ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

পবিত্র আশুরার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ১ অক্টোবর ২০১৭

পবিত্র আশুরার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য

চান্দ্র সনের হিসেবে বছর হয় মোটামুটি ৩৫৪ দিনে। এই ৩৫৪ দিনের মধ্যে এমন কিছু দিবস এবং এমন কিছু রজনী রয়েছে যেগুলো মুসলিম দুনিয়ায় বিশেষ মর্যাদায় পালিত হয়। বিশেষ বিশেষ গুরুত্ব ও মাহাত্ম্যপূর্ণ ঘটনার কারণে যেসব দিবস কিংবা রজনী বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ হয়ে উঠেছে সে দিবসগুলোর মধ্যে আশুরা অন্যতম। আশুরা বলা হয় মহরম মাসের দশ তারিখকে। বিশ্বজাহান সৃষ্টির সূচনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন যুগে বহু গুরুত্বপূর্ণ ও মাহাত্ম্যম-িত ঘটনা ঘটেছে আশুরাতে। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু নিজেকে প্রকাশ করবার জন্য যেদিন সৃষ্টির সূচনা করেন সেদিন ছিল আশুরা। এখানে উল্লেখ্য যে, আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু সর্বপ্রথম নূরে মুহম্মদী সৃষ্টি করে সৃষ্টির সূচনা করেন। মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম ‘আলায়হিস সাল্লামের দেহে যেদিন আল্লাহ্ জাল্লা জানুহু রূহ ফুঁকে দেন অর্থাৎ তাঁর দেহে প্রাণ দান করেন সেদিন ছিল আশুরা। হযরত আদম (আ.) ও মানবজাতির আদি মাতা হযরত হাওয়া ‘আলায়হিস সাল্লাম জান্নাত থেকে যেদিন বহিষ্কৃত হয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন সেদিনও ছিল আশুরা। জানা যায় হযরত আদম ‘আলায়হিস সাল্লামকে বর্তমান শ্রীলঙ্কার একটি পাহাড়ের শীর্ষে নামানো হয়, আর মা হাওয়া ‘আলায়হিস সাল্লামকে নামানো হয় লোহিত সাগরের তীরে, জেদ্দাতে। হযরত আদম ‘আলায়হিস সাল্লাম প্রায় সাড়ে তিনশত বছর ধরে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চেয়ে কান্নাকাটি করেন। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু যেদিন শেষ নবী হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর উসিলায় আদম (আ.)-এর তওবা কবুল করেন সেদিন ছিল আশুরা। হযরত আদম (আ.) শ্রীলঙ্কার যে পর্বত চূড়ায় অবতরণ করেছিলেন আজও তা রয়েছে। যাকে বলা হয় এ্যাডামস পিক্, স্থানীয় বৌদ্ধ বা হিন্দুরা একে বলে শ্রী শ্রী পাদম। আর মুসলিমরা বলেন বাবা আদম পাদম। হযরত নূহ ‘আলায়হিস সাল্লামের সময় যে মহাপ্লাবন হয় সেই মহাপ্লাবন হতে রক্ষা পাবার জন্য আল্লাহর নির্দেশে তিনি একটি বিরাট জাহাজ বানিয়ে তাতে আরোহণ করেন। প্লাবন শেষে যেদিন তিনি জাহাজ থেকে যুদী পাহাড়ে অবতরণ করেন সেদিনটি ছিল আশুরা। হযরত ইব্রাহিম ‘আলাইহিস সাল্লাম নমরুদের অগ্নিকু- হতে যেদিন উদ্ধার পেয়েছিলেন সেদিন ছিল আশুরা। এমনিভাবে হযরত ইউনূস ‘আলায়হিস সাল্লামের মাছের পেট থেকে উদ্ধার লাভ, হযরত ইউসুফ ‘আলায়হিস সাল্লামের ৪০ বছর পর পিতা হযরত ইয়াকুব ‘আলায়হিস সাল্লামের সঙ্গে মিলিত হওয়া, সোলায়মান ‘আলায়হিস সাল্লামের হারানো রাজত্ব ফিরে পাওয়া, হযরত আইয়ুব ‘আলায়হিস সাল্লামের দীর্ঘকাল রোগভোগের পর আরোগ্য লাভ, হযরত মূসা ‘আলায়হিস সাল্লামের বনী ইসরাঈলসহ লোহিত সাগর পাড়ি দেয়া এবং সদলবলে ফেরাউনের ডুবে মরা প্রভৃতি অসংখ্য ঘটনার নীরব সাক্ষী হচ্ছে আশুরা। এসব ছাড়া আরও জানা যায়, কিয়ামত হবে ভবিষ্যতের কোন এক আশুরাতে। কিয়ামতের সেই ভীষণ দিনের বিবরণ কুরআন মজীদে রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে; মহাপ্রলয়, মহাপ্রলয় কি? মহাপ্রলয় কি তা কি তুমি জান? সেদিন মানুষ হবে বিক্ষিপ্ত পতঙ্গের মতো, পর্বতসমূহ হবে ধুনাই করা রঙিন তুলোর মতো। (সূরা কারি’ আ : আয়াত ১-৫)। আশুরার মাহাত্ম্য সম্পর্কে হাদিস শরীফে বিস্তর বর্ণনা রয়েছে। রমাদানের সিয়াম ফরয হবার পূর্বে প্রিয়নবী রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজে এবং তাঁর নির্দেশে সাহাবায়ে কেরাম আশুরাতে সিয়াম পালন করতেন, এমনকি পরবর্তীতেও এই সিয়াম পালিত হয়। প্রিয়নবী রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, রমাদানের সিয়ামের পর উত্তম সিয়াম হচ্ছে আশুরার সিয়াম। এতে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, নফল সিয়ামের মধ্যে সর্বোত্তম সিয়াম হচ্ছে আশুরার সিয়াম। মহরম মাসের ১০ তারিখ বা আশুরা ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে ঐতিহাসিক কারবালার সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার কারণে। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১০ মহরম হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু সত্য ও সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য, হক ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করবার জন্য কারবালা প্রান্তরে আত্মত্যাগে এবং আত্ম্যোৎসর্গের যে অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তা পৃথিবীর মানুষকে ন্যায়ের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বার প্রেরণা যুগিয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। আমরা জানি ৬৬১ খ্রি. হযরত আলী (রা.) আনহুর শাহাদাতের মধ্য দিয়ে খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগের অবসান ঘটে। বিশিষ্ট এবং ওহী লেখক হযরত মুয়াবিয়া (রা.) খলিফা হন। ৬৯০ খ্রি. তিনি ইন্তেকাল করলে তার পুত্র ইয়াজিদ মসনদে আরোহণ করেন। হযরত মুয়াবিয়া (রা.) বিশিষ্ট সাহাবা কেরামের পরামর্শ নিয়ে ইয়াজিদকে তার কায়েম মোকাম বা স্থলাভিসিক্ত হবার ঘোষণা দিয়ে গিয়েছিলেন। ইয়াজিদ ছিল দুর্দান্ত প্রকৃতির লোক। ইসলামের শত্রুরা বিশেষ করে ইয়াহুদী ও মুনাফিক চক্র ইয়াজিদের স্কন্দে সওয়ার হতে সমর্থ হয়। ইয়াজিদ ক্ষমতার অন্ধ মোহে দিশেহারা হয়ে যায়। সে ধরাকে শরা মনে করতে থাকে। ইসলামের সূচনাকাল থেকে যে মুনাফিক ও ইয়াহুদী চক্র ইসলামের ধ্বংস সাধনে লিপ্ত ছিল সেই চক্রের প্রেতাত্মারা ভর করে নরাধম ইয়াজিদের ওপর। সে একে একে স্বৈরাচারী কা-কারখানা করতে থাকে। এরই প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসেন সত্যের সৈনিক হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তা‘আলা আন্হু। হযরত ইমাম হুসাইন (রা.)-এর পিতা ইসলামের চতুর্থ খলীফা হযরত আলী রাদিআল্লাহু তা‘আলা আন্হু খিলাফতের রাজধানী মদীনা থেকে কুফাতে স্থানান্তর করেছিলেন। হযরত মুয়াবিয়া (রা.) দামেস্কে খিলাফতের রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন। এই দামেস্কের মসনদেই ইয়াজিদ আসীন হয়। কুফার জনগণ ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। তারা হযরত ইমাম হুসাইন (রা.)কে চিঠির পর চিঠি দিয়ে কুফায় যাবার জন্য দাওয়াত জানাতে থাকে। হযরত ইমাম হুসাইন (রা.) চিঠিগুলোর সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকিলকে কুফায় পাঠিয়ে দেন। হযরত মুসলিম বিন আকিল কুফায় এসে দেখতে পান যে, সত্যি সত্যি কুফার জনগণ হযরত ইমাম হুসাইন (রা.)কে চায়। কুফার এই অবস্থা দেখে তিনি হযরত ইমাম হুসাইন (রা.)কে কুফা আসবার জন্য পত্র পাঠান এবং পত্র পেয়ে হযরত ইমাম হুসাইন (রা.) সপরিবারে কুফার উদ্দেশে রওনা হলেন। ওদিকে কুফার অবস্থা পাল্টে দিল ইয়াজিদ চক্র। ইয়াজিদ কর্তৃক নিয়োজিত নতুন গবর্নর ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ কুফায় এসে ভয়ভীতি দেখিয়ে এবং কূটকৌশল প্রয়োগ করে কুফাবাসীকে বশীভূত করে ফেলল। মুসলিম বিন আকিলকে বন্দী করে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। এসব ঘটনার কথা ইমাম হুসাইনের কাছে পৌঁছতে পারল না। ইমাম হুসাইন (রা.) সপরিবারে একটি কাফেলাসহ কুফা সীমান্তে পৌঁছলে ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের বাহিনী তাঁকে কুফায় প্রবেশ করতে দিল না। কুফা নগরীতে প্রবেশে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ইমাম হুসাইন (রা.) ফোরাত নদীর তীরে অবস্থিত কারবালা প্রান্তরে এসে তাঁবু স্থাপন করলেন। ইয়াজিদ বাহিনী সেই তাঁবুগুলোর চারদিকে বেষ্টনী দিয়ে ঘেরাও করল। এমনকি ফোরাত নদী থেকে পানি আনবার পথও রুদ্ধ করা হলো। এই অবস্থা নিরসনের জন্য ইমাম হুসাইন (রা.) ইয়াজিদ বাহিনীর সেনাপতির কাছে কয়েকটি প্রস্তাব রাখলেন। তিনি প্রস্তাবে বললেন, আমাকে মদীনায় ফিরে যেতে দাও অথবা আমাকে ইয়াজিদের কাছে নিয়ে যাও। কিন্তু কোন প্রস্তাবই দুশমন সেনাপতি গ্রহণ করল না। ৬১ হিজরী মুতাবিক ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১০ মহরম এক অসম যুদ্ধে ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তা’য়ালা আন্হু শহীদ হলেন। রক্তপিপাসু দুশমন সৈন্যরা তাঁর পরিবারের কয়েকজনকে নির্মমভাবে হত্যা করল। শহীদানের পবিত্র খুনে লালে লাল হয়ে গেল কারবালা প্রান্তর। হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তা‘আলা আন্হুর শহীদ হবার মধ্য দিয়ে সত্যের পতাকা সমুন্নত হলো। হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তা‘আলা আন্হু সেদিন কারবালা প্রান্তরে যে বীরত্ব প্রদর্শন করলেন, স্বাধীনতা রক্ষার জন্য নিজেকে কুরবান করবার যে নজির স্থাপন করলেন তা যুগে যুগে মুসলিম মননে বিপ্লবী চেতনার স্ফুরণ ঘটিয়ে আসছে। সত্যের সাধনা, শৌর্য ও ত্যাগের অপূর্ব মহিমায় সমুজ্জ্বল আশুরা প্রতি বছর আসে। কারবালায় হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তা‘আলা আনহুর শাহাদাতের মধ্য দিয়ে সত্যের বিজয় নিশান উন্নত হয়েছে, অন্যদিকে ইয়াজিদ ইতিহাসে চিরধিকৃত হয়ে রয়েছে। আশুরা আসে মানবতার বিজয়বারতা নিয়ে ইতিহাসের পাঠ দেবার জন্য। যুগশ্রেষ্ঠ সুফী কুত্বুল আলম হযরত মওলানা শাহ সূফী তোয়াজউদ্দীন আহমদ রহমাতুল্লাহি ‘আলায়হি বলেছেন যে, সবর ও শোকরের মহাশিক্ষা আমরা আশুরা থেকে পেয়ে থাকি। এ দিবস আত্ম আবিষ্কার করবার তাকিদ দেয়। আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বলেছেন : ‘ফিরে এল আজ সেই মুর্হরম মাহিনা। ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।’ কবির এই উচ্চারণে আশুরাতে ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর হবার তাকিদ লক্ষ্য করা যায়। আশুরা একটি পবিত্র দিন। র্শিক ও বিদ‘আত করে আমরা যেন এই পবিত্র দিনটির পবিত্রতা বিনষ্ট না করি সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। সত্য ও সুন্দরকে জানবার এবং সত্য ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগের দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করবার মধ্যে আশুরার তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট হযরত মুহম্মদ (সা.)
×