ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ইস্যুতে মূল্য দিচ্ছে বাংলাদেশ

ভোটের রাজনীতির বলি হয়েছে ত্রিদেশীয় সম্পর্ক!

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ১ অক্টোবর ২০১৭

ভোটের রাজনীতির বলি হয়েছে ত্রিদেশীয় সম্পর্ক!

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ নিকট প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক যেমন নির্ভরতার হওয়া উচিত তা নেই বাংলাদেশ, ভারত এবং মিয়ানমারের মধ্যে। ভোটের রাজনীতির কারণে ত্রিদেশীয় সম্পর্ক সীমিত হয়ে আছে কেবলই পণ্য বেচাকেনার মধ্যে। প্রতিবেশী এই তিন দেশের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্য থাকলেও আঞ্চলিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। ফলত, নির্ভরতার ক্ষেত্রটিও তেমন নয়, যার মাসুল গুনতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের এমন দুঃসময়ে পরীক্ষিত বন্ধু ভারত পাশে নেই কেন? কেনই বা এত বৈরি হলো প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার? এমন অনেক প্রশ্ন এখন বেশ আলোচিত। কিন্তু কিছু ভোগ্যপণ্য বেচাকেনা বা আমদানি-রফতানির বাইরে কোন সম্পর্কটি গড়ে উঠেছে, তাও বিশ্লেষণের দাবি রাখে বৈশ্বিক বাস্তবতায়। পারস্পরিক অনাস্থা, অবিশ্বাসের নেপথ্যে মূলত বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতি। বাস্তবতা হলো, বিগত প্রায় পাঁচ দশকেও বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত এবং মিয়ানমারের স্বার্থসংশ্লিষ্টতার সম্পর্ক তৈরি হয়নি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেন মূলত ভোট চায়, পারস্পরিক সম্পর্কোন্নয়ন নয়, যা যুক্তি দিয়ে প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের চেয়ে এখন মিয়ানমারেই যে ভারতের স্বার্থ বেশি, তা এখন বেশ পরিষ্কার। এর জন্য বাংলাদেশের অদূরদর্শিতাও কম দায়ী নয়। ভারত বহুদিন যাবত তার ভূমিবদ্ধ পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যের জন্য বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর সুবিধা চেয়ে আসছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় ভোটের রাজনীতি। এতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব চলে যাবে, এমন মনোভাব ভারতবিরোধী দলগুলোর। সুতরাং দেয়া যাবে না ভারতকে ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্ট। কিন্তু ভারতের যেহেতু বন্দর সুবিধা বড়ই প্রয়োজন, সেহেতু তারা বসে থাকেনি। ভারত মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে অবস্থিত সিটওয়ে বন্দর সম্প্রসারণ করে নিয়েছে নিজের অর্থায়নে। জলপথে পণ্য পরিবহনের জন্য রাখাইন থেকে মিজোরাম পর্যন্ত স্থাপিত হয়েছে নৌ যোগাযোগ। শুধু তাই নয়, মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে অর্থনীতিকে পূর্বমুখী করার মহা পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে ভারত। বাংলাদেশ-ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে ত্রিদেশীয় গ্যাস পাইপ লাইন স্থাপনের প্রস্তাবটিও বহুদিনের। মিয়ানমারের গ্যাস ভারতের ত্রিপুরা হয়ে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যাবে কলকাতায়। কিন্তু সেখানেও হুমকির মুখে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব! ২০০৪ সালে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নীতিগত সম্মতি জানানো হলেও পরে নানা হিসাবনিকাশে পিছিয়ে যায় বাংলাদেশ। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী পাইপ লাইন স্থাপনের পুরো ব্যয় বহন করত ভারত, আর বাংলাদেশ পেত ট্রানজিট ফি বাবদ বছরে ১২৫ মিলিয়ন ডলার। তাছাড়া বাংলাদেশও মিয়ানমার থেকে গ্যাস পেতে পারত বেশ সহজেই। বর্তমানে দেশে গ্যাসের সঙ্কট তীব্র। বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য সার কারখানা শাটডাউন দিতে হয়, আর সার উৎপাদনের চাকা সচল রাখতে বন্ধ রাখতে হয় বিদ্যুত কেন্দ্র। এমন একটি সুযোগও হাতছাড়া হয়েছে সস্তা ভোটের রাজনীতির কারণে। বৈশ্বিক আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কগুলোর দিকে লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, নিকট প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক থাকে খুবই নিবিড় এবং অনেকটাই অবারিত। সে সম্পর্ক হয় কানেকভিটি এবং নির্ভরশীলতার। প্রতিবেশী একদেশ অন্য দেশের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু এ অঞ্চলের বাস্তবতা তা নয়। সম্পর্ক মূলত ভোগ্যপণ্য আমদানি রফতানি তথা বেচাকেনার বাইরে যায়নি। রয়েছে চরম অবিশ্বাস এবং ভুল বুঝাবুঝি। একদেশকে ছাড়া অপর দেশের চলছেই না, এমন সম্পর্ক না হলে পরিণতি যা হবার তা-ই হচ্ছে। বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার যেন কাছাকাছি হয়েও অনেক দূরে। এ তিন দেশের মধ্যে সম্পর্কটা নির্ভরশীল না হয়ে বরং হয়ে পড়েছে অনাস্থার। ভারত যদি বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করত এবং বাংলাদেশও যদি ভারতের ওপর দিয়ে নেপাল-ভুটানে পণ্য আনা নেয়া করত তাহলেই সম্পর্কটা হত নির্ভরতার। ত্রিদেশীয় পাইপ লাইন হলে মিয়ানমার থেকে ভারতে গ্যাস যেত বাংলাদেশের উপর দিয়ে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্কটাও জড়িয়ে যেত স্বার্থের বেড়াজালে। এতে লাভবান হত প্রতিবেশী তিনটি দেশই। কিন্তু বর্তমান অবস্থা এমন যে, বাংলাদেশের ওপর নির্ভর না করলেও চলছে মিয়ানমারের। ভারত যেহেতু ট্রানজিট হিসেবে মিয়ানমারকে ব্যবহারের পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে, সেহেতু ওই দেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ রাখা জরুরী হয়ে পড়েছে। মিয়ানমার থেকে পাইপ লাইনে জ্বালানি তেল যাচ্ছে চীনে, গ্যাস যাচ্ছে থাইল্যান্ডে। মিয়ানমার ও চীনের ইউনান প্রদেশের মধ্যে স্থাপিত হতে যাচ্ছে দীর্ঘ গ্যাস পাইপ লাইন। চীন এবং ভারতের সঙ্গে এতটা সহযোগিতার সম্পর্কের পরও মিয়ানমারের স্বাধীনতা বা সার্বভৌমত্ব যাচ্ছে না। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিশেষ করে কানেকটিভিটির প্রশ্নে এসে যায় রাজনৈতিক বিরোধিতা। মিয়ানমার দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ থাকায় সে দেশে বিদেশী বিনিয়োগও ছিল একপ্রকার বন্ধ। এখন উন্মুক্ত হওয়ায় চীনের পাশাপাশি ভারত, রাশিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ তৎপর হয়েছে দেশটির সঙ্গে নানামুখী সম্পর্ক উন্নয়নে। অবস্থা এমন যে, আঞ্চলিক রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে মিয়ানমারের গুরুত্ব যতই বাড়ছে, ততই প্রতিবেশীদের কাছে কমতে শুরু করেছে বাংলাদেশের গুরুত্ব। ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দও বলছেন, মিয়ানমার এত নিকটতম প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক সে পর্যায়ে গড়ায়নি। দুটি দেশই বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী। অথচ দু’দেশের বন্দরের মধ্যে সরাসরি নৌ যোগাযোগ পর্যন্ত সৃষ্টি হয়নি। চট্টগ্রাম থেকে একটি জাহাজ ইয়াঙ্গুনে যেতে সময় লাগে মাত্র একদিন, আর টেকনাফ থেকে সময় লাগে সর্বোচ্চ আট ঘণ্টা। কিন্তু মিয়ানমারের সঙ্গে নৌ প্রটোকল চুক্তি না থাকায় জাহাজগুলোকে চলাচল করতে হয় সিঙ্গাপুর ঘুরে। ভারতের ক্ষেত্রে সম্পর্কটিও আরও নির্ভরতার হতে পারত। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সেক্ষেত্রে উদার হতে পারেনি। ভোটের রাজনীতির বলি হয়েছে ত্রিদেশীয় নির্ভরতার সম্পর্ক। সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠায় পারস্পরিক সম্পর্ককে শুধু কেনাবেচার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সহযোগিতামূলক বন্ধনে রূপ দেয়ার বিকল্প নেই বলে মনে করেন অর্থনৈতিক এবং উদার রাজনীতিক অভিজ্ঞ মহল।
×