ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নক্ষত্র লোকে ভেসে চলেছে ভয়েজার

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ১ অক্টোবর ২০১৭

নক্ষত্র লোকে ভেসে চলেছে ভয়েজার

এ যেন হোমারের ওডিসির মতো এক মহাযাত্রা যে যাত্রা সুদীর্ঘ এবং উত্তেজনা ও শিহরণে ভরপুর। চল্লিশ বছর মহাশূন্যে ছাড়া হয়েছিল দুটি নভোযান-ভয়েজার-১ ও ভয়েজার-২। নভোযান দুটি এখন সৌরজগতের চৌহদ্দীকে অতিক্রম করে অনন্ত নক্ষত্র লোকের মধ্যে ভেসে চলেছে। আকারে ও ওজনে ছোটখাটো মোটরগাড়ির মতো এই ভয়েজার দুটি সত্তরের দশকের হাইটেকের প্রতীক। ওগুলোর কম্পিউটারের শক্তি আজকের ডিজিটাল ঘড়ির শক্তির চেয়েও দুর্বল। ওগুলোর এনালগ টিভি ক্যামেরাগুলো ল্যাভার্ন ও শার্লির টিভি শো যে ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছিল তার চেয়েও আদিম। তার পরও এরা প্রতিটি গ্রহকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। টেলিস্কোপে বৃহস্পতি গ্রহটিকে শান্ত দেখায়। কিন্তু ভয়েজার দেখিয়েছেন যে, সেখানে শত শত প্রচ- হারিকেন বয়ে চলেছে, উত্তর মেরুতে মেরুজ্যোতির প্রভা আছে এবং তিনটি পাতলা বলয় আছে। শনির বলয় আগে এক হাতের আঙ্গুলে গোনা যেত। এখন দেখা যাচ্ছে যে ছোট ছোট আংটির মতো হাজার হাজার বলয় আছে। সেখানে বাহ্যত রজ্জুর মতো উপাদান আছে যা আগে অসম্ভব বলে ধারণা করা হয়েছিল। জাগ্রত আগ্নেয়গিরি আগে শুধু পৃথিবীতেই দেখতে পাওয়া গেছে। কিন্তু এমন আগ্নেয়গিরি বৃহস্পতির চাঁদ আইওতে এবং বিস্ময়করভাবে নেপচুনের চাঁদ ট্রাইটনেও প্রচুর সংখ্যায় আছে। ট্রাইটনে নাইট্রোজেনের গিজারকে কেলভিন স্কেলের চরম শূন্যের ৪০ ডিগ্রী উপরে উদগীরণ করতে দেখা গেছে। বৃহস্পতির চাঁদ ইউরোপে ও শনির চাঁদ এনসেলাভাসÑসৌরজগতের মধ্যে এই দুটি স্থানে যে প্রাণের অস্তিত্বের সবচেয়ে অনুকূল ও সম্ভাবনাময় পরিবেশ বিরাজমান তা ভয়েজারের মিশনে উদ্ঘাটিত হয়েছে। জোয়ারের প্রভাবে এদের কেন্দ্রস্থল স্পন্দিত ও উত্তপ্ত হয়েছে। এই দুই চাঁদের বরফের নিচে বিশাল লোনা পানির সমুদ্র আছে যেখানে জীবন্ত প্রাণ টিকে থাকতে পারে। বিজ্ঞানের এই বিশাল উদ্যোগের পেছনে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১০ হাজার কর্মবছর। ভয়েজারের অভিযানকে মানুষের এ যাবতকালের পরিচালিত সবচেয়ে বড় অভিযাত্রাগুলোর অন্যতম বলে আখ্যায়িত করা হয়। এই মহাযাত্রার সম্ভাবনাটা মাথায় এসেছিল ১৯৬৫ সালে গ্যারি ফ্লানড্রো নামে এক এরোনটিকস গ্রাজুয়েট ছাত্রের মাথায়। তিনি তখন ক্যালিফোর্নিয়ায় নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরিতে পার্ট-টাইম কাজ করতেন। মঙ্গল ছাড়িয়ে আরও দূরে সম্ভাব্য মিশনের পরিকল্পনার দায়িত্ব পেয়ে প্লানড্রো কাগজ পেন্সিল নিয়ে বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুনের ভবিষ্যত অবস্থানের চিত্র আঁকেন। তিনি লক্ষ্য করেন যে গ্রহগুলো এমন এক এলাইনমেন্টে আসে যে নভোযান একটি গ্রহের ঘূর্ণনগতিকে কাজে লাগিয়ে গুলতি ছোঁড়ার মতো সিøংশট নিয়ে পরের গ্রহটির কাছে যেতে পারে এবং সেটির কাছ থেকেও একইভাবে সিøংশট নিতে পারে। এতে করে নভোযানটি এত পর্যাপ্ত গতি লাভ করবে যে সেটি চারটি গ্রহের সব ক’টিতে ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে যেতে পারবেÑ কয়েক দশক সময় লাগবে না। নাসাকে দিয়ে এই পরিকল্পনাটি গিলাতে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল। কংগ্রেসও সহজে রাজি হয়নি। শেষ পর্যন্ত যখন তা চূড়ান্ত অনুমোদন পেল সবাই ঝটপট কাজে নেমে পড়লেন। নভোযান দুটি যত নিখুঁতভাবে পারা যায় তৈরি করা হলো। নেভিগেশন ব্যবস্থায় সৌর সেন্সরগুলোর শক্তি বাড়ানো হলো যাতে করে সেখানে সূর্যের আলো নিষ্প্রভ হয়ে পড়বে সেখানেও ওগুলো কাজ করবে। জ্বালানি সাশ্রয়ী কৌশলগুলো এমন উন্নত করা হলো যাতে করে মিশন যে সময় শেষ হওয়ার কথা তার পরও দীর্ঘদিন ওগুলো চলতে পারে। ভয়েজার ১ উৎক্ষেপণ করা হয় ১৯৭৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। ভয়েজার ২ এর ক’দিন আগে একই বছরের ২০ আগস্ট। ভয়েজার ১ বৃহস্পতির কাছে পৌঁছে ১৯৭৯ সালের ৫ মার্চ। ভয়েজার ২ পৌঁছে ওই বছরের ৯ জুলাই। শনিতে ভয়েজার ১ পৌঁছে ১৯৮০ এর ১২ নবেম্বর। ভয়েজার ২ পৌঁছে ১৯৮১ এর ২৫ আগস্ট। ভয়েজার ২ ইউরেনাসের কাছে পৌঁছে ১৯৮৬ সালের ২৪ জানুয়ারি এবং নেপচুনের কাছে ১৯৮৯ সালের ২৫ আগস্ট। ২০১২ সালের ১ আগস্ট ভয়েজার ১ সৌরজগতের শেষ প্রান্ত হেলিওস্ফিয়ার অতিক্রম করে নক্ষত্রলোকে প্রবেশ করে। সে সময় সূর্য থেকে এর দূরত্ব ছিল ১২৯০ কোটি মাইল। একই সময় ভয়েজার ২ ছিল সৌরজগতের ভেতরেই। সূর্য থেকে ১০৬০ কোটি মাইল দূরে ছিল। এখনও এটি হেলিওস্ফিয়ারের অর্থাৎ সূর্য থেকে ১০৬০ কোটি মাইল দূরে ছিল। এখনও এটি হেলিওস্ফিয়ারের অর্থাৎ সৌরজগতের বহিরাঙ্গনের মধ্যেই বিচরণ করছে। ভয়েজার মিশন হলো যমজ নভোযানের মিশন। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে দুটো নভোযান ছাড়া হলেও ওদের গতি ও গতিপথ দুটোই ছিল আলাদা। আগেই বলা হয়েছে যে, সৌরজগতের বহির্ভাগের গ্রহগুলোর একটা বিশেষ এলাইনমেন্টে আসার সুযোগ নেয়া হয়েছিল ভয়েজার মিশনে। এমন এলাইনমেন্ট ১৭৬ বছর পর পর হয়। ভয়েজার ১ এখন নক্ষত্রলোকে ভেসে চলেছে। নভোযানটি বড় কিছুর মুখোমুখি হবে ৪০ হাজার বছরের মধ্যে। সে সময় ভয়েজার ১ নক্ষত্র এসি ৩৮৮৮ এর ১.৭ আলোকবর্ষের মধ্যে আসবে। নক্ষত্রটি পৃথিবী থেকে সাড়ে ১৭ আলোকবর্ষ দূরে। নক্ষত্র লোকের বুকে প্রতি সেকেন্ডে ১৭ কিলোমিটার গতিতে ভেসে চলেছে ভয়েজার ১। বলাবাহুল্য এই প্রথম মানুষের তৈরি কোন কিছু নক্ষত্র লোকে বিচরণ করছে। তবে দুই ভয়েজারেরই বৈজ্ঞানিক জীবন শেষ হয়ে আসার পথে। তাদের বেতার সঙ্কেত দুর্বল হয়ে আসছে। প্লুটোনিযামের শক্তিচালিত বিদ্যুত উৎপাদন ধীরে ধীরে কমছে। ফলে এই বিদ্যুত দিয়ে যেসব যন্ত্রপাতি চলছে সেগুলো আস্তে আস্তে বিকল্প হয়ে পড়বে। পৃথিবীতে ড্যাটা প্রেরণ এবং সব ধরনের যোগাযোগ ২০৩০ সাল নাগাদ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে। তারপর থেকে ভয়েজার দুটি আর নভোযান হিসেবে কাজ করবে না করবে টাইম ক্যাপসুল হিসেবে। এমন এক পরিণতির কথা মাথায় রেখেই নাসার বিজ্ঞানীরা প্রতিটি নভোযানে দুই কপি করে ‘সোনালি রেকর্ড’ যুক্ত করেছেন। রেকর্ডে আছে তিমির আওয়াজ থেকে শুরু করে চাক বেরির মিউজিক পর্যন্ত পৃথিবীর নানা ধরনের ধ্বনি। আরেক রেকর্ডে ৫৫টি ভাষায় স্বাগত জানিয়ে বলা হচ্ছে ‘এই অনন্ত মহাবিশ্বে কোথাও কি কেউ আছ?’ মহাজাগতিক কোন প্রাণী যদি থেকে থাকে একদিন হয়ত তারা এসব রেকর্ডের কথা ও ধ্বনির মর্মোদ্ধার করতে পারবে। রেকর্ড দুটি বেজেই চলেছে এবং অন্তত একশ’ কোটি বছর ধরে বেজে চলার কথা। তারপর উল্কার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা এবং কসমিক রে নামক তীব্রগতির পরমাণু কণার ঘর্ষণে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে একদিন সেগুলোর অপমৃত্যু ঘটবে। সে অনেক দীর্ঘ সময়ের কথা। আজ থেকে এক শ’ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে প্রাণের সবচেয়ে জটিল রূপ ছিল স্ট্রোমাটোলাইট নামে এক ধরনের সায়ানো-ব্যাকটেরিয়া। এখন থেকে একশ’ কোটি বছর পর সূর্য মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে। তখন এটি আকারে বড় হবে এবং এর উজ্জ্বলতা ও তাপও বেড়ে যাবে। সেই তাপে পৃথিবীর সাগর-মহাসাগরের জলরাশি টগবগ করে ফুটবে। কিন্তু তখনও ভয়েজার দুটি মহাবিশ্বের কোথাও না কোথাও থাকবে। ওদের ফিরে আসার প্রত্যাশা না করে কারা একদিন ওদের মহাশূন্যে পাঠিয়েছিল তাদেরই দূত হয়ে থাকবে। সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
×