ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হচ্ছে আজ

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হচ্ছে আজ

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মাওয়া থেকে ফিরে ॥ স্বপ্নের পদ্মা সেতু চোখে দেখা যাবে আজ শনিবার। সকাল ৮টা থেকে ১০টার মধ্যে সেতুর প্রথম সুপার স্ট্রাকচার (স্প্যান) স্থাপন করা হচ্ছে। সেতুটির ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটির (পিয়ার) ওপর স্প্যানটি বসানো হবে। তাই শুক্রবার দুপুর ২টার দিকে স্প্যানবাহী জাহাজটি ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটির মঝামাঝি স্থানে নিয়ে আসা হয়েছে। স্প্যানটি নিয়ে রাখা হয়েছিল কিছুটা দূরের ৩০ ও ৩১ নম্বর খুঁটির কাছে। পদ্মা সেতুর সুপার স্ট্রাকচারবাহী ‘তিয়ান ই হাউ’ জাহাজটির ৩৬শ’ টন ক্ষমতার ক্রেন স্প্যানটি খুঁটির এক মিটার উপরে তুলে রেখেছে। খুঁটি দুটির চার কোনায় চারটি উচ্চক্ষমতার বিয়ারিং স্থাপন করা হয়েছে। এ বিয়ারিংয়ের মধ্যেই বসিয়ে দেয়া হবে প্রায় ৩ হাজার ২শ’ টন ওজনের স্টিলের এই স্প্যান। ১৫০ মিটার দীর্ঘ স্প্যানটি স্থাপন হলেই সেতুর অবয়ব স্পষ্ট বোঝা যাবে। সেতুটির ৪২টি খুঁটির ওপর এমন ৪১টি ধূসর রঙের স্প্যান বসবে। দীর্ঘ চেষ্টার পর সেতুর এ কাজের অগ্রগতিকে ঘিরে এখন বিশেষ পরিবেশ বিরাজ করছে। সবার চোখ এখন জাজিরা প্রান্তে। এই মাহেন্দ্রক্ষণটি অবলোকন করার জন্য সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের হেলিকপ্টারের করে আসছেন এখানে। এছাড়া ঢাকা থেকে সংবাদকর্মীদের বড় একটি দল আসছে এখানে। এ রিপোর্ট লেখার সময় সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, স্প্যানটি স্থাপানের সব আয়োজন সম্পন্ন। এখন শুধু স্থাপন করা বাকি। শনিবার সকাল ১০টার মধ্যে এ স্প্যান স্থাপন করা সম্ভব হবে। তবে আকস্মিক নিম্নচাপের কারণে আবহাওয়ার কিছুটা প্রতিকূলতা নিয়ে সেতু কর্তৃপক্ষ চিন্তিত। তবে সবকিছু ছাপিয়ে পদ্মার বুকে সেতুবন্ধের আরেকটি ধাপ এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এ পর্যন্ত মূল সেতুর অর্ধেকেরও বেশি সম্পন্ন হয়ে গেছে। সেতু দৃশ্যমান না হলেও সেতুর ভিত তৈরির অনেক কাজ এগিয়েছে। সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্যানুযায়ী, এ পর্যন্ত মূল সেতুর ৫৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া পুরো সেতুর কাজের অগ্রগতি এখন ৪৭ শতাংশের বেশি। পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক সফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, সেতুটির প্রথম স্প্যান স্থাপানে কোন আনুষ্ঠানিকতা হচ্ছে না। শুক্রবার বৃষ্টি সত্ত্বেও পদ্মা সেতুতে অবিরাম কাজ চলেছে। নির্মাণযঞ্জের নিয়মিত কাজের মাঝেও শুক্রবার সংশ্লিষ্টদের বিশেষ উদ্যমী মনে হয়েছে। সেতুর দীর্ঘ সময়ের কাজ চোখে পড়ছিল না। আর এখন সে-ই কাজ দৃশ্যমান হচ্ছে এটি ভাবতেই সবার ভাললাগছে। নানা কারণে দায়িত্বশীলরা নাম প্রকাশ করতে রাজি না হলেও তাদের মনের কথাগুলো প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশী এক প্রকৌশলী বলেছেন, এ কাজের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকে এ অবস্থায় নিয়ে আসার ভাললাগা যে কত বেশি তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এই প্রকৌশলী বলেন, খরস্রোতা পদ্মায় এ সেতু বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সবকিছুই সফলভাবে সম্পন্ন করা গেছে। এর মূলে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চাইনিজ এক প্রকৌশলী বলেছেন, বাংলাদেশীরা ভাগ্যবান যে তাদের প্রধানমন্ত্রী এত সাহসী। গত রবিবার সকাল থেকে স্প্যানটি স্থাপানে চূড়ান্ত কাজ শুরু হয়। রবিবার সকালে মাওয়ার কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডের ওয়ার্কশপ থেকে স্প্যান নিয়ে ‘তিয়ান ই হাউ’ জাহাজটি রওনা হয় ছয় কিলোমিটার দূরের গন্তব্যে। রাতে ২৩ নম্বর পিয়ারের সামনে যাত্রবিরতি করে। সোমবার সকালে স্প্যানবাহী জাহাজটি ফেরি চ্যানেল ক্রস করার সময় সকাল ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত এ চ্যানেলে ফেরিসহ সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখা হয়। পরে সোমবার দুপুরেই স্প্যান পৌঁছেছে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়। সেতুতে মোট ৪২টি পিলার থাকবে। এর মধ্যে ৪০টি পিলার নির্মাণ করা হবে নদীতে। দুটি নদীর তীরে। নদীতে নির্মাণ করা প্রতিটি পিলারে ছয়টি করে পাইলিং করা হয়েছে, যার দৈর্ঘ্য গড়ে প্রায় ১২৭ মিটার পর্যন্ত। একটি পিলার থেকে আরেকটির দূরত্ব ১৫০ মিটার। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুতে দুটি পিলারের ওপর বসবে ৪১টি স্প্যান। ভায়াডাক্টসহ দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে ৯ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় হবে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। আগামী বছরের ডিসেম্বরে কাজ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রকৌশলীরা জানান, নদীতে মূল সেতুর এখন ৫৭টি পাইল সম্পন্ন হয়ে গেছে। এছাড়াও বটম অবস্থায় রয়েছে আরও ২০টি পাইল। এছাড়া জাজিরা প্রান্তে সংযোগ সেতুর ১৮৪টি পাইল বসেছে। এখানে আর মাত্র ৯টি পাইল বাকি সংযোগ সেতুর (ভয়াডাক্ট) জন্য। আর মাওয়ায় এ পর্যন্ত সংযোগ সেতুর ৭টি পাইল বসেছে। মূল সেতুর কাজ করছে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। আর নদী শাসনের কাজে নিয়োজিত আছে চীনের সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন। পদ্মা সেতুর কাজ ৫ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। মূল সেতু ও নদী শাসন হচ্ছে বড় দুটি কাজ। এর বাইরে দুই পারে সংযোগ সড়ক ও টোলপ্লাজা নির্মাণ এবং অফিস, বাসাসহ নির্মাণ অবকাঠামোর কাজ ৩ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইমলাম জানান, বাকি ১৪টি পিয়ারের ডিজাইনের কাজ চলছে। আমরা আমাদের একজন অফিসারকে লন্ডনে পাঠিয়েছি ডিজাইন টিমের সঙ্গে কাজ করতে। কাজ চলছে। আমরা চেষ্টা করছি যত দ্রুত সম্ভব ডিজাইন চূড়ান্ত করতে। তিনি হ্যামার সম্পর্কে বলেন, যেহেতু হ্যামার একটি যন্ত্র। যন্ত্র বিকল হতে পারে। আগের হ্যামার যেহেতু বিকল হয়েছে, কাজ করতে পারেনি, আমরা বড় আরেকটি হ্যামার আনছি। আগের হ্যামারে রিপিয়ারিং চলছে, একটি ঠিক হয়েছে। কাজ করছে। আরেকটির রিপিয়ারিং চলছে, সময় লগবে। আরও একটি হ্যামার নবেম্বরের শেষের দিকে এখানে আসার কথা রয়েছে। ডিসেম্বরের প্রথম সম্পাহ থেকে ওই হ্যামরটি এখানে কাজ করবে। তিনি বলেন, আসলে আমাদের এখানে একটি হ্যামার কাজ করার কথা ছিল। কিন্তু সে অবস্থা, ডিজাইন করার সময় তা বোঝা যায়নি। যার দরুণ আমাদের এখানে এখন তিনটি হ্যামার কাজ করছে। যেহেতু হ্যামারগুলো বিকল হচ্ছে, কাজ করতে পারছে না, তাই বেশি আনা হচ্ছে যাতে আমরা সময়মতো কাজ শেষ করতে পারি। বড় দুই হ্যামার পাইল স্থাপন করছে ১৩ ও ৩৬ নম্বর পিলারে। স্প্যান বসছে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারে। স্প্যান বসানো উপযোগী করার জন্য অন্যান্য পিলারেরও কাজ চলছে। তাই প্রথম স্প্যান উঠে যাওয়ার পর অল্প সময়ের বিরতে ক্রমেই স্প্যান উঠবে। পদ্মা সেতুতে ৪১টি স্প্যান বসবে।
×