ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা বিতাড়নে মিয়ানমারের সব জাতিগোষ্ঠী এককাট্টা

প্রকাশিত: ০৫:০১, ১ অক্টোবর ২০১৭

রোহিঙ্গা বিতাড়নে মিয়ানমারের সব জাতিগোষ্ঠী এককাট্টা

চট্টগ্রাম অফিস/কক্সবাজার প্রতিনিধি ॥ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমার অভ্যন্তরীণ সংঘাতের জন্য পরিচিত। কিন্তু একটি বিষয়ে দেশটির বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এককাট্টা। সেটা হচ্ছে তারা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক মনে করে না। হাজারো বিভক্তির মধ্যেও এটাই যেন হয়ে উঠেছে দেশটির জাতীয় ঐক্যের প্রতীক! এমনকি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিন্দার মুখেও এ বিষয়ে ন্যূনতম ছাড় দিতে রাজি নয় বার্মিজরা। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট শনিবার এ সংক্রান্তে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিনের নিপীড়ন, নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকৃতি এবং মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ফল চলমান রোহিঙ্গা গঙ্কট। আমাদের পূর্বসূরিদের ধন্যবাদ। তারা একটি চুক্তি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ফলে আমাদের নাগরিকত্ব রয়েছে। অন্যথায় আমাদেরও তাদের (রোহিঙ্গা) মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হতো। রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথাগুলো বলছিলেন লিউ রুনকাং নামের এক স্বেচ্ছাসেবী। উত্তর মিয়ানমারের লাশিওতে ককাং সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদের প্রধান কার্যালয়ে স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করেন লিউ রুনকাং। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে তার কথাগুলো দৃশ্যত বাস্তবসম্মত। কিন্তু রোহিঙ্গারা যে পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে, তাতে তাদের প্রতি তার নিজের মধ্যে কোন সহানুভূতি কাজ করে কি না? সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এমন প্রশ্নের উত্তরে লিউ বলেন, মোটেই না। শেষ পর্যন্ত আমরা মিয়ানমারিজ এবং তারা বহিরাগত। ককাংয়ের জনসংখ্যা ১৩ লাখ। রাজ্যটিতে শরণার্থী সঙ্কট রয়েছে। সেনাবাহিনী ও মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক এ্যালায়েন্স আর্মির সংঘাতে প্রায় দুই লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী, বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটি প্রধানত আটটি আদিবাসী জাতির। জাতিগুলোর মধ্যে রয়েছে বামার, চিন, কাচিন, কাইয়েইন, কায়াহ, মন, রাখাইন ও শান। এই আদিবাসী জাতিগুলোর ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। লিউয়ের মতো ককাংরা মূলত চীনা। কিন্তু তারা শান হিসেবে চিহ্নিত। বিপরীতে রোহিঙ্গারা দেশটির স্বীকৃত ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে নেই। ফলে তাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্বও নেই। এক সময় বর্মা হিসেবে পরিচিত মিয়ানমার ১৯৪৮ সালে যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। তখন রোহিঙ্গারা দেশটির রাজনৈতিক কর্মকা-ে অংশ নিতে পারত। রোহিঙ্গারা রাখাইনে (সাবেক আরাকান) দ্বাদশ শতাব্দী থেকে বাস করে আসছে। ১৯৭৭-৭৮ সালে কথিত ‘অবৈধ অভিবাসীদে’র বিরুদ্ধে নৃশংস সামরিক অভিযান শুরু করে মিয়ানমার। ওই সময় প্রথম রোহিঙ্গাদের ঢল নামে বাংলাদেশে। এক বছর পর অনেক রোহিঙ্গা নিজ দেশে ফিরলেও ১৯৮২ সালে সামরিক শাসকরা তাদের নাগরিকত্ব ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অধিকার কেড়ে নেয়। এরপর থেকেই রোহিঙ্গাদের বিভীষিকাময় জীবনযাপন করতে হচ্ছে। ২৫ আগস্ট শুরু হওয়া সহিংসতায় দীর্ঘদিন পর ১৯ সেপ্টেম্বর মুখ খোলেন দেশটির ডি ফ্যাক্টো নেতা আউং সান সুচি। ৩০ মিনিটের ভাষণে তিনি রোহিঙ্গা বা জাতিগত নিধনের বিষয় উল্লেখ করেননি। তার ভাষণের সময় সেন্ট্রাল ইয়াঙ্গুনে সমর্থকরা মিছিল করে। তাদের স্লোগান ছিল ‘বাঙালীরা মিয়ানমারের নাগরিক নয়’, ‘আমরা সুচিকে সমর্থন করি, আমরা সরকারকে সমর্থন করি, আমরা সেনাবাহিনীকে সমর্থন করি’। সাধারণভাবে বার্মিজরা রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশকারী মনে করে এবং তাদের ‘বাঙালী’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধের মধ্যেও একটি বিষয়ে তারা ঐক্যবদ্ধ। আর তা হলো: মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের কোন ঠাঁই নেই। রাখাইনে চলমান সহিংসতা নিয়ে একটি কার্টুন এঁকে আলোচিত-সমালোচিত দেশটির কাটুর্নিস্ট ফাউং টানে। তিনিও সরকার ও সুচি’র মতো রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহারে রাজি নন। এর পরিবর্তে তাদের তিনি ‘নৌকার মানুষ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কাটুর্নিস্ট ফাউং টানে বলেন, আমরা জানি তাদের হত্যা করতে বা সাগরে ফেলে দিতে পারব না। কিন্তু তাদের সঙ্গে ধর্মীয় পার্থক্য থাকায় শান্তিপূর্ণভাবে একসঙ্গে বসবাস করা প্রায় অসম্ভব। আরেক কার্টুনিস্ট ইউ টিন মিইন্ট বলেন, ‘বাঙালীরা’ এখানে অনেক বছর ধরে বাস করছে। কারণ রাখাইন হয়ে আমাদের দেশে প্রবেশ করা সহজ। আমরা যদি তাদের নাগরিকত্ব দেই, নিজেদের ভূখ- দেই, তাহলে আরও অনেক রোহিঙ্গা আসবে। আমি মনে করি অনেক মানবাধিকার গোষ্ঠী সরকারকে চাপ দিচ্ছে যাতে আরও বেশি রোহিঙ্গা আমাদের দেশে আসতে পারে। কিন্তু তাদের দাবি অনুযায়ী, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও ভূখ-ের অধিকার দিলে সেটা খুবই ভয়াবহ এবং বিপজ্জনক হবে। টিন মিইন্ট আরও বলেন, আমরা যদি তাদের দাবি মেনেও নেই তারপরও সংঘাত আরও বাড়বে। কারণ তাদের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। অবশ্য যদি তারা এখানে শান্তিপূর্ণভাবে থাকতে চায়, তাহলে আমরা তাদের সীমিত অধিকার দিয়ে অভিবাসী হিসেবে রাখতে পারি। এতে তাদের রাজনৈতিক ও নাগরিকত্বের অধিকার থাকবে না। নাগরিক হিসেবে আমরা যেসব অধিকার ভোগ করি সেগুলো তাদের থাকবে না। কিন্তু এখানে শান্তিপূর্ণভাবে বাস করতে পারবে। এ জন্য সংঘাত এড়াতে সরকারকে রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থান ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। মিয়ানমারের সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী, দেশটির মোট জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৩ শতাংশ মুসলিম (রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাদে)। রাখাইনে সহিংসতায় মিয়ানমারজুড়ে মুসলমানদের মধ্যে উদ্বেগ বিরাজ করছে মিয়ানমারের ইসলামবিষয়ক কাউন্সিলের যুগ্ম সম্পাদক ইউ উন্না শেইউ বলেন, রাখাইনে যা ঘটছে সেজন্য সারাদেশের সব মুসলিম সম্প্রদায় কমবেশি আক্রান্ত হচ্ছে। ১০ সেপ্টেম্বর মুসলমানদের মালিকানাধীন দোকান ও ঘরবাড়ি ভাংচুর করা হয়েছে সেন্ট্রাল মিয়ানমারের মাগওয়েতে। এর দুদিন পর ইয়াঙ্গুনে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওই ব্যক্তি রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেছিল, রাস্তায় কি কোন মুসলমান আছে? বেরিয়ে আয়! আমি তোকে হত্যা করব। মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিরাও হামলার শিকার হচ্ছেন। একদল দুর্বৃত্ত সোয়ে চায় নামের এক রাখাইন নারীর চুল কেটে, গলায় প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে পুরো গ্রাম প্রদক্ষিণ করায়। প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘আমি একজন জাতীয় বিশ্বাসঘাতক’। ওই নারীর অপরাধ ছিল এক রোহিঙ্গাকে খাবার দেয়া। ইউ উন্ন শেইউ জানান, সাধারণত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিয়ানমারের অন্য মুসলিম জনগোষ্ঠীর যোগাযোগ খুব কম। তিনি বলেন, আমরা একই ধর্মের হওয়ার পরও জাতিগতভাবে ভিন্ন। তবে কাউন্সিলের পক্ষ থেকে রাখাইনের শরণার্থী শিবিরে সহযোগিতা করা হচ্ছে। আমরা মনে করি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়া উচিত। মিয়ানমার সরকারের তত্ত্বাবধানে রাখাইনে চারদিনের সফরে গিয়েছিলেন উন্ন শেইউ। সফরের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, রাখাইনের মানুষ সম্পর্কে জানতে আমরা সেখানে যাচ্ছি। তারা আমাদের গাড়িতে পাথর ছুড়ে মারে। তারা অনেক সহিংস ছিল। সেখানে আমাদের গাড়ি থামানোর চেষ্টা করা হয়। কর্মকর্তাদের কাছে তারা দাবি করে, আমাদের তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। হাজারখানেক মানুষ সহিংস বিক্ষোভ করছিল। আমাদের গাড়িতে থাকা সবার জীবন তখন হুমকির মধ্যে ছিল। ইসলামবিষয়ক কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক টিন মাউং থান জানান, মিয়ানমারের সাধারণ আতঙ্ক হচ্ছে, মুসলিমরা আমাদের দেশ দখল করবে। তিনি বলেন, মিয়ানমারের জনসংখ্যার মধ্যে মুসলমানরা মাত্র চার শতাংশ। সব সময়ই এই সংখ্যা ছিল। এত ক্ষুদ্র সংখ্যা হয়ে কিভাবে আমরা মিয়ানমার দখল করব? উন্ন শেইউ বলেন, রোহিঙ্গা শিশুদের পড়াশোনার সুযোগ নেই বললেই চলে। যারা ক্যাম্পে বাস করে তাদের স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে বিশেষ অনুমতি নিতে হয়। কাউন্সিল সুচিকে সমর্থন করে জানিয়ে তিনি বলেন, এই সঙ্কট সুচি তৈরি করেননি। একা তিনি এর সমাধানও করতে পারেন না। সেনাবাহিনী ও অন্যান্য দল তাকে সহযোগিতা করতে হবে। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের জানা উচিত, কাদের তারা নিশানা করবে। সুচির ওপর চাপ দিয়ে কোন ফল আসবে না।
×