ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পপি দেবী থাপা

শিউলি ঝরানো সকাল

প্রকাশিত: ০৬:১২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

শিউলি ঝরানো সকাল

শারদীয় পূজার এই সময়ে আমার বন্ধুদের সঙ্গে ছেলেবেলার পাঁচ বন্ধুর গল্প শোনাব। ওরা হলো শিপু, সুমনা, লিটন, দীপ্ত ও রনক। তাদের যেমন ছিল বুদ্ধি তেমনি পড়ালেখা ও সহযোগিতার মনোভাব। পাঁচ বন্ধুর বন্ধুত্বের প্রশংসার চর্চা চলত আশপাশের গ্রামজুড়ে। তাদের কথায় কাজে ছিল মিল। একবার কি হলো জানো, ওরা স্কুলে যাওয়ার পথে দেখতে পেল ওদের বয়সী একটি ছেলে চা এর দোকানে কাজ করছে। এটা দেখে শিপু বলল দেখ, আমাদের একটা কিছু করা উচিত। রনক বলল- কি করব, আর কিভাবেই করব সেটা না ভেবেই কি তাকে কিছু বলা ঠিক? চল্ আজ আমরা স্কুল ছুটির পর একত্রে বসে ঠিক করি, কি করা যায়। সেদিন স্কুল ছুটির পর শুরু হলো পাঁচজনের সভা। সভা শেষে যে যার বাসায় গেল। কিন্তু বিকেল বেলা ওরা কেউ খেলতে বের হলো না। ওরা তখন গোচ্ছাছিল ওদের কাছে টিফিনখরচ থেকে কত টাকা বাড়তি আছে। পরদিন সকাল বেলা স্কুলে যাওয়ার পথে ওরা ওই ছেলেটার কাছে গিয়ে ওর নাম জানতে চাইল। ছেলেটি বলল ওর নাম ‘লিটন’। সুমনা জিজ্ঞেস করল- ‘তোমার কি পড়তে ইচ্ছে করে না?’ ছেলেটি মুখে কোন উত্তর না দিয়ে শুধুই মাথা নাড়াল। স্কুলের ঘণ্টা বেজে উঠল তাই তখন আর কিছু না বলে ওরা ক্লাসে চলে গেল। ছুটির পর বন্ধুরা মিলে ওদের সকলের জমানো টাকা একত্র করে খাতা-কলম কিনল। তারপর গেল সেই চায়ের দোকানের মালিকের কাছে। তারা দোকানের মালিককে ছোট ছোট সব বুদ্ধি আর জোরালো যুক্তি দিয়ে এক পর্যায়ে বোঝাতে সক্ষম হলো যে, এই বয়সে লিটনের স্কুলে যাওয়া উচিত, তার পড়ালেখা করা উচিত। আর যখন মালিক রাজি হলেন, বন্ধুরা লিটনকে জড়িয়ে ধরে যে কি খুশি! এবার তার হাতে খাতা-কলম তুলে দিয়ে সেদিনের মতো তারা বাসায় গেল। পরদিন স্কুলে এসে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলল। শিক্ষকরাও তাদের বন্ধুদের উদ্যোগে খুশি হলেন, প্রশংসা করলেন। শিক্ষকরা তাঁদের স্কুলে লিটনকে ভর্তি করার জন্য রাজি হলেন। লিটন স্কুল থেকে পড়ার জন্য বই পেল আর পড়ালেখা বোঝার জন্য বন্ধুরা তাকে সাহায্য করল। সেই থেকে লিটন হয়ে গেল তাদের আরেক বন্ধু। তারপর থেকে লিটনের তাদের একসঙ্গে পড়ালেখা, খেলাধুলা। একবার দুর্গাপূজায়, ঠিক করল বন্ধুরা মিলে মেলায় যাবে, পূজাম-বে গিয়ে পূজা দেখবে। ওরা সকলে মিলে দীপ্তের বাড়িতে গেল। ওদের ওখানে মন্দিরে পূজা হয়। বন্ধুদের একত্রে দেখতে পেয়ে দীপ্তের বাবা-মা খুশি হলেন। বন্ধুরা সবাই মিলে দীপ্তদের বাড়িতে গিয়ে অনেক মজা করল। নাড়–, সন্দেশ, মা-া, মিঠাই, মোয়া, লুচি, খই, মুড়ি, মুড়কি, ক্ষির আরও কত রকমের খাবার খেল। শিপু বললÑ আমি সন্দেশ খেতে খুব পছন্দ করি। আর মাসিমার বানানো সন্দেশ খেতে আরও বেশি মজা। দীপ্ত শিপুকে বললÑ এবার ঈদের সময় তোদের বাড়িতে খালামণি যে সেমাই জর্দা রেঁধেছিল তার স্বাদ আমি এখনও ভুলতে পারিনি। আর সুমনার বাড়িতে আমরা কত মজা করেছিলাম, খালাম্মার হাতের বিরিয়ানির স্বাদই আলাদা। এত আনন্দ হাসি, গল্পের মাঝেও ওদের মনটা খারাপ ছিল। কেননা লিটনের তখন জ্বর হয়েছিল। দীপ্তের মা লিটনের জ্বরের কথা শুনে খুব চিন্তিত হলেন। তিনি বললেন ‘আমি লিটনের জন্য কিছু খাবার তৈরি করেছি তোমরা ওর জন্য নিয়ে যেও’। বন্ধুরা মিলে ঠিক করল পূজার মেলায় যাওয়ার আগে লিটনের বাসায় ওকে দেখতে যাবে। যেমন কথা তেমন কাজ। লিটনের বাসায় গিয়ে দেখে, ওর অনেক জ্বর। কিন্তু ওর মা ডাক্তার দেখালেও ওনার কাছে টাকা না থাকায় ওষুধ কিনতে পারেননি। পূজার মেলায় গিয়ে খেলনা কেনার জন্য যে টাকা ওদের বাবা-মা ওদের দিয়েছিল তা একত্র করে লিটনের জন্য ওষুধ কিনল। আর দীপ্তের মায়ের দেয়া খাবার লিটনকে খেতে দিল। বন্ধুর মিলে লিটনকে বলল ‘চিন্তা করিস না। এই ওষুধ খেলে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবি। আমরা সবাই মিলে আবার একত্রে স্কুলে যাব, খেলাধুলা করব। রনক বলল পূজা দেখতে যেতে পারিসনি তাই মন খারাপ করিস না। সামনেই তো বড়দিন। ডিসেম্বর মাস এলো এলো বলে। আমরা সবাই মিলে একত্রে চার্চে যাব। ফাদারের কাছ থেকে গিফট নিব। সান্টার সঙ্গে মজা করব অনেক অনেক চকোলেট পাব, কেক খাব, খুব মজা হবে। এবার তাড়াতাড়ি ওষুধ খেয়ে সুস্থ হও। এভাবেই তাদের বন্ধুত্ব দিনের পর দিন মজবুত হতে থাকল। সুখে-দুখে আনন্দ বেদনায়, উৎসবে একে অপরের সাথী হলো।
×