ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নিরাপত্তা পরিষদ ব্যর্থ!

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ৩ অক্টোবর ২০১৭

নিরাপত্তা পরিষদ ব্যর্থ!

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের রোহিঙ্গা সমস্যা সম্পর্কিত বৈঠকে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকায় বিশ্ববাসীর পাশাপাশি বাংলাদেশও বিস্মিত ও হতবাক। সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়েছে যে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেশ ত্যাগে বাধ্য করা, হত্যা-নির্যাতন-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি ঘটনায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাধিক জোরালো ভূমিকা রেখেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের ভূমিকাও সন্তোষজনক বলতে হবে। তবে রাশিয়া, চীন ও ভারতের ভূমিকা তেমন জোরালো ও আশাব্যঞ্জক নয়। অবশ্য চীন ও ভারত মানবিক কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া কয়েক লাখ শরণার্থীর জন্য ত্রাণ সহায়তা প্রদান করেছে। তবু এই তিনটি দেশের কাছ থেকে বাংলাদেশ ও বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি তবে নিরাপত্তা পরিষদের সব সমস্য এই প্রশ্নে একমত হয়েছে যে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে অব্যাহত হত্যা-নির্যাতন-ধর্ষণসহ ব্যাপক সহিংসতা চালাচ্ছে তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। এতে প্রথমবারের মতো স্বীকার করা হয়েছে যে, রাখাইন রাজ্যে মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাকে সেখানে যেতে হবে। তবে সে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা-নিরাপত্তা রক্ষায় শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানো বা কোন রকম অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব আসেনি। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে আশ্রয় নেয়া বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে সসম্মানে নিরাপদে ফেরত নেয়ার বিষয়েও তেমন ইতিবাচক আলোচনা হয়নি। তাই বলে এই বৈঠককে একেবারে নিস্ফল কিংবা ব্যর্থ, এমন কথাও বলা যাবে না। কেননা, এবারই প্রথমবারের মতো বর্তমান সরকারের ঐকান্তিক আগ্রহ ও উদ্যোগে জাতিসংঘসহ নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি আন্তর্জাতিক পরিসরে উঠে এসেছে। দ্বিতীয়ত, সসম্মানের সমাধানে আশু কোন সমাধান অর্জিত না হলেও কোন পথে এগুনো প্রয়োজন তার একটি রূপরেখা ফুটে উঠেছে। আর অবশ্যই সেটা হলো কূটনৈতিক পথ। অন্তত এই মুহূর্তে সব পক্ষই মতৈক্যের ভিত্তিতে কূটনৈতিক পথে সমস্যা সমাধানের কথা বলেছে। বাংলাদেশের জন্য এটুকুই বা কম কী! বাংলাদেশ মনে করছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ বিশ্বের কয়েকটি শক্তিশালী দেশ এবং বিশ্ববাসী বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গাদের পাশে আছে। জাতিসংঘ থেকে এই বার্তা পাওয়া নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিদায়ক। আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনা প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। মিয়ানমারের এক মন্ত্রী ঢাকা সফরেও এসেছেন। ফলে আপাতত দীর্ঘসূত্রতার আভাস মিললেও শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদান সাপেক্ষে ফেরত নিতে হবে মিয়ানমারকে। তদুপরি রাশিয়া চীন ও ভারত তাদের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ বিবেচনায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে না গেলেও মানবিক স্বার্থ ও অধিকার সমুন্নত রাখতে নৈতিক সমর্থন দেবে বাংলাদেশকে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নিধন ও বাস্তুচ্যুত করার ঘটনা বেশ পুরনো। জাতিসংঘের তথ্য মতে, ১৯৬২ সাল থেকে এটি প্রায় নীরবে হলেও চলে আসছে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায়। ক্রমাগত শোষণ, বঞ্চনা, হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারাও ক্রমাগত দেশত্যাগে বাধ্য হচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৯ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ তার সীমিত সম্পদ, বিপুল জনগোষ্ঠী ও স্বল্পপরিসরে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে সমর্থ নয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর উদারতা, মানবিকতা ও সহানুভূতির কারণে বাংলাদেশ তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সহায় সম্বলহীন শরণার্থীদের জন্য। স্বভাবতই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের এই ঔদার্য ও মানবিকতা বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণেও সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ, যা বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম কূটনৈতিক সাফল্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অদম্য ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবারই প্রথম রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাটি বেশ জোরেশোরে উপস্থাপিত হয়েছে আন্তর্জাতিক পরিসরে এবং জাতিসংঘে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রস্তাবিত ৫ দফা সমস্যাটির সুদূরপ্রসারী সমাধানে প্রভূত সহায়ক হতে পারে। এখন জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায় কিভাবে এই সমস্যাটি সমাধানে অগ্রসর হয়, সেটাই দেখার বিষয়। রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে শান্তি-শৃঙ্খলাসহ সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিতরণে সমন্বয় সাধন করতে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে। আশ্রিত রোহিঙ্গারা যাতে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেদিকও লক্ষ্য রাখা হচ্ছে। এখন যত দ্রুত তারা মিয়ানমারে সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে পুনর্বাসিত হতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায়কে।
×