ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ৩ অক্টোবর ২০১৭

ঢাকার দিনরাত

ঢাকার প্রতিবাদী রূপ নিয়ে এই কলামে আগেও লিখেছি। কিন্তু ঢাকা যে কোন কোন সময় প্রতিবাদে গর্জে না উঠে নির্লিপ্ত থাকতেও পারে- সেটিও আমাদের মনে রাখা চাই। বলাবাহুল্য, ঢাকার এই দিকটি অনেককেই কষ্ট দেয়। এখন অবশ্য প্রতিবাদ ও ক্ষোভ-কষ্ট প্রকাশের একটি ভাল জায়গা হয়েছে ফেসবুক। মানুষ সেখানেই তার রাগ ঝাড়ে। ময়মনসিংহের গৌরীপুরে সমকালের বর্বরতম ঘটনার একটি ঘটে গেল গত সপ্তাহে; সাগর নামের এক গরিবঘরের কিশোরকে গাছের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করা হলো চুরির দায়ে। হত্যাকারীরা বড় গলায় বলল, থানা পুলিশ তারা পয়সা দিয়ে কিনে নেবে। মোবাইলে এই পেটানোর ভিডিও তুলে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেবার কথাও বলল তারা। এইটুকু একটা ছেলেকে এমন ঠাণ্ডা মাথায় নির্মমভাবে নির্যাতন করা যায়, পা ভেঙে দিয়ে সেই ভাঙা পায়ের ওপরেই দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করা যায়, ছবি না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন হতো। মর্মে ঘা দেয় এমন বিষয় আরও আছে এ ঘটনায়। সাগরেরই সমবয়সী কয়েকটা ছেলে তাদের চোখের সামনে কী করে এমন পৈশাচিক নির্যাতন হজম করল! কয়েকজন বয়স্ক মহিলাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই বর্বরতা দেখলেন। গ্রামের মানুষ কি এমন হৃদয়হীন প্রতিবাদহীন বিবেকহীন হয়ে গেছে? নাকি তারা ভীত সমাজের টাকাঅলা মানুষের ক্ষমতা আর দাপটের কাছে? ঢাকায় কোথাও একটা মানববন্ধন হলো না এর প্রতিবাদে। কোন সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে কোন বক্তার কথায় উঠে এলো না সাগরের জন্য সহমর্মিতা আর পাষ-দের দ্রুত বিচারের দাবিতে ক্ষুব্ধ উচ্চারণ! ঢাকার এই মৌনতা নিষ্ক্রিয়তা আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হলো, দুর্ভাগ্য। প্রত্যাশা পূরণে দুর্ভোগ ৩৬ ডিগ্রী তাপমাত্রার কথা বলেছিলাম গত সপ্তাহে। এ সপ্তাহে তা নেমে এলো ত্রিশের নিচে। সেজন্যে টানা বৃষ্টির সহায়তা ছিল। কিন্তু এতে যে পুরনো দুর্ভোগ নতুন করে দেখা দিল, সেটি কি প্রত্যাশিত ছিল? ঢাকায় এখন বৃষ্টি মানেই জলাবদ্ধতা। আর জলাবদ্ধতা হলে অবধারিতভাবে যানবাহনের গতি হ্রাস পাওয়া এবং অসহনীয় যানজটের সৃষ্টি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার বৃষ্টি ঢাকাকে এমন নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে। এক ধানম-িবাসী জানালেন তার দুর্ভোগের কথা এভাবে: ‘গতকাল সন্ধ্যায় (বৃহস্পতিবার) বের হয়েছি, যাব মনিপুরীপাড়া। সাড়ে ছটা- পৌনে সাতটা হবে। মিরপুর রোডের অবস্থা দেখে চললাম ধানমণ্ডির ভেতর দিয়ে। কারণ বুঝে গেছি এই জ্যাম ২৭ নাম্বারের মাথায় কুদরতি যে কারিশমা সৃষ্টি হয় একটুখানি বৃষ্টি হলেই তার ফল। ধানমণ্ডির ভেতরের কয়েকটা রাস্তার অবস্থা শোচনীয়; বিশেষ করে লেকের পাড় ধরে যে রাস্তা গিয়ে ৩২ নম্বর ব্রিজের গোঁড়ায় গিয়ে উঠেছে তাতে হাঁটু ছুঁই পানি। ফুটপাথ উপচে রাস্তার পানি লেকে গড়িয়ে যাচ্ছে। লেকের পানিরও সঙ্গের ওয়াকওয়ে ছোঁয়ার উপক্রম। ঘন্টা তিনেক ধানমণ্ডির বিভিন্ন রাস্তা আর লালমাটিয়া ঘুরে রাত সাড়ে নটায় মনিপুরীপাড়া তো পৌঁছালাম। ফেরার পথে আরেক পথ ধরেছি। রাজাবাজারে ঢুকে ইচ্ছা হচ্ছিল চিৎকার করে কাঁদি নয়তো গালি দেই। পানি এখানে হাঁটুর উপরে। গাড়ি গোঁগোঁ আওয়াজ করছে। মেয়ে ঘুম ঘুম হয়ে নেতিয়ে পড়েছিল, উঠে আতঙ্কে হাত চেপে ধরল, আম্মু এখন কি হবে! আমি চারপাশে দেখি মানুষের দুর্ভোগ। একেকটা বাসাবাড়ির ভেতরে হাঁটুপানি। উঁচু করে গড়ে তোলা এপার্টমেন্টগুলোর পার্কিং লটে পানি পৌঁছে গেছে। নারীপুরুষ এমনকি শিশুরাও প্রয়োজনে ওই পানিতে নেমেই হাঁটছে। কোনমতে ধুঁকতে ধুঁকতে এসে পৌঁছেছি বাসায়। তখনও বাড়ির কাছের মিরপুর রোড শয়ে শয়ে গাড়ি বুকে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে আছে। খালি বসে ভাবছিলাম আমরা কি আর মানুষ আছি? মানুষদের সঙ্গে কি এমন হয়? স্বাভাবিক জীবনযাপনের সবটুকু দায় শোধ করেও কার দোষে আমাদের এই মানবেতর জীবন? একটা দেশের খোদ রাজধানীর বুকের উপরে একটা রাস্তা বছরের পর বছর বৃষ্টির পানিতে বন্ধ হয়ে জীবনযাত্রা স্থবির করে দেয়, অলিতে গলিতে পাড়া মহল্লায় জলাবদ্ধতার জন্য যে জীবন এলোমেলো হয়ে পড়ে, পানিভর্তি রাস্তায় আতঙ্ক নিয়ে ঘুরছি, বৃষ্টি হলে বাড়ি থেকে বেরোতে হবে এই আশঙ্কার যে জীবন সেটি আমরা যাপন করছি কোন ঘোরে অচেতন হয়ে? সকাল থেকে বৃষ্টি দেখে ভাবছি এমন দিনে যেন কাউকে হসপিটালে নেবার দরকার না হয়, এম্বুলেন্স ডাকার দরকার না পড়ে, এমনকি এমন দিনে মৃত্যুও যেন কারও না হয়।’ কাচের বদলে প্লাস্টিক আমাদের চোখের সামনেই দেখলাম কাচের বদলে প্লাস্টিক কিভাবে বাজার গ্রাস করে নিল। গত সপ্তাহে আমাদের এক প্রীতিভাজন দম্পতির প্রথম সন্তান জন্মগ্রহণ করল। শ্যামলীর একটি বিশেষায়িত হাসপাতালে গিয়েছিলাম নবজাতককে দেখতে। নতুন শিশুর মুখ দেখে আমরা এখনও পরম আনন্দ লাভ করি। শিশুর বাবা-মায়ের সারা মুখে ছড়িয়ে থাকা শান্তি ও সুখ দেখেও আমাদের ভাল লাগে। পনেরো- ষোলো তলা এই হাসপাতালটিতে রোগীর জন্য গরম স্যুপ সরবরাহ করা হয়েছে প্লাস্টিকের বাটিতে। প্লাস্টিক ভীষণ ক্ষতিকর, জেনেও আরোগ্যসদনে কেন তার ব্যবহার! প্লাস্টিকে থাকে পিভিসি ও পলিকার্বোনেট। যার ফলে নাকি ক্যান্সার অবধারিত। দীর্ঘক্ষণ পাস্টিকের পাত্রে রাখা খাবার খেলে দেহে বিসফেনল এ নামক একটি রাসায়নিক ঢোকে। ওই রাসায়নিক আদতে প্লাস্টিক। অবশ্য এখন সচেতন ব্যক্তিরা পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিকের কথা বলেন। তবে এই প্লাস্টিক কতটা স্বাস্থ্যবান্ধব- সেটা আমার জানা নেই। ক্ষতিকারক প্লাস্টিকের বদলে নবায়নযোগ্য বায়োপ্লাস্টিক বা পেট্রোলিয়ামভিত্তিক প্লাস্টিক উৎপাদন এবং ব্যবহার শুরু হয়েছে। পানি-মাটিকে দূষিত না করেই এটি ভূপ্রকৃতিতে মিশে যেতে পারে। বাক্স বানানোর জন্য এক ধরনের হালকা অথচ মজবুত প্লাস্টিক উপাদান পলিস্টাইরিন। স্টায়রোফোম কাপ (সাধারণত এ ধরনের কাপে কফি বা পানীয় বিক্রি করা হয়) তৈরিতে এটি ব্যবহৃত হয়। যা হোক, প্লাস্টিকের বহুল ব্যবহারের কারণে কাচের দ্রব্য প্রস্তুতকারী অনেক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় ধস নেমেছে। গত সপ্তাহেই এক সামাজিক অনুষ্ঠানে কাচজাত পণ্যের কারখানার একজন মালিক বলছিলেন তার ব্যবসার মন্দার কথা। আগে যেখানে ১২০০ কর্মী কাজ করতো তার প্রতিষ্ঠানে, এখন তা নামতে নামতে দেড়শ’তে এসেছে কর্মীসংখ্যা। বিখ্যাত একটি শরবত বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানে তিনি সরবরাহ করতেন কাচের বোতল। সেই প্রতিষ্ঠান এখন ব্যবহার করছে প্লাস্টিকের বোতল। অবশ্য ওই ব্যবসায়ী আরেকটি নতুন ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনার কথাও বললেন। সেটি হলো বর্জ্য থেকে বিদ্যুত উৎপাদনের প্রকল্পের অংশীদার হওয়া। বর্জ্য থেকে বিদ্যুত উৎপাদনের সম্ভাবনার কথা আমরা শুনছি কয়েক বছর আগে থেকে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার টন বর্জ্য তৈরি হয়। আর কোরবানির ঈদের দিন উৎপাদন হয় আরও অন্তত পাঁচ হাজার টন বর্জ্য। বিশাল পরিমাণের এই বর্জ্য নিয়ে ফেলা হয় আমিনবাজার ও মাতুয়াইল ডাম্পিং স্টেশনে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ঢাকার এই বর্জ্য দিয়ে অন্তত ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব। ব্যবসায়ী ভদ্রলোকের জমি আছে মাতুয়াইল ডাম্পিং স্টেশনের কাছে। বিদেশী কোম্পানি চাইছে জমিটি কিনে নিয়ে সেখানে বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ করতে। তাতে বর্জ্য বহনের ক্ষেত্রে বড় ঝক্কি পোহাতে হবে না। জমি কিনতে না পারলে ব্যবসার অংশীদার করতেও রাজি ওই বিদেশী প্রতিষ্ঠান। পূজামণ্ডপে সব ধর্মের মানুষ শুধু ঢাকা তো নয়, দেশের যেখানেই দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হোক না কেন সেখানে সব ধর্মের মানুষই যান। উৎসবের ছোঁয়া যেন সবার মনে এসেই লাগে। এবার আমি যেতে পারিনি, কিন্তু পরিবারের বাকি সদস্যরা বেশ খানিকটা পথ পাড়ি দিয়ে বনানীর পূজাম-পে গেছেন। রাজধানীতে আগে পুরনো ঢাকার পূজাম-পগুলোই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। বেশ ক’বছর ধরে বনানীর পূজাম-প লাখ লাখ মানুষের কাছে দর্শনীয় হয়ে উঠেছে। এখানকার বিভিন্ন আয়োজন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সরাসরি দেখানো হচ্ছে বেসরকারি টিভিচ্যানেলে। একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক (মুসলিম) তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে বেশ কৌতূহলোদ্দীপক বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বনানীর পূজামণ্ডপে গিয়ে দেবী দুর্গার রূপ দেখে আমি মুগ্ধ। আমি দুর্গার ভক্ত নই, আমার চোখে মঞ্চের পঞ্চ প্রতিমা, তাদের ওপর ঘূর্ণমান আলোর অভিক্ষেপে অতুলনীয় ভাস্কর্য রূপে ধরা দেয়। ছবি তোলা আমার বহুদিনের শখ। কাল পূজামণ্ডপে ছবি তুলেছি। সে ছবি আপলোড করার পর অনেকের গাত্রদাহ হয়। তারা ফতোয়া দেয় আমার শিরক হয়েছে, প্রতিমাদর্শন পাপ। উত্তরে আমি বলি প্রতিমা দেখলে ধর্ম যায় এটা আমি বিশ্বাস করি না। পূজামণ্ডপে সকল ধর্মের লোক যায়। এজন্যই দুর্গাপূজাকে সার্বজনীন বলা হয়। আমাদের রাষ্ট্রের একটি মৌল নীতি হলো, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’ আমার ঐ স্ট্যাটাস দেখে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া নিবাসী একজন ছাত্রী ও তার বন্ধু (আমেরিকা নিবাসী) আমাকে ইসলাম ধর্মের ওপর জ্ঞান দেয়। আমি বলি আমাকে নসিহত করে লাভ নেই। আমি গোঁড়া নই। যেহেতু আমি তার ভূতপূর্ব শিক্ষক তাই সে যা বলেছে বিনয়ের সাথেই বলেছে। কিন্তু তার বন্ধুটি ছিল রূঢ়। সে এক পর্যায়ে আমাকে ভারতে গিয়ে থাকতে পরামর্শ দেয়। আমি তার ঔদ্ধত্য দেখে বিস্মিত হই। ভাবি মিয়ানমারে এ ধরনের লোকেরাই রোহিঙ্গাদের দেশচ্যুত করেছে। আমি তাকে বলতে পারতাম আমি উচ্চশিক্ষার জন্য পাঁচ বছর ভারতে থেকেছি। এই দীর্ঘ সময়ে আমি কখনও সাম্প্রদায়িকতার শিকার হইনি। কোন কটুবাক্য শুনিনি। আমি বলছি না যে ভারতে সাম্প্রদায়িকতা নেই, প্রবলভাবেই আছে, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ঐরূপ। মুসলমান হিসেবে আমি কোন বৈষম্যের শিকার হইনি, আমার হিন্দু বন্ধুরা আমাকে কখনোই অবজ্ঞা করেনি, বরং ভিন্নধর্মের বলে, বিদেশী বলে একটু বেশিই খাতির করেছে।’ এই লেখা আমাদের সমাজেরই বাস্তবতা। পাশাপাশি এটাও আমরা গর্বের সঙ্গে বলে থাকি যে, বাংলাদেশই সেই দেশ যেটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অভূতপূর্ব পুলিশি অ্যাকশন পুলিশ চাইলে অনেক কিছুই পারে তার দৃষ্টান্ত আবারও পেল নগরবাসী। বিষয়টি ছিল একেবারেই অভূতপূর্ব, মানে এর সঙ্গে নগরবাসীর পরিচয় ঘটেনি আগে। পুলিশি-সুরক্ষায় উল্টোপথে চলা রাঘব বোয়ালদের দামী দামী সব গাড়ি হেয়ার রোডে আটকে দিয়েছে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ। জরিমানা করা হয়েছে। এমনকি সেনাসদস্য, পুলিশের কর্তাব্যক্তির গাড়িও উল্টোপথ পেরুতে পারেনি। অভিযানের দ্বিতীয় দিনেও একই নাম্বারপ্লেটযুক্ত গাড়ি আবারও উল্টোপথে যাত্রা করে এবং যথারীতি বাধাপ্রাপ্ত হয়। তৃতীয় দিন থেকে সব গাড়ির মালিকরা অবশ্য সোজা হয়ে যান। আর উল্টোমুখো হননি। আইন তৈরি ও প্রয়োগের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের ভেতর আইন ভাঙার এই অপতৎপরতা যেমন নিন্দনীয়, তেমনি বিপজ্জনক। ক্ষমতার জোরে সড়কে বৈষম্য সৃষ্টিকারী লোকেরা আবারও আইনকে বুড়ো আঙুল দেখালে পুলিশ তার কর্তব্য পালনে পিছপা হবে না- এমনটাই প্রত্যাশিত। ০১ অক্টোবর ২০১৭ [email protected]
×