ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপ্ন পূরণের দিন ৩০ সেপ্টেম্বর

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ১ অক্টোবর ২০১৭

স্বপ্ন পূরণের দিন ৩০ সেপ্টেম্বর

স্টাফ রিপোর্টার, মুন্সীগঞ্জ ॥ স্বপ্ন নয় বাস্তবে পদ্মা সেতু! পদ্মার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে পদ্মা সেতু। তাই ৩০ সেপ্টেম্বর একটি ইতিহাস হয়ে থাকল। ১৭ কোটি বাঙালীর স্বপ্ন পূরণের দিন এটি। প্রাণের আশা পূরণের ক্ষণ এটি। তাই শুধু এই আনন্দ পদ্মা বহুমুখী সেতুতে কর্মরত দেশী- বিদেশীদের নয়, ছাপিয়ে গেছে পদ্মা তীরের জনপদ ছাড়াও টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। পদ্মা মূল সেতুর পরিবেশ বিষয়ক পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন খুলনার সাইফুল ইসলাম। তিনি এই স্প্যান ওঠানোর সময় পদ্মায় ছিলেন। তখনই তিনি জানালেন তার নিজ এলাকা খুলনার মানুষও এই খবরটি জানতে কত বেশি আগ্রহী। আর স্বপ্ন যে এখন বাস্তব সেই ক্ষণটি নিয়ে কত কৌতূহল। সেতুতে মোট ৪২টি খুঁটির (পিলার) এক খুঁটি থেকে আরেক খুঁটির দূরত্ব ১৫০ মিটার। এই দুটি খুঁটির মাঝে সেতু তৈরি হওয়ায় এই আনন্দ আর বাকি ৪০টি এমন স্প্যান বসানোর পর সেই আনন্দ কত বেশি গভীর হবে সে কথা জানালেন, লৌহজং উপজেলার চেয়ারম্যান ওসমান গনি তালুকদার। তিনি বললেন, বাংলাদেশের চেহারাই পাল্টে যাবে এই সেতু চালুর পর। ১৫০ মিটার দূরত্বের লম্বা ইস্পাতের কাঠামো বা প্যান জোড়া দিয়েই সেতু নির্মিত হবে। পদ্মা সেতুর প্রতিটি খুঁটির নিচে ছয়টি করে পাইল বসানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে নদীতে পাইলের সংখ্যা ২৪০টি। ইস্পাতের এসব পাইল মাটির নিচে ৯৬ থেকে ১২৮ মিটার পর্যন্ত গভীরে বসানো হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৬৮টি পাইলিংয়ের কাজ স¤পন্ন হয়েছে। আরও ১৭টি পাইল বসানোর কাজ চলমান আছে। স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে ছিল অনেক বাধা আর বিপত্তি। সেই বাধাদানকারী সকলের মুখে এখন চুন-কালি। আর যে কলঙ্কের তিলক আঁকার অপেষ্টা হয়েছিল বাঙালীর মুখে, সেই বাঙালীর আজ গর্বের হাসি। এই উক্তি করলেন কনকসারের প্রবীণ রাজনীতিক মনির হোসেন মাস্টার। পেছনে তাকালে দেখা যায়, ২০১৪ সালের ১৮ জুন মূল সেতু নির্মাণে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পনির সঙ্গে চুক্তি সই করে সরকার। তাতে খরচ ধরা হয় ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। আর নদীশাসনের কাজ করছে চীনেরই আরেক প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন। তাদের সঙ্গে চুক্তি হয় ২০১৪ সালের নবেম্বরে। এই কাজের খরচ ধরা হয় ৮ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া দুই প্রান্তে টোল প্লাজা, সংযোগ সড়ক, অবকাঠামো নির্মাণ করছে দেশী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পদ্মা সেতুর প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত ১৪ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে বলে প্রকল্পের কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে। দ্বিতলবিশিষ্ট পদ্মা সেতু হচ্ছে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরার মধ্যে। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য (পানির অংশের) ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। ডাঙার অংশ অর্থাৎ সংযোগ সেতু ধরলে সেতুটি প্রায় ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে। খুঁটির ওপর ইস্পাতের যে স্পপ্যান বসানো হবে, এর ভেতর দিয়ে চলবে ট্রেন। আর ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন। পদ্মায় বিশেষ মুহূর্ত পদ্মায় শনিবার শরতের সকালটি ছিল বিশেষ আকর্ষণীয়। নিল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা না থাকলেও আকাশ ছিল চমৎকার। এই নির্মল আকাশের নিচে রোদের ঝিলিকে জ্বল জ্বল করছিল পদ্মা। আর নদীর পাশে বিস্তীর্ণ জমিতে ঘন কাশবনের বিশেষ জৌলুস ছড়াচ্ছিল। এরই মাঝে পদ্মায় নানা ধরনের নৌযান চলছে। কিন্তু সকলের চোখ জাজিরার দিকে। শিমুলিয়া ঘাট থেকে মাঝনদীতে আসতেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সেতুর অবয়ব। ওই দূরে দেখা যাচ্ছে পদ্মা সেতুর পিলার। তার ওপর ধীরে ধীরে বসিয়ে দেয়া হচ্ছে স্পপ্যান। আকাশে মেঘ নেই! নেই ঘনকালো অন্ধকারও। স্বপ্ন বাস্তবে। এ গর্ব বাঙালী জাতির তথা বাংলাদেশের! শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু বাস্তবায়ন বড় একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। বিশ্বে আমাজন নদীর পরই অন্যতম দীর্ঘতম ও খরস্রোতা এই নদীর গভীরতা ও স্রোতের প্রখরতা জয় করে সেতু নির্মাণ একধাপ এগিয়ে গেল। অনুভূতি জানাতে গিয়ে উদ্বেলিত সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বললেন, বঙ্গোপসাগরের উর্মিমালার মতো উদ্বেল আমাদের হৃদয়। পদ্মার আকাশের সব মেঘ কেটে গেছ। অথচ গতকালও আকাশ ছিল মেঘে ঢাকা। আজ মেঘ নেই। পদ্মায় স্প্যান ঘিরে উদ্বেল আনন্দ চারদিকে। মন্ত্রী কাদের বলেন, পদ্মা সেতুর দীর্ঘপথ পরিক্রমার এটি একটি মাইলফলক। যিনি এর কুশীলব,যিনি এর রূপকার, তিনি এখানে অনুপস্থিত। এ শুভক্ষণে প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতির কারণ জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বললেন, শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘তোমরা পারবে’ ওয়াশিংটন থেকে শেখ হানা।’ স্বপ্ন সত্যি হওয়ার আনন্দ স্বপ্ন সত্যি হলো! একেবারে সামনাসামনি, চোখের সামনে পদ্মা সেতু। ভাবতেই অন্যরকম। ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যাযান বসে যাওয়ার পর চারদিকে এমন নানা অভিব্যক্তি। এ স্প্যান বসানোর পর এখন দেখা যাচ্ছে একটি সেতুর কাঠামো। আপাতত ১৫০ মিটার। তবে পুরো কাজ শেষ হলে এমন আকৃতি দেখাবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। ধূসর রঙের সেতুর স্প্যান ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যর। নদীর পানি থেকে এর উচ্চতা ৫০ ফুট। রাতে সেতুতে সোনালি আলো ফেলা হবে। দিনে ধূসর, রাতে সোনালি এমনটাই দেখা যাবে পদ্মা সেতু। প্রথম স্প্যান স্থাপনের পর সাংবাদিকদের কাছে অনুভূতি ব্যক্ত করে ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রধানমন্ত্রীর একক নেতৃত্বের সোনালি ফসল এটি। এখানে অপূর্ব সুন্দর পরিবেশ। নদীর ধারে কাশবন। বঙ্গোপসাগরের উর্মিমালার মতো উদ্বেল আমাদের হৃদয়। যেন পদ্মার আকাশের সব মেঘ কেটে গেছে। যেমনটি গতকালও ছিল মেঘে ঢাকা। আজ মেঘ কেটে গেছে। সেতুর সুন্দর অবয়ব আর ভারি ভারি সব ক্রেন আর যন্ত্রপাতি দেখেই বোঝা যাচ্ছে কত বড় কাজ হচ্ছে এখানে। স্প্যান বসানো শেষে সাংবাদিকরা যখন ফিরে এলো শিমুলিয়া ঘাটে তখনই শরতের বৃষ্টি। রোদেলা দুপুরে প্রশান্তির এই বৃষ্টি যেন পদ্মা আরেক পরিবেশ তৈরি করে। প্রকৃতি যে পদ্মা সেতুর পক্ষে তারই প্রমাণ মিলে। পরিবেশ বিজ্ঞানী আরিফুর রহমান বলেন, প্রকৃতি সব সময় ভাল কাজের পক্ষে। আর প্রভুও ভাল কাজে সহায়তা করে। তা যুগে যুগেই প্রমাণিত। আর সে কারণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অসীম সাহসিতকায় নানাভাবেই প্রভুর রহমত দৃশ্যমান হয়েছে। পদ্মা সেতুর এক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা সরকারী চাকরি করি। কিন্তু স্পষ্ট বলে দিতে পারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে এত বড় প্রকল্পের কাজ হাতে নিয়ে শুধু অসীম সাহসই নয় বড় ধরনের সাহসিকতার ছাপ রেখেছেন। যার সফলতায় বাঙালীর ভাগ্য পরিবর্তন নয়, বিশ্বে বাঙালীকে এখন অন্যভাবে পরিচয় ঘটিয়েছে।
×