ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শাহীন রেজা নূর

রোহিঙ্গা সংকট ॥ চক্রান্তের পূর্বাভাস

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ৩ অক্টোবর ২০১৭

রোহিঙ্গা সংকট ॥ চক্রান্তের পূর্বাভাস

রোহিঙ্গা ইস্যুটি এক মারাত্মক সঙ্কট তৈরি করেছে বাংলাদেশের জন্য। গত আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুলিশ ও সেনাক্যাম্পে কথিত সন্ত্রাসী হামলার অজুহাতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর যে অবর্ণনীয় ও নির্মম গণহত্যা শুরু করেছে, তা এক কথায় জঘন্য, পৈশাচিক ও নারকীয় উন্মাদনা ছাড়া কিছু নয়! এসব ঘটনাবলী স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বাংলাদেশীদের মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তার কারণ এই যে, আমরাও মাত্র ৪৬ বছর আগে ঠিক অনুরূপ গণহত্যার শিকার হয়েছিলাম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশী দোসর জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের দ্বারা। ইতিহাসের ঐ অন্যতম বীভৎস গণহত্যার কারণে তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ১ কোটি বাসিন্দাকে প্রাণভয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। মনে রাখতে হবে এক-দুই লাখ নয়, এক কোটি। এই বিপুল সংখ্যক আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাকে আশ্রয় দান করাটা সর্ববিচারেই তদানীন্তন ভারত সরকারের জন্য যে কতবড় সঙ্কট সৃষ্টি করেছিল, তা আজও ভাবাই যায় না। এদের খাদ্য-আশ্রয়-চিকিৎসা জোগাতে সেদিন পশ্চিম বাংলা ও অসমের মানুষ এবং গোটা ভারতবাসী যে অসাধারণ মমত্ব আর সুকোমল হৃদয়বৃত্তির পরিচয় রেখেছিল, তা আজও আমাদের স্মৃতিতে সমুজ্জল হয়ে আছে। শরণার্থী হিসেবে অন্য একটি দেশে যারপরনাই কায়-ক্লেশের মধ্যে বসবাস করাটা মানুষের জন্য যে নিদারুণ কষ্টকর ও মানবেতর, তা আমরা জানি। তখনকার ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী এবং তার সরকার ঐ শরণার্থী সমস্যা মোকাবেলায় নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছিলেন, তা ভাবলে আজও আশ্চর্যান্বিত হতে হয়। ভারতের সীমিত সম্পদ আর ব্যবস্থাপনার জন্য ঐ এক কোটি শরণার্থী কি ভয়ংকর চাপ সৃষ্টি করেছিল, তা সহজেই অনুমেয়। সুতরাং, আমরা নিজেরা ভুক্তভোগী হওয়ার কারণে শরণার্থী মনের যাতনা অত্যন্ত সহমর্মিতার সঙ্গে অনুধাবন করতে পারি বৈকি! তাই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল নামতে দেখে সীমিত সম্পদ আর বিপুল জনসংখ্যাসমৃদ্ধ এই দেশের মানুষ খানিকটা বিচলিত বোধ করলেও মানবতার এই বিপর্যয়ে উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত এবং সহমর্মী না হয়ে পারেনি। আমাদের সংস্কৃতি চেতনায় মানবতাই প্রধান অঙ্গ। আর এই পরিচয় প্রদানে ইতিহাসের কোন পর্বেই আমরা কোনপ্রকার কার্পণ্য করিনি। ইতোপূর্বেও মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়ন করা হয়েছে আর তখনও প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তবে অতীতের কোন সরকারই এই সমস্যাটির বাস্তবানুগ কোন সমাধান টানার চেষ্টা করেনি। বরং দেখা গেছে যে, অতীতে বিএনপি সরকারের প্রচ্ছন্ন পৃষ্ঠপোষকতা আর পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর ইন্ধন ও সহযোগিতায় পার্বত্যাঞ্চলের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোকে নানা জঙ্গী ও সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাবার রিক্রুটিং সোর্স বানানোর অপচেষ্টা নেয়া হয়। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হবার অব্যবহিত পর থেকেই লস্করে তৈয়বা, জঙ্গভি মোহাম্মদী, জিএমবি, হিজবুত তাহরির প্রভৃতি জঙ্গী সংগঠনকে চাঙ্গা করার কাজেও রোহিঙ্গাদের ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়। ফলে রোহিঙ্গাদের এই অসহায়ত্ব ও দারিদ্রাবস্থার সুযোগ নিয়ে একাদিক্রমে এই অপকীর্তি চালিয়ে যাওয়া হয়েছে আইএসআইর প্ররোচনা ও মদদে। পার্বত্যাঞ্চল দুর্গম বিধায় সেখানে এই জঙ্গী তৎপরতার ব্যাপারে সার্বক্ষণিক নজরদারি ও সার্বিক তথ্যাদি সংগ্রহ করাটাও অনেকাংশে প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় বৈকি! এমতাবস্থায়, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয়দান বিষয়ে স্বাভাবিকভাবেই সতকর্তা অবলম্বন যেমন অপরিহার্য হয়ে পড়ে, তেমনি আবার তাদের কারও কারও সঙ্গে আইএসআইসহ বিভিন্ন জঙ্গী কানেকশন বাংলাদেশীদের মনে দ্বিধা-সংকোচ ও সন্দেহ সৃষ্টি করে নিশ্চয়ই! ফলে এবার যখন রোহিঙ্গা ¯্রােত শুরু হয়, তখন এইসব বিষয় আমাদের মনে রেখাপাত করছিল। কিন্তু মিয়ানমারে রোহিঙ্গা বিতাড়নে যে নৃশংস নিধনযজ্ঞ চালানো হয়েছে তাতে আশ্রয়প্রার্থী মানুষদের জন্য আমাদের প্রাণও কেঁদে উঠেছে। এই রকম একটা অবস্থায় কে জঙ্গী কে জঙ্গী নয়, কিংবা এই গোটা নিধনযজ্ঞের পেছনে কার কি অভিসন্ধি আছে, সেগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা বা মাথা ঘামানোর জন্য অবকাশই ছিল না আমাদের। এক্ষেত্রে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকাটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তার মাতৃ-হৃদয়, ভগ্নি-হৃদয় এ ব্যাপারে কতটা উদ্বেল, কতটা সংবেদনশীল তার পরিচয় জাতি ইতোমধ্যেই পেয়েছে। সেই প্রথম দিন থেকেই তিনি নির্মম-নিষ্ঠুরতার শিকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে গোটা বিশ্বে বাঙালী হৃদয়ের কুসুম-কোমল রূপটিকে এমনভাবে মেলে ধরেছেন, যা কিনা আমাদের গৌরববাহী ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবেই চিহ্নিত। ফলে আমাদের হৃদয় মাধুর্যের যে পরিচয় বিশ্ববাসী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হৃদয় সৌকর্যের মাধ্যমে পেয়েছে এবং পাচ্ছে, তাতে করে আমরা বিশ্বসভায় নতুন করে গৌরবান্বিত হয়েছি ও হচ্ছি। বিশ্বের বিভিন্ন বড়-ছোট দেশ এবং বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা শেখ হাসিনার এই ঔদার্য ও উচ্চকিত মানবিকবোধের প্রশংসায় আজ পঞ্চমুখ। মনে রাখতে হবে যে, জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি বিশ্ব নেতাদের এই অকুণ্ঠ সমর্থন প্রকারান্তরে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা-ভালবাসারই নামান্তর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীর হৃদয়ের ঐ উদার ঐশ্বর্যম-িতরূপেরই প্রতিক হয়ে উঠেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ এক মহিমান্বিত দেশনায়কে পরিণত হয়েছেন। যে প্রচ- দুর্যোগঘন পরিবেশের মধ্য দিয়ে তিনি তার জীবনের সুদীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছেন এবং যে দুর্যোগ থেকে দেশবাসীকে মুক্ত করতে তিনি নিজের জীবন বাজি রেখে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম করে যাচ্ছেন, তা আমাদের বাঙালী জাতিসত্তার জন্য অহংকার নিশ্চয়। এ অহংকার সুন্দরের সাধনা, কল্যাণের ব্রত আর শুভের উত্থান থেকে উৎসারিত, যা শেখ হাসিনার চারিত্রিক দৃঢ়তা, হৃদয়ের শোভাম-িত ঐশ্বর্য আর জনগণের প্রতি অকৃত্রিম আলবাসারই রূপকল্পমাত্র। যাক, কথাটি এই যে, আমরা বিপন্ন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বের তাবৎ মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছি সত্য, কিন্তু রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানের পথটি কি সে বিষয়ে কিন্তু এখনও বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে তেমন কোন বাস্তবভিত্তিক ও ন্যায়পূর্ণ বক্তব্য আমরা পাইনি। সকলেই আমাদের মানবিক বোধ ও ঔদার্যের কথা বলেছেন বটে, কিন্তু রোহিঙ্গাদেরকে স্বদেশে ফেরত যাবার ব্যাপারে কোন কংক্রিট সাজেশন বা উদ্যোগ নিচ্ছেন না। এই ইস্যুতে আমরা ভারত, চীন, রাশিয়াÑ এই তিন রাষ্ট্রের তাৎক্ষণিক ভূমিকায় খানিকটা বিচলিত বোধ করছি বৈকি! ভারত আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু রাষ্ট্র। রাশিয়াও তাই। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রশ্নে এই দেশ দুটির ভূমিকা আমাদের মনে এই দ্বিধা তৈরি করেছে যে, এই সঙ্কট বিষয়ে তারা বাংলাদেশের সমস্যার চাইতেও নিজ নিজ ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থটাকেই বুঝিবা বড় করে দেখছে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ নিরাপত্তা পরিষদের অন্যান্য সদস্য মিয়ানমার সরকার ও নোবেল বিজয়ী আউং সান সুচির ভূমিকার নিন্দায় মুখর। কিন্তু ভারত ঘটনার সামরিক দিকটিকে তুলে ধরলেও মিয়ানমারের নৃশংসতার বিষয়ে জোরালোভাবে এখনও কিছু বলেনি। অন্যদিকে, রাশিয়া তো বর্মী সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ দূরে থাকুক, বিষয়টিকে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে অভিহিত করেছে। ১৯৭১-এ পাকিস্তানী গণহত্যার সময় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিষয়টিকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে একে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে যেভাবে অভিহিত করেছিল, মিয়ানমার প্রশ্নে আজ রাশিয়ার ভূমিকাটিও যেন তদ্রƒপ। চীন একাত্তরের সঙ্কটকে তো ‘দুই কুকুরের’ (অর্থাৎÑ রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের) কামড়া-কামড়ি বলে চিহ্নিত করে আমাদের বিপন্নাবস্থার প্রতি যাচ্ছেতাই-রকম অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছিল। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতা-উত্তর যুগেও চীন আমাদের প্রতি বৈরী আচরণ অব্যাহত রাখতেও কম করেনি। অথচ, চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনের ব্যাপারে সেই ১৯৫৬ সাল থেকেই তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ সক্রিয় ও উদ্যোগী ছিল। ’৫৬ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোটা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সমভিব্যহারে চীন সফর করেন এবং এরই ধারাবাহিকতায় চীনা নেতা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ঢাকায় আসেন। চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের এই প্রয়াস-প্রচেষ্টার বিষয়টিকে ১৯৭১-এ আমরা চীনের তরফ থেকে একেবারেই ভুলে যেতে দেখলাম। আর এখানেই চীনা নেতৃত্বের এক ধরনের দুর্বোধ্য মানসিকতা দৃশ্যমান হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পাকিস্তানী শরীকদের সঙ্গে চীনাদের দহরম-মহরমও চীনের উদ্দেশ্য-অভিপ্রায় সম্পর্কে আমাদের জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। আজ এই রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ বিষয়ে গোটা বিশ্ব যেখানে নিন্দায় সোচ্চার, সেখানে চীনের বোধগম্য নীরবতা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যিক স্বার্থটাকেই অত্যন্ত ক্রুঢ়ভাবে মেলে ধরে বৈকি! মিয়ানমার খনিজ সম্পদে সম্পদশালী একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় দেশ। সেখানকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপারে ভূমিকা গ্রহণ বা সেখানে বিপুল পরিমাণ পুঁজি লগ্নির মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বার্থোদ্ধারই চীনের প্রধান লক্ষ্য। ফলে সেখানে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ঐ ব্যবসায়ী স্বার্থের কাছে অনেকটা ‘জায়েজ’ বলেই প্রতিপন্ন হয়। এখানে মানবতা তাদের নিকট একই কারণে উপেক্ষিত থেকে যায়। যদিও সম্প্রতি বিশ্ব জনমত আর প্রবল নিন্দা-মন্দের ঢেউ চীনকেও একটু নড়ে-চড়ে ওঠার প্রণোদনা দিচ্ছে, তথাপি এই সংকট নিরসনকল্পে যে বাস্তবোচিত ভূমিকাটি তাদের নেয়া উচিত এবং প্রয়োজন, তা শেষতক ঐ বাণিজ্যিক স্বার্থের কারণে সম্ভব হবে কি-না সেটিই এখন দেখার বিষয়। এটি অনস্বীকার্য যে, মিয়ানমার বা রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে চীনের ভূমিকা অত্যন্ত জরুরী। মিয়ানমার আজ মিথ্যার বেসাতি করে যে নির্দয়-নিষ্ঠুর ঘটনাপ্রবাহের জন্ম দিয়েছে ও দিচ্ছে, তার পেছনে চীনের নীরবতা পরোক্ষভাবে বর্মী শাসকদের উৎসাহ জোগায় বৈকি! সুতরাং, চীন ও ভারতের ভূমিকার ওপর অনেকাংশেই এই সঙ্কটের স্থায়ী ও গ্রহণযোগ্য সমাধান যে নির্ভর করে, তা বলাই বাহুল্য! ভারত আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের ক্ষতি হয় এমন কিছু করবে না, এ বিশ্বাস আমরা পোষণ করতে পারি। যদিও বিএনপি তার চিরাচরিত ঢংয়ে এ ব্যাপারে ভারতের বিরুদ্ধে দেশবাসীর মনে বিদ্বেষ ও সন্দেহপরায়নতা উস্কে দেবার বিরামহীন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ভারতের নীরবতা বা নরেন্দ্র মোদির এই সময়ের মিয়ানমার সফর নিয়ে অনেক বুজরুকী চীনের নীরবতায় তাদের মুখে একটি শব্দও উচ্চারিত হতে শোনা যায় না। ওদের আসল উদ্দেশ্যটি এতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওরা চাইছে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতেÑ যা কি-না তাদের রাজনীতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। লক্ষণীয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রোহিঙ্গা বিষয়ক যাবতীয় বক্তব্য, উদ্যোগ ও প্রস্তাব বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ইতিবাচক ও প্রশংসনীয় হিসেবে গ্রহণ করলেও, বিএনপি কিন্তু এসবের মাঝে কেবল ছিদ্রান্বেষণেই সচেষ্ট রয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘে প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমার সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান বিষয়ে যে পাঁচ দফা রূপরেখা পেশ করেছেন, সেটি শুধু বাংলাদেশ সরকারেরই স্ট্যান্ড নয়, বরং গোটা দেশেরই স্ট্যান্ড। অথচ বিএনপির ভাঙা রেকর্ড মির্জা ফখরুলকে সেই ‘ডে-ওয়ান’ থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের সমালোচনায় মুখর দেখা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে ‘জাতীয় ঐক্য ঐক্য’ বলে গলা ফাটাচ্ছেন, অথচ প্রধানমন্ত্রী যখন ঐক্য রচনার ভিত্তিভূমি প্রতিষ্ঠা করছেন, তখন বিএনপি তার মধ্যে কেবলই ছিদ্র খোঁজার তালে মশ্গুল। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের প্রশংসা করলেও বিএনপি সেইফ জোন নিয়ে নানা বিতর্ক সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। হায়রে রাজনীতি! জাতীয় সঙ্কটকালে বিএনপি তার চক্রান্তধর্মী রাজনীতি পরিহার করতে পারে না। পারবে কী করে; রোহিঙ্গাদের বর্তমান হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য আইএসআইর যেসব দূরভিসন্ধি রয়েছে, তা বাস্তবায়নে বিএনপি-জামায়াতই তো তাদের সবচাইতে বড় স্থানীয় শক্তি। সুতরাং, বিএনপিকে এই দুঃসময়েও কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন করতে হচ্ছে। মুখে তারা যতই ‘ঐক্য ঐক্য’ বলে চেচাক না কেন, বগলে কিন্তু তাদের ঝামা ইট! চীন আর বিএনপি উভয়েরই এ বিষয়ে শুভবুদ্ধির উদয় হোক, সেটিই কাম্য সকলের। কিন্তু তাদের উভয়ের অতীত ও সাম্প্রতিক ইতিহাস বিশ্লেষণের পর এই কথাটিই কেবল আমাদের মনে হয় যে, বলিÑ ‘ভবী ভুলিবে কী’। এ ক্ষেত্রে এই সঙ্কট সৃষ্টির গভীরে কি আছে তার সুলুক সন্ধান করাটা অত্যন্ত জরুরী বলে আমরা মনে করি। কেননা, সম্প্রতি আইএসআইর কর্তাব্যক্তির সঙ্গে আরাকান স্যালভেশন আর্মির জনৈক নেতার কথোপকথনের যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তাতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, রাখাইন, পার্বত্য চট্টগ্রামের একাংশ আর মিজোরাম সমন্বয়ে সন্ত্রাসী উৎপাদনের একটি ক্ষেত্রভূমি তৈরির দূরভিসন্ধি রয়েছে ঐ কুচক্রীদের। উল্লেখ্য, পাকিস্তান তো সন্ত্রাসী উৎপাদনের প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে আজ বিশ্বে চিহ্নিত ও নিন্দিত। বিশ্বের যে কোন স্থানে সংঘটিত সন্ত্রাসী তৎপরতায় পাকিস্তানী সন্ত্রাসীদের সাক্ষাত পাওয়া যায়। গোটা আফগানিস্তান অঞ্চলটিকে পাকিস্তান তার মুরব্বিদের সহায়তায় সন্ত্রাসীদের চারণভূমি ও সন্ত্রাসী প্রজনন ক্ষেত্র বানিয়ে ছেড়েছে। রাখাইনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও ভারতকে বিপদগ্রস্ত করার কৌশল হিসেবে আইএসআই এতদঞ্চলটিকে সন্ত্রাসীদের প্রজনন ক্ষেত্রে রূপান্তরিত করার চক্রান্তে মেতে উঠেছে। করাচীভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বার নেতা সৈয়দ হাফিজের সঙ্গে সন্ত্রাসী নেতা আবদুল কুদ্দুস বর্মীকে একই মঞ্চে ইদানীং দেখা গেছে একাধিকবার এমন খবরও পাওয়া যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী রফতানি এবং সন্ত্রাস জিইয়ে রাখার গভীর চক্রান্ত যে রোহিঙ্গাদের কেন্দ্র করে ঘোট পাকাচ্ছে এটি বুঝতে হবে সকলকে এবং সেই মোতাবেক সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে করে বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার সকলেই নিরাপদ থাকে। লেখক : সাংবাদিক
×