমন ধরুন, বাজারে হরেকরকম জুতা যাওয়া যায়। বাটা থেকে শুরু করে অন্তত হাজার টাইপ জুতায় বাজার সয়লাব। জুতার বাজার সবসময় সরগরম, কারণ এটি কনজুমারস প্রডাক্ট। পেটে দানাপানি না পড়লেও চলে, কিন্তু জুতা ছাড়া রাস্তায় নামা যায় না। পাঠকহৃদয়ে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, আমি হঠাৎ ধান ভানতে শীবের গীত কেন গাইছি। মানে ব্র্যান্ড ভ্যালুর সঙ্গে আলুর কী সংযোগ! বিলেতে ব্র্যান্ড ব্যবস্থাপনা পড়তে গিয়ে একটা জিনিস বেশ বুঝতে পারছি যে, এই দুনিয়ায় আলাদা চিহ্ন বা ব্র্যান্ড না থাকলে বেঁচে কোন লাভ নেই। মুড়ি-মুড়কি সব একদর হয়ে যায়। তখন আবুলে আর কাবুলে কোন ফারাক থাকে না। জুতা তো জুতাই! অথচ নাইকি আর এ্যাডিডাস কিন্তু এক নয়। ওই যেমন চৌকির তলা আর আগরতলা- বহুত ফারাক! মানে গিয়ে দাঁড়াল এই, পণ্যের যেমন ক্যাটাগরি হয়, তেমনি মানুষে মানুষেও বিস্তর তফাৎ রয়েছে। রবি ঠাকুরের ভাই-বেরাদার আর কেউ কিন্তু বিশ্বকবি হননি। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সকল সন্তান সমান নন। অথচ প্রায়শ বলা হয়, ব্র্যান্ড থাকে মানুষের হৃদয়ে। একটু বিশদ করে বলি, তাহলে বুঝতে সুবিধে হবে। ধরুন চড়া রোদে হেঁটে আপনার প্রচ- মাথা ধরেছে। কিছু একটা মাথাব্যথার ওষুধ আপনাকে খেতেই হবে। কিন্তু কী খাবেন! মানে কোন্ ব্র্যান্ডের ওষুধ? হাতের কাছে একটা পেলেন, অমনি গিলে খেলেন। কিন্তু না, তাতে তো মাথাব্যথা কমছে না। কারণ আপনি ধরেই নিয়েছেন ওটা এলেবেলে কোন কোম্পানির ওষুধ। এতে দ্রব্যগুণ নেই। অথচ সেই একই ওষুধ যদি নামী-দামী কোন ব্র্যান্ড যেমন ধরুন ফাইসন্স বা নোভারটিসের ফয়েলে করে দেয়া হয়, তা খেয়ে ঝটপট আপনার মাথাব্যথা কমে যাবে। এই যখন অবস্থা, তখন বলতেই হয় যে ব্র্যান্ড আসলে পণ্যে নয়, মানুষের মগজে ও মনে লুকিয়ে থাকে। ফিলিপ কটলার, যাকে আমরা মার্কেটিং গুরু বলে জানি, তিনি অবশ্য নিশ্চিত করে বলেছেন যে, ব্র্যান্ড ভ্যালুবিহীন পণ্য আর বেওয়ারিশ লাশের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। দুটোই মূল্যহীন। বাজারে মেলা জুতা, অথচ কিনতে গেলে আমরা নামী ব্র্যান্ডের জুতা চাই। বা ধরুন কেশবিন্যাসের জন্য সুগন্ধী তেল বা শ্যাম্পু। শুধু এ্যালোভেরা মেশানো থাকলেই হবে না, তার নামও জানা থাকা চাই। এই জন্যই বুঝি বলে, নাম নেই যার, দাম নেই তার। ভাদ্দরের তালপাকা গরমে প্রচণ্ড ঘামছেন আর ভাবছেন, একটু ঠাণ্ডা কিছু হলে হতো। মানে এক চুমুক সফট ড্রিঙ্কসের জন্য প্রাণটা আপনার আঁকুপাঁকু করছে। এসে গেল গ্লাসভর্তি কোল্ড ড্রিঙ্কস। চোঁ চোঁ করে খেলেন, কিন্তু না, প্রাণ জুড়াচ্ছে না। কারণ আপনি মনে করছেন এটা লোকাল কোন পানীয়। এর নাম বা মান কোনটিই নেই। কোকাকোলা চাই আপনার। দামী ব্র্যান্ডের সফ্ট ড্রিঙ্কস। খানিক বাদে আপনার জন্য বিশে^র একনম্বর ব্র্যান্ড কোকাকোলাই আনা হলো। আপনি এক চুমুকে খেয়ে বড়সড় এটা ঢেঁকুর তুললেন। হ্যাঁ, এবার কাজ হয়েছে। প্রাণ জুড়িয়েছে। অথচ ব্যাপার কী জানেন তো, আগে যে পানীয় আপনি পান করেছেন, তাও কিন্তু কোকাকোলাই ছিল। যেহেতু গ্লাসে করে পরিবেশিত হয়েছে, আপনার মন তাই সায় দেয়নি। জিনিস এক, শুধু খোলসে তফাৎ। তাই তো বলি, ব্র্যান্ডভ্যালু আর গোল আলুর মাঝে তেমন কোন তফাৎ নেই। গোল আলু যেমন কাঁঠালি কলার মতো যে কোন খানে আঁটে, ব্র্যান্ডও তেমনি- একবার তৈরি হয়ে গেলে যা খুশি তাই চালিয়ে দেয়া যায়। পাবলিককে বেকুব বানানো আর কী! গোল আলু তরকারি হিসেবে খুব উপাদেয় না হলেও স্বাদযুক্ত। হল্যান্ড প্রথম এই জিনিস আবিষ্কার করে, তারপর ক্রমশ ছড়িয়ে যায় তামাম দুনিয়ায়। আলু এমন এক আনাজ, যা কিনা সবখানে মানিয়ে যায়। এর নিজস্ব কোন ব্র্যান্ডভ্যালু হয়তো নেই, তবে চাহিদা আছে বেশ। কিছু কিছু মানুষ দেখবেন, খুব বেশি কাজের না, কামেরও না, অথচ সবখানে তার উপস্থিতি বিদ্যমান। যেন সে ওমনিপ্রেজেন্ট। এদের ব্র্যান্ড লাগে না, টিঙ টিঙ করে নিজেই নিজের মার্কেটিং করে বেড়ায়। শেক্সপিয়ার অবশ্য বলেছেন, নামে কিছু এসে যায় না। কামেই বস্তুর গুণপনার প্রমাণ নিহিত। যখন তিনি বলেছেন, তখন হয়তো তাঁর কথার সারবত্তা ও প্রাসঙ্গিকতা বজায় ছিল। আজকের এই ডামাডোলের যুগে নিজের ঢোল নিজে না পেটালে কেইবা কাকে মনে রাখে! ব্র্যান্ড ইজ এ্যা মাস্ট। মানে নিজের নাম বা চরিত্রের সঙ্গে একটা বিশেষ চিহ্ন যুক্ত করা। যেমন অনেকেই বক্তৃতা বা বিবৃতি দেয়, ক’জনের কথা মানুষ শোনে বা মনে রাখে! ব্যক্তিবিশেষের ব্র্যান্ডভ্যালু গড়তে চাই ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা। একখানা বই লিখে নিজের কাছে রেখে দিলে যেমন লেখক হিসেবে সুনাম পাওয়া যায় না, ঠিক তেমনি জ্ঞানীজন আচ্ছাসে চোপা চালাতে না জানলে মানুষ তাকে পোঁছে না। এই থিওরি থেকেই বোধহয় মাঝ রাত্তিরের টক-শো নামক অনুষ্ঠানের উৎপত্তি। এও ঠিক যে, উক্ত অনুষ্ঠানটি ভাইরাল না হলে হয়তো জানাই হতো না, বঙ্গদেশে এত এত জ্ঞানী-বুদ্ধিমান ব্যক্তি পড়ে পড়ে মার খাচ্ছেন। আমরা তাদের দেখেও দেখছি না, কারণ তাদের অনেকেরই ব্র্যান্ডভ্যালু খুব একটা নেই। বা থাকলেও খুব নিম্নমানের। ফিলিপ কটলার যাই বলুন, গুণ কিছু না থাকলে শুধু বিপণনের জোরে কিন্তু হালে পানি পাওয়া যায় না। তখন অল্পজলের খলসে মাছের মতো স্রেফ খলবলিয়ে বেড়াতে হয়। তাতে শব্দ হয় বেশি, কিন্তু সমাদর জোটে না। সেই গোল আলুর মতো। অন্যান্য আনাজপাতির সঙ্গে মেশালে স্বাদ বাড়ে বটে, নিজের যোগ্যতায় ভাল কোন রেসিপি হয়ে ওঠার সুযোগ ঘটে না। স্রেফ ফ্রেঞ্চফ্রাই। বস্তুত, অনেকেই আমরা গোল আলুর জীবন যাপন করছি। স্বার্থপর, কূপম-ূক ও প্রচারসর্বস্ব পতঙ্গের জীবন। অহেতুক গড়াগড়ি, স্বার্থের গন্ধ পেলেই অমনি কাড়াকাড়ি। ওপার বাংলার সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের মতো বলতে হয়, কী ছাই জীবন! এলি, খেলি আর গেলি! মানে হয়! ব্র্যান্ড দিয়ে শুরু করেছি যখন, ব্র্যান্ড দিয়েই শেষ করি। অন্যতম বিশ^সেরা কমোডিটি ব্র্যান্ড হলো গিয়ে কোকাকোলা। এর আর্থিক মূল্য অন্তত আশি বিলিয়ন ইউএস ডলার। এ্যাপলের ব্র্যান্ডভ্যালু আরও বেশি, প্রায় একশ’ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু এ সব কোম্পানির টোটাল পণ্যমূল্য কি এত বেশি নাকি! মোটেও না। ব্র্যান্ড নামক একখানা বায়বীয় অথচ জবরদস্ত জিনিস জুড়ে দিয়ে বাজারমূল্য বাড়াচ্ছে! আর ক্রেতা-সাধারণের নিরেট মাথা চুষে-চিবিয়ে খাচ্ছে! বাজারে কতরকম সফ্ট পানীয় আছে, অথচ শুধু কোকাকোলার পিছে ছুটছো কেন বাপু! ব্র্যান্ড আসলে কিছুই না, আমজনতার মগজে ঘাপটি মেরে থাকা কাস্টমার লয়্যালটি। আমরাও অনেককে দেখে নিত্য দুবেলা সালাম ঠুকি, শ্রদ্ধায় অবনত হই, বড়মানুষ ভাবি। আসলে তারা মোটেও এমনটি নয়। ভেতরটা বড্ড ফাঁপা। শুধু ফাঁকাবুলি আউড়ে কৌশলে আমাদের লয়্যালটি কিনে রেখেছে। এহেন মিছে আকর্ষণ থেকে আমাদের বেড়িয়ে আসতেই হবে, নইলে অযথা ভুল মানুষের পশ্চাদ্ধাবন করে গোল আলুর মতো পস্তাবো, লাভের লাভ কিছুই হবে না। লেখক : রম্যলেখক
×