ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

উৎপাদন কমেছে বছরে ৩০ কোটি টাকার;###;কৃষকের হাতছাড়া ১৫ হাজার একর জমি

কৃষিজমিসহ সবুজ আস্তরন ঢেকে যাচ্ছে বালুতে

প্রকাশিত: ২২:৩৫, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

কৃষিজমিসহ সবুজ আস্তরন ঢেকে যাচ্ছে বালুতে

মেজবাহউদ্দিন মাননু, নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া ॥ লতাচাপলী মৌজার এই বিশাল কৃষিজমির প্লটটি প্রায় ১০ বছর আগে বিক্রি হয়ে গেছে। এরপর থেকে অনাবাদী। কখনও খেলার মাঠ। কখনও গোচারন ভূমি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। কুয়াকাটাগামী মহাসড়ক লাগোয়া নয়াপাড়া এলাকায় এই প্লটটির অবস্থান। স্থানীয় কৃষক কবির হোসেন জানালেন, এক দাগে নয় কানি জমি এখানে। যা বিক্রি হয়ে গেছে। গেছে মূল কৃষকের হাত বদল হয়েছে। ৭২ বিঘা জমিতে ফি বছর কমপক্ষে ৮০০ মণ ধান ফলানো যেত। এমন অভিমত কৃষক কবির হোসেনর। ১০ বছরে এই জমি থেকে আট হাজার মণ ধানের উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হয়েছে। যার মূল্য অন্তত ৫৬ লাখ টাকা। এছাড়া রবিশস্যে থাকত পরিপুর্ণ। কৃষি বিভাগের তথ্যানুসারে এ ৭২ বিঘা জমিতে ধান ফলানো যেত প্রায় এক হাজার মণ। এভাবে বছরের পর বছর কুয়াকাটার খাজুরা, মাঝিবাড়ি, খাজুরা, পশ্চিম কুয়াকাটা, মম্বিপাড়া, ধুলাসার, গঙ্গামতি, পায়রা বন্দর ও তার আশপাশ, ধানখালী সর্বত্র কৃষকের জমি বেচেকেনার দৌড়ে বদল হয়ে গেছে হাত। বছরের পর বছর কোথাও যুগ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু সবুজে পরিপূর্ণ থাকা কৃষি জমি অনাবাদি পড়ে আছে। বিভিন্ন আবাসন কোম্পানি ছাড়াও সরকারি অধিগ্রহণেও হারিয়ে গেছে অন্তত ১৫ হাজার একর কৃষি জমি। আর হস্তান্তরের পরে আর ওই জমি উৎপাদনের কাজে লাগেনা। থাকছে অনাবাদী। এ কারণে অন্তত তিন লাখ মন ধানের উৎপাদন কমে গেছে কলাপাড়ায়। যার বাজার মূল্য অন্তত ৩০ কোটি টাকা। ফি বছর এপরিমাণ ধানের উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কৃষক। গত পাঁচ বছরের শুধুমাত্র এ উপজেলা থেকে এক শ’ কোটি টাকার ধানের উৎপাদন কমে গেছে। খাদ্যে উদ্ধৃত্ত কলাপাড়া এখন ঘটতিতে পরিণত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কেনাবেচার দৌড়বাণিজ্যে এখন যেন দ্রুত বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে সাগরপাড়ের কলাপাড়ার সবুজ জনপদ। বির্স্তীর্ণ এলাকাজুড়ে থাকত সবুজের সমারোহ। তারপরে ছিটেফোটা বাড়িঘর, আবাসস্থল। কোথাও মাঝখানে সরু রাস্তা। কোনটা কাদামাটি, আবার কোথাও ইটের সলিং কিংবা সীলকোটের আস্তরণ। এসব ছিল চিরচেনা পথঘাট। কলাপাড়ার এই জনপদ এখন সব ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। বিবর্ণ জনপদে পরিণত হচ্ছে ধানী জমি। ইতোমধ্যে অন্তত দশ হাজার একর আবাদি জমি বালুর আস্তরনে ঢেকে গেছে। কোথায় তোলা হয়েছে স্থাপনা। কোথাও ইটের দেয়াল দিয়ে সীমানা ঘিরে রাখা হয়েছে। এক কথায় কলাপাড়ার উপকূলীয় সবুজ জনপদ এখন দ্রুত বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। হয়ে যাচ্ছে বিরাণভূমি। স্থায়ীভাবে এসব জমি কৃষকের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আগ্রাসী থাবা থেকে বাদ পড়ছেনা বাড়ি-ঘর থেকে গ্রামীণ প্রকৃতি। বালুতে ভরাট হয়ে বিলীন হচ্ছে পুকুর, গোয়ালঘর থেকে বাপ-দাদার কবর পর্যন্ত। বনবিভাগের সংরক্ষিত বাগানের গাছপালাসহ বাগান পর্যন্ত আগ্রাসী হানায় বালুর নিচে চাপা পড়ছে। রক্ষা পাচ্ছে না নদী-খাল থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক লেক পর্যন্ত। কখনও অধিগ্রহণ। কখনও আগ্রাসী থাবায় জবরদখল চলছে। সব যেন চলছে ফ্রি-স্টাইলে। কোন নিয়ম কানুনের বালাই নেই। পরিণত হচ্ছে কৃত্তিম মরুভূমি। অধিগ্রহন প্রক্রিয়ায় যেসব স্থাপনার জন্য সবুজ তিন ফসলী কৃষিজমিসহ বসতভিটা এলাকা বালুতে ভরাট করা হয়েছে তা নিয়েও রয়েছে এন্তার অভিযোগ। কারণ বিদ্যুত প্লান্ট করতে কী পরিমান জমির দরকার। আর কী পরিমাণ অধিগ্রহণ করা হয়েছে এ নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন। একই অবস্থা পায়রা বন্দর নির্মাণ নিয়ে। নৌঘাটি নির্মাণসহ বিভিন্ন সরকারি উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সবুজে ঘেরা কৃষি উৎপাদনের তিন ফসলী জমি অধিগ্রহণের বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্নের যেন শেষ নেই। ধানখালীতে ১৩২০ মেগাওয়াট পায়রা তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য ১০০২ একর তিন ফসলী কৃষিজমিসহ বসতভিটা অধিগ্রহণ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত প্ল্যান্ট করতে কতটুকু জমির প্রয়োজন তা নিয়ে এখন সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যাদের জমিজমা, বসতভিটা গেছে তাদের মনে প্রচন্ড ক্ষোভের জন্ম নিয়েছে। এসব মানুষের জমি বুঝে নেয়ার তিন বছর পরেও পুনর্বাসনের আওতায় আনা হয়নি। অধিগ্রহণের টাকা আজও পায়নি প্রায় ৪০ ভাগ মানুষ। সুখে-স্বাচ্ছন্দে থাকা গেরস্ত পরিবারগুলো এখন বেড়িবাঁধের রিভার সাইটের স্লোপে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। তাদের চোখের সামনেই সবুজে ঘেরা মাঠে এখন কৃত্তিম বালুর পাহাড় দাড়িয়ে আছে। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। ধানখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ গাজী জানান, তাঁর ইউনিয়নে মোট কৃষি জমি প্রায় সাড়ে নয় হাজার একর। যার অর্ধেকেরও বেশি কৃষকের হাতছাড়া হয়ে গেছে। উন্নয়ন কর্মকান্ডে অধিগ্রহণ করা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। বালিয়াতলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জানান, তাঁর ইউনিয়নে প্রায় ৭০০ একর জমি কৃষকের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। লালুয়ার চেয়ারম্যান জানালেন, তার ইউনিয়নে অন্তত দুই হাজার একর কৃষিজমি কৃষকের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। একই দশা টিয়াখালী, ধুলাসার ও লতাচাপলীর। এসব জমির কৃষি উৎপাদন অর্ধেকটা এবছর বন্ধ রয়েছে। যেখানে সবুজের সমারোহ থাকার কথা সেখানে। বালুর আস্তরনে ঢেকে যাচ্ছে। এছাড়াও সরকারি বেসরকারি উদ্যোক্তা কিংবা ভূমি ব্যবসায়ীরা শিল্প প্রতিষ্ঠান করার নামে বেড়িবাঁধের বাইরের সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড় করে বালুতে ঢেকে দিয়েছে। শত শত গাছপালা কেটে সাবাড় করে দেয়া হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধিগ্রহন করা জমিজমা দখল ও ভরাট করে নেয়া হয়েছে। পায়রা বন্দর প্রকল্প এলাকার উত্তর ও দক্ষিণ দিকে এ চিত্র বিরাজমান। নাচনাপাড়া চৌরাস্তা এলাকায় চাকামইয়া-টিয়াখালী দোন নদীর তীর দখল করে বনাঞ্চল কেটে সাফ করে দোকানপাটসহ বাড়িঘর করা হয়েছে। চাকামইয় ব্রিজ থেকে রজপাড়া পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। কুয়াকাটা পৌর এলাকাসহ খাজুরা, আলীপুর, গঙ্গামতি, লতাচাপলী, কাউয়ারচর, গঙ্গামতিসহ সর্বত্র। পর্যটন এলাকা কুয়াকাটার দশ বর্গকিলোমিটার এলাকার সবুজে ঘেরা জমি বালুতে ঢেকে দেয়া হচ্ছে। অধিকাংশই কৃষকের হাতছাড়া হয়ে গেছে। এখানকার অন্তত পাঁচ হাজার একর জমি যুগ ধরে অনাবাদী পড়ে আছে। মহাসড়কের পাশে তিনফসলী কৃষিজমিতে কোন বাধা ছাড়া গড়ে উঠেছে ইটভাটা। আর বেড়িবাঁধের বাইরের বনাঞ্চলসহ পাউবোর খাস জমি দখল করে গাছপালা উজাড় করে গড়ে তোলা হচ্ছে হাজার হাজার বাড়িঘর। এমনদৃশ্য সবক’টি বেড়িবাঁধের বাইরে। মাইলের পর মাইল জুড়ে সবুজের আচ্ছাদন উজাড় করে বিরানভূমিতে পরিণত করার যেন তান্ডব চলছে। ভূমিগ্রাসীচক্র এমনসব আগ্রাসী তান্ডব চালালেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব বন্ধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয় না। ফলে কলাপাড়া উপকূলের সবুজ বনায়ন, সবুজ কৃষিজমি এখন পরিণত হচ্ছে বিরানভূমিতে। উপজেলা প্রশাসন, কৃষিবিভাগ, পানিউন্নয়ন বোর্ড, বনবিভাগসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্তা ব্যক্তিরা এসব নিয়ে তেমন তৎপর নয়। ফলে ভূক্তভোগীরা হতাশ হয়ে পড়ছে। দ্রুত কমে যাচ্ছে কৃষিকাজে ব্যবহারের জমিসহ বনাঞ্চল। ধানসহ কৃষিউৎপাদন দ্রুত কমে যাওয়ায় কৃষকসহ ভূমির মালিকরা হতাশ হয়ে পড়ছেন। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মসিউর রহমান জানান, সারা দেশে বছরে মোট ভূমির ০.৭২ ভাগ কৃষি ভূমি কমে যাচ্ছে। কিন্তু কলাপাড়ায় এর পরিমান আরও বেশি। অন্তত পাঁচ হাজার একর। বর্তমানে যা উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌছেছে। সাধারণ সচেতন মানুষের দাবি তিন ফসলী কৃষি জমি রক্ষায় এখনই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হোক।
×