ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে রয়েছে কলসকাঠীর তেরো জমিদার বাড়ি

হারিয়ে যাচ্ছে পাঁচ শ’ বছরের ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

হারিয়ে যাচ্ছে পাঁচ শ’ বছরের ইতিহাস

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল থেকে ॥ মূল্যবান ইট, পাথর আর সুড়কি দিয়ে গাঁথা, চোখ ধাঁধানো কারুকার্য খচিত নকশী আজও মুগ্ধ করে পর্যটকদের। এক সময়ের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক চর্চার স্থান হিসেবে ব্যাপক পরিচিত, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এলাকা এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্বাচনী প্রচারের সেই জনসভাস্থল বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাঠী এলাকার তেরো জমিদারবাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অথচ তের জমিদারের বসবাসস্থল কলসকাঠীকে ঘিরে রয়েছে প্রায় পাঁচ শ’ বছরের পুরনো ইতিহাস। জমিদারবাড়ির প্রবেশপথে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন মঠ, বেশ কিছু ভাঙ্গা মন্দির ও সংস্কারের অভাবে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত বেশ কিছু বাড়ি। পাশেই রয়েছে শানবাঁধানো একটি পুকুর। বাড়ির ভেতরের মন্দিরে রয়েছে মূল্যবান কষ্টিপাথরের শিবমূর্র্তি। চুরির ভয়ে মন্দিরের ভিতরে দেবীর মূর্তিকে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। ওই মন্দিরের সামনেই রয়েছে ছোট একটি বেদি। পূজার সময় এখানে প্রাণী বলি দেয়া হয়। প্রতি বছরের নবেম্বর মাসে এখানে ঐতিহ্যবাহী জগদ্বাত্রী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এ পূজাকে ঘিরে কলসকাঠী পরিণত হয় লাখো মানুষের মিলনমেলায়। দ্বিতল জমিদারবাড়ির ভিতর দিয়ে রাস্তা চলে গেছে অন্দরমহলের দিকে। সিঁড়িপথ উঠে গেছে ওপরে। সিঁড়িপথের নিচে রয়েছে আরেকটি দরজা, যেটা দিয়ে বাড়ির মূল অংশে প্রবেশ করা হয়। পুরো বাড়িটি সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ হলেও ঐতিহ্যবাহী বাকেরগঞ্জের কলসকাঠীর জমিদার বাড়িকে ঘিরে থেমে নেই পর্যটকদের ভিড়। ইতিহাস ঐতিহ্যখ্যাত এ জমিদারবাড়িতে প্রতিদিন সকল বয়সের মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। সরকারী উদ্যোগে তেরো জমিদারের বসবাসস্থল বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণ করা না হলে খুব শীঘ্রই পুরো বাড়িটি বিলীন হয়ে যাবে। অথচ সংস্কারের মাধ্যমে এ বাড়িটি হতে পারে বরিশালের আকর্ষণীয় একটি পর্যটন কেন্দ্র। কলসকাঠীর ইতিহাস ॥ একটি প্রাচীন জনপদের নাম কলসকাঠী। বাকেরগঞ্জ তৎকালীন আওরঙ্গপুর পরগণার অন্তর্ভুক্ত ছিল। কলসকাঠীর ইতিহাস জমিদারির ইতিহাস। ১৭০০ সালের গোড়ার দিকে জমিদার জানকি বল্লভ রায় চৌধুরী কলসকাঠী স্থাপন করেন। আগে এর নাম ছিল কলুসকাঠী। জানকী বল্লভ রায় চৌধুরী ছিলেন গারুড়িয়ার জমিদার রামাকান্তের পুত্র। জানকী বল্লভ রায় চৌধুরীরা ছিলেন দুই ভাই। বড় ভাই রাম বল্লভ। জানকী বল্লভকে হত্যার চক্রান্ত করে রাম বল্লভ। বিষয়টি তিনি তার বৌদির মাধ্যমে জানতে পেরে রাতের আধারে গারুড়িয়া ত্যাগ করে মুর্শিদাবাদ চলে যান। সেখানে তিনি নবাবের কাছে সমস্ত ঘটনা খুলে বলার পর নবাব তাকে (জানকী বল্লভ) আওরঙ্গপুর পরগনার জমিদার হিসেবে নিয়োগ করেন। জমিদারী পেয়ে জানকী বল্লভ কলসকাঠীতে এসে বসতি স্থাপন করেন। কলসকাঠীর তের জমিদার মূলত জানকী বল্লভের পরবর্তী বংশধর। তার বংশধররা সবাই প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন। তাদের একজন বিশ্বেশ্বর রায় চৌধুরী এ বাড়িটি নির্মাণ করেন। জমিদার পরিবারের সদস্যরা পাকিস্তান আমলে ভারত চলে যান। জমিদারবাড়ির ধ্বংসস্তুূপ আজও কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। কলসকাঠীতে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক চর্চা ছিল জমিদার আমল থেকেই। সে সময় কলকাতা থেকে নামী-দামী ফুটবল খেলোয়াড় আসত কলসকাঠীতে ফুটবল খেলতে। গান, নাটক ও যাত্রাপালায় বারো মাসই মুখরিত থাকত পুরো কলসকাঠী। ১৯০৮ সালে কলসকাঠীতে ‘বান্ধব সমিতি’ ও ‘নরেন্দ্র রায় চৌধুরী শক্তি লাইব্রেরী’ গঠিত হয়। ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রাম কৃষ্ণ মিশন। ১৯৩০ সালে ‘লবণ আইন’সহ অন্যান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে কলসকাঠীর জনগণ। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর সকল জমিদাররা ভারতের পশ্চিম বঙ্গে চলে যান। শুধু বিজয় রায় চৌধুরী ১৯৬৮ সালে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনী প্রচার চালাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলসকাঠীতে এসেছিলেন। বর্তমান কলসকাঠী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে তিনি জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৪ মে পাকহানাদার বাহিনী কলসকাঠীতে আক্রমন করে। ওইদিন গ্রামের নিরিহ কয়েক হাজার নারী-পুরুষদের কলসকাঠীর খালের পাড়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে পাক সেনারা গুলি করে হত্যা করে। যেভাবে যাওয়া যায় ॥ বৃহত্তর বরিশাল বিভাগের বাকেরগঞ্জ উপজেলা সদরের নিভৃতে কলসকাঠী জমিদার বাড়ির অবস্থান। উপজেলা সদরের সাহেবগঞ্জ খেয়াপার হয়ে মোটরসাইকেল, রিকশা বা ভ্যানযোগে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরত্বে কলসকাঠী বাজারসংলগ্ন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছেই জমিদার বাড়ির অবস্থান। ঢাকা থেকে লঞ্চ বা বাসযোগে বরিশাল রূপাতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর বাকেরগঞ্জে আসার বাস পাওয়া যায়। সেখান থেকে রিকসাযোগে খেয়াঘাট গিয়ে নদী পার হতে হবে। কোথায় থাকবেন ॥ রাতযাপনের জন্য বরিশালে ভাল মানের একাধিক আবাসিক হোটেল রয়েছে। এছাড়া যদি বাকেরগঞ্জে থাকতে চান তাহলে আগে থেকে অনুমতি নিয়ে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতে থাকা যাবে।
×