ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বরিশালের অক্সফোর্ড মিশন

গ্রীক স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত ১১৪ বছরের পুরনো ‘লাল গির্জা’

প্রকাশিত: ০৪:৫৩, ১ অক্টোবর ২০১৭

 গ্রীক স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত ১১৪ বছরের পুরনো ‘লাল গির্জা’

খোকন আহম্মেদ হীরা দেশের অন্যতম অভিজাত ও সুন্দর গির্জা হলো এপিফানী গির্জা বাংলাদেশ চার্চ বা অক্সফোর্ড মিশন বরিশাল। এপিফানী উপাসনালয় এ গির্জার কেতাবি নাম। ১১৪ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী এ গির্জাটি শুধু সুন্দরই নয়, এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ গির্জা এবং দেশের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন পুরাকীর্তিগুলোর একটি। এটি ‘লাল গির্জা’ নামেও পরিচিত। গির্জাটি একতলা হলেও উচ্চতা পাঁচতলা ভবনের সমান প্রায় ৫০ ফুট। গির্জার মূল প্রার্থনাকক্ষটির আয়তনও প্রায় ৫০ ফুট। সিস্টার এডিথের স্কেচ ও ডিজাইন অনুসারে ফাদার স্ট্রং এ গির্জার নক্সা চূড়ান্ত ও উন্নত করেন। এ কাঠামোর প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন ফ্রেডেরিক ডগলাস (ব্রিটিশ)। মূলত গ্রীক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এ গির্জার প্রধান আকর্ষণ বিশাল ও নান্দনিক প্রার্থনাকক্ষ। এর ছাদ কাঠের তৈরি, আর ফ্লোরে সুদৃশ্য মার্বেলের টাইলস্। মূল বেদীর ওপর একটি বড় ক্রশ স্থাপিত রয়েছে। এমন স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যের গির্জা আর দুটি চোখে পড়ে না। চল্লিশটি খিলানের ওপরে এ গির্জাটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। ৩৫ একর জমির ওপরে উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। তেরোটি ছোট-বড় পুকুর, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, আবাসিক ছাত্র হোস্টেল, ফাদার ও সিস্টারদের আবাসন, পাঠাগার ও হাসপাতাল নিয়ে এ চার্চটি অবস্থিত। দিনে সাতবার এশিয়ার সবচেয়ে বড় ঘণ্টা (গির্জার ঘণ্টা) বেজে ওঠে এ চার্চে। সুদৃশ্য ঘণ্টা বেল টাওয়ারের নিচেই চার্চের ছোট্ট অফিস। ১৯০৩ সালে এ চার্চের প্রথম ধাপের কাজ সম্পন্ন হয় ও একই বছরের ২৬ জানুয়ারি এটি উদ্বোধন করা হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপের কাজ ১৯০৭ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। লাল ইট দিয়ে নির্মিত শতবর্ষী এ চার্চ চমৎকার রক্ষণাবেক্ষণের সুবাদে আজও ঝকঝকে। তবে জনসাধারণের জন্য এখানে প্রবেশ সংক্রান্ত জটিলতা রয়েছে। গির্জাটি এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যাতে বড় ধরনের কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগেও এর স্থাপত্যশৈলী বিনষ্ট হবে না। ১৯৬০ ও ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়েও গির্জাটি সম্পূর্ণ অক্ষত থেকে যায়। চার্চের কেয়ারটেকার জানান, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক পরিবেশে নিরাপত্তাজনিত কারণে নিজস্ব সম্প্রদায়ের মানুষ ব্যতীত জনসাধারণের জন্য চার্চের সীমানার ভেতর প্রবেশাধিকার নিষেধ। জীবনানন্দ দাশ ও লাল গির্জা কথিত মতে, কবি জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে তার প্রথম প্রেমিকা মুনিয়ার দেখা হয়েছিল বরিশালের অক্সফোর্ড মিশনের গির্জায়। মুনিয়ার মা ওই গির্জায় সেবিকার কাজ করতেন। শুধু কি তাই? বরিশালের এই পুরনো গির্জাটির সঙ্গে জীবনানন্দের সম্পর্কও ছিল নিবিড়। ছাত্রাবস্থায় অক্সফোর্ড মিশনের ছাত্রাবাসে থাকতেন তিনি। ফলে এখানকার ফাদার ও মাদারদের সঙ্গেও ছিল তার ঘনিষ্ঠতা। জীবনানন্দের বাড়ি থেকে দু-কদম এগুলেই পামগাছ ঘেরা অক্সফোর্ড মিশনের গির্জাটির সীমানা। গাছের ফাঁক দিয়ে তাকালেই দেখা যায় টেরাকোটা রঙের সুউচ্চ আর্চওয়ে চার্চ। এশিয়ার ব্যতিক্রমী এ গির্জার পাশেই রয়েছে একটি বেল টাওয়ার। মূল গির্জার আদলেই গড়ে তোলা বেল টাওয়ারটিতে প্রার্থনার পাঁচ মিনিট আগে ঘণ্টাধ্বনি বাজানো হয়। ঘণ্টাধ্বনির শব্দ শুনেই ভক্তরা এখানে প্রার্থনার জন্য আসেন। বেল টাওয়ারের বেল স্থাপনের খরচ বহন করেছিলেন ফাদার স্ট্রং। তিনি ছিলেন বিখ্যাত ক্রীড়াবিদ। বিভিন্ন খেলায় পাওয়া তার সম্মানী পুরস্কারের অর্থ দিয়ে তিনি ওই বেল স্থাপন করেছিলেন। এ গির্জার সব নির্মাণসামগ্রীই বাংলাদেশের। শুধু ভেতরের চারটি বেদির মার্বেল পাথর আনা হয়েছিল ভারতের কলকাতা ও বড় ক্রুশটি প্যালেস্টাইনের বেথলেহেম থেকে আনা হয়েছিল। এটি দেশীয় মাটি দিয়ে তৈরি আস্তনে পোড়া লাল শক্ত ইট দিয়ে নির্মিত হয়েছিল। এর সঙ্গে রড, বালু, সিমেন্ট, কাঠ এবং নির্মাণশ্রমিক সবই ছিল বাংলাদেশের। আজও এর আদি ও অকৃত্রিম রূপের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। বরিশালের প্রাণকেন্দ্র জীবনানন্দ দাশ সড়কে অবস্থিত শতবর্ষী এ গির্জাটির সঙ্গে জীবনানন্দের কতটা সখ্য ছিল, তার প্রথম প্রেমিকা মুনিয়ার সঙ্গে আদৌ কি এখানে দেখা হয়েছিল? এসব প্রশ্নের সামনে এ উপাসনালয়টি আজও দাঁড়িয়ে আছে ‘লাল গির্জা’ হিসেবে। ব্রিটিশ নাগরিক লুসি হল্ট ও অক্সফোর্ড মিশন বাংলাদেশের জন্ম ১৬ ডিসেম্বর। আমার জন্মও এই দিনে। কাকতালীয় হলেও বিষয়টি আমাকে খুব ভাবায়। হয়তো এটা ঈশ্বরেরই ইচ্ছা। বাংলাদেশের সঙ্গে আমার জীবনের একটা গভীর যোগসূত্র রয়েছে। কথাগুলো বলছিলেন লুসি হল্ট। পুরো নাম লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হল্ট। জন্ম ১৯৩০ সালের ১৬ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের সেন্ট হ্যালেন্সে। ৫৭ বছর ধরে বাংলাদেশে কাজ করছেন তিনি। তার কর্মক্ষেত্রের বেশির ভাগ সময় কেটেছে বরিশালের অক্সফোর্ড মিশনে। মহান মুক্তিযুদ্ধের নিভৃতচারী নীরব সাক্ষী এ মানুষটি যুদ্ধাহত মানুষের সেবা দিয়েছেন অকাতরে। তাইতো এখানকার মায়ায় বরিশালের মাটিতেই মরতে চান লুসি। বরিশাল অক্সফোর্ড মিশন হাসপাতালে মাত্র ৩০ বছরে বয়সে সেবায়েত হিসেবে তিনি যোগদান করেন। দুই বছর পর দেশে ফেরার কথা থাকলেও এখানকার প্রকৃতি, মানুষ ও মাটির ভালবাসায় তাকে মুগ্ধ করে। ৫৭ বছর ধরে চলছে লাল সবুজের দেশের সঙ্গে লুসির মিতালী। গভীর ভালবাসা থেকে রপ্ত করেছেন পুরোপুরি বাঙালীয়ানা। হৃদয়জুড়ে এখন বাংলাদেশের প্রেম। মনে প্রাণে চাচ্ছেন বাংলাদেশ ভাল করুক, উন্নতি লাভ করুক। অক্সফোর্ড মিশন হোস্টেলের একটি ছোট কামরায় বাস করেন এই ব্রিটিশ নাগরিক। ব্রিটিশ শাসকদের শাসন নিয়েও তার মনে ক্ষোভ রয়েছে। তার মতে ব্রিটিশরা এখানে (এই উপমহাদেশে) যা করেছেন তা ঠিক করেননি। মিশনের ভিতরে কবরস্থানে লুসি তার নিজের কবরের জায়গা ঠিক করে রেখেছেন। লুসিকে শান্ত, দরদী ও পরোপকারী হিসেবেই মিশনের সবাই জানেন। অক্সফোর্ড মিশনের ব্যবস্থাপক বেনডিক্ট বিমল ব্যাপারী জানান, ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে মাসে ৭০ পাউন্ড ভাতা পান লুসি। যার প্রায় সবটাই অসহায়দের মাঝে বিলিয়ে দেন লুসি। তিনি আরও বলেন, লুসির সঞ্চয় বলতে কেবলই এ দেশের ভালবাসা। তিনি সব ধর্ম শ্রেণী ও পেশার মানুষকে সম্মান করেন, ভালবাসেন। মিশনের পরিচর্যাকারী ঊষা দাস লুসির ছাত্রী। ঊষা বলেন, প্রথম শ্রেণীতে পড়াশুনা অবস্থায় প্রথম সিস্টার লুসিকে দেখি। তিনি আমাদের স্কুলে পড়াতেন। তিনি আগের মতোই শান্ত আর পরোপকারী এবং দরদী মানুষ।
×