ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গাদের নতুন পরিচিতি দেয়ার সিদ্ধান্ত

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ১ অক্টোবর ২০১৭

রোহিঙ্গাদের নতুন পরিচিতি দেয়ার সিদ্ধান্ত

তৌহিদুর রহমান ॥ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য একটি নতুন পরিচিতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তারা বাংলাদেশে এখন থেকে ‘মিয়ানামারের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষ’ হিসেবে অভিহিত হবেন। রোহিঙ্গারা এখনই কোন ‘শরণার্থী মর্যাদা’ পাবেন না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশ নতুন করে একটি পরিচিতি দিতে চায়। এসব নাগরিককে অনেকেই শরণার্থী হিসেবে অভিহিত করলেও প্রকৃতপক্ষে তারা শরণার্থী নয়। আবার কেউ কেউ তাদের অনুপ্রবেশকারী বলছেন। তবে এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের কী নামে ডাকা হবে, সে সমস্যার সমাধান করেছে সরকার। এসব রোহিঙ্গা অফিসিয়ালি এখন থেকে ‘মিয়ানমারের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষ’ হিসেবে অভিহিত হবেন। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের আগে থেকে সরকার ‘আনডকুমেন্টেড পিপল’ বা ‘স্বীকৃতিহীন মানুষ’ বলে অভিহিত করে আসছিল। তবে আগে থেকেই কক্সবাজারের নয়াপাড়া ও কুতুপালং ক্যাম্পে থাকা প্রায় ৩২ হাজার রোহিঙ্গা নাগরিককে ‘শরণার্থী’ মর্যাদা দিয়েছে সরকার। এর বাইরের প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গাকে সরকার ‘আনডকুমেন্টেড পিপল’ বলে অভিহিত করে আসছিল। তবে ২৫ আগস্ট রাখাইনে সহিসংতার পর এখন নতুন করে আরও পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। বাংলাদেশে এখন নয় লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন। এসব রোহিঙ্গা এখনই শরণার্থী মর্যাদা পাবেন না। রোহিঙ্গাদের এখন বাংলাদেশ অফিসিয়ালি ‘মিয়ানমারের জোরপূর্বক বাস্তচ্যুত মানুষ’ হিসেবে অভিহিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সূত্র জানায়, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের উদ্যোগে ১৯৫১ সালে শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার অফিস (ইউএনএইচসিআর) প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিশ্বজুড়ে শরণার্থীদের জন্য ইউএনএইচসিআর কাজ করছে। শরণার্থীদের মর্যাদায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক ১৯৫১ সালের কনভেনশনে সই করলেও বাংলাদেশ এতে সই করেনি। সে কারণে রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে মর্যাদা দিতে বাধ্য নয় বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের সাধারণ মানুষ শরণার্থী হিসেবে অভিহিত করছেন। এমনকি গণমাধ্যমও তাদের শরণার্থী বলছেন। তবে এসব মানুষ প্রকৃতপক্ষে শরণার্থী নন। আমরা আগে এদের আনডকুমেন্টেড পিপল বলে অভিহিত করেছি। বতর্মানে এদের ‘মিয়ানমারের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষ’ হিসেবে অভিহিত করছি। তিনি বলেন, প্রতিটি শব্দেরই একটি অর্থ আছে। আমি সচেতনভাবে সেই শব্দগুলো ব্যবহার করতে চাই। সূত্রমতে, বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের সাধারণভাবে শরণার্থী হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। বিদেশী অতিথিরা তাদের শরণার্থী বলছেন। এমনকি বাংলাদেশ সফরে আসা জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ গ্র্যান্ডিও রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে অভিহিত করেন। তবে বাংলাদেশ সরকার এসব রোহিঙ্গাকে কোনভাবেই শরণার্থী হিসেবে অভিহিত করতে রাজি নয়। কেননা শরণার্থী হিসেবে মর্যাদা দিলেই শরণার্থী বলা যায়, তাছাড়া শরণার্থী বলা যায় না। সে কারণে বাংলাদেশ সরকারের নীতিনির্ধারকরা এখনই রোহিঙ্গাদের শরণার্থী মর্যাদা দিতে রাজি নয়। আর এ শব্দটি ব্যবহার করার পক্ষপাতী নয়। রোহিঙ্গাদের শরণার্থী মর্যাদা দিলে সমস্যা আরও দীর্ঘ হতে পারে। কেননা শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর সহজেই বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের আর ফেরানো সম্ভব হবে না বলে মনে করছে সরকার। সে কারণে শরণার্থী মর্যাদা দেয়ার বিষয়ে সরকারের অনীহা রয়েছে। দুর্যোগ ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া জানিয়েছেন, মিয়ানমার থেকে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তারা অনুপ্রবেশকারী। বাংলাদেশ সরকার মানবিক কারণে সাময়িকভাবে তাদের আশ্রয় দিয়েছে। আর বাংলাদেশে আসার পর যেসব শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েছে তারা মিয়ানমারের নাগরিক। তাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবেই বাংলাদেশ সরকার জন্মসনদ দিচ্ছে। মা ও শিশু উভয়ই মিয়ানমারের নাগরিক। তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে। এদিকে বাংলাদেশে শরণার্থী বিষয়ে কোন আইন না থাকায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে সম্প্রতি একটি রিট আবেদন করা হয়েছে। এ রিটে শরণার্থী বিষয়ে আইন প্রণয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না- এই মর্মে রুল চাওয়া হয়েছে। এতে আইন সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও পররাষ্ট্র সচিবকে বিবাদী করা হয়েছে। রিটে বলা হয়েছে, সম্প্রতি কয়েক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী দেশে আশ্রয় নিয়েছে। পাকিস্তানী নাগরিক বিহারীরাও শরণার্থী হিসেবে বসবাস করে আসছে। সরকার জাতিসংঘ সনদ ও সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার প্রতি সম্মান রেখে মানবিক দিক বিবেচনায় শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ১৯৫১ সালের শরণার্থীবিষয়ক কনভেনশন ও ১৯৬৭ সালের শরণার্থীবিষয়ক প্রটোকলে সই করেনি। এই কনভেনশন ও প্রটোকলে সই না করায় শরণার্থী সঙ্কট মোকাবেলা করা অনেকটা দুরূহ। এমনকি শরণার্থীসংক্রান্ত দেশে কোন নির্দিষ্ট আইন নেই। এ সংক্রান্ত আইন না থাকায় ওই বিশাল শরণার্থী জনগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ করা ও তাদের সুরক্ষার পাশাপাশি দেশের নাগরিকদের সঙ্গে শরণার্থীদের সম্পর্ক নির্ধারণ, তাদের প্রাত্যহিক জীবনযাপন এবং শরণার্থী সন্তানদের নাগরিকের বিষয়টি সুরাহা করা সম্ভব নয়। এছাড়া বাংলাদেশের নিরাপত্তা, পর্যটনশিল্পের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, কর্মসংস্থান ও অভ্যন্তরীণ সার্বিক বিষয় মোকাবেলায় কোন আইনী কাঠামো না থাকায় এ নিয়ে বিরাট শূন্যতা দেখা দিতে পারে।
×