ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কোন রাষ্ট্র, সংগঠন এমনকি কোন ব্যক্তিও আবেদন করতে পারে- অভিমত আইনজ্ঞদের

মিয়ানমারের মানবতা বিরোধী অপরাধ ॥ আইসিসিতে বিচার সম্ভব

প্রকাশিত: ০৪:৫০, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

মিয়ানমারের মানবতা বিরোধী অপরাধ ॥ আইসিসিতে বিচার সম্ভব

আরাফাত মুন্না ॥ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের দায়ে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে (আইসিসি) মিয়ানমারের বিচার সম্ভব বলে জানিয়েছেন আইনজ্ঞরা। যে কোন রাষ্ট্র, সংগঠন এমনকি কোন ব্যক্তিও আইসিসির কাছে বিচারের আবেদন করতে পারেন। চলমান গণহত্যা, ধর্ষণের সঙ্গে ঘরবাড়িতে আগুন দিয়ে কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। স্বাধীনতা অর্জনের কয়েক বছর পর থেকেই মিয়ানমার রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন শুরু হয়। সত্তরের দশকে যা প্রকট আকার ধারণ করে। যখনই রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী জুলুম-নির্যাতন শুরু করেছে তখনই রোহিঙ্গারা পালিয়ে এসেছে এ দেশে। গত ২০ দিনে আসা পাঁচ লাখসহ প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার ভার বহন করছে বাংলাদেশ। এছাড়া প্রতিবেশী দেশগুলোতেও আশ্রয় নিচ্ছে তারা। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বলছে, এখনও রাখাইনের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় আগুন জ¦লছে। সারাবিশে প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নারকীয় এই হত্যাযজ্ঞ থেমে নেই। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আইসিসির প্রসিকিউশন টিমকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানানো যেতে পারে। বিচারের পাশাপাশি বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমারের কাছে ক্ষতিপূরণও দাবি করতে পারে। আইন বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক গণ-আদালতের রায়ে মিয়ানমার দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর দেশটির বিরুদ্ধে এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রসিকিউশন বিভাগ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত করতে পারে। অন্যদিকে, মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালতের মুখোমুখি করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা দিতে নাগরিক কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। মিয়ানমারে চলমান গণহত্যা এবং সন্ত্রাসের তদন্তে কাজ করবে এই কমিশন। এই কমিশন এক মাসের মধ্যে কক্সবাজারে গিয়ে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের বক্তব্য শুনবে বলে জানান সংগঠনটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। ‘রোম স্ট্যাটু অব ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল (২ পৃষ্ঠা কোর্ট ১৯৯৮’-এর অনুচ্ছেদ ১৩ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের পাশাপাশি মিয়ানমারের সেনাপ্রধানকে ‘সুপিরিয়র রেসপনসিবিলির’ দায়ে অভিযুক্ত করা সম্ভব, বলে মত দিয়েছেন গণহত্যা নিয়ে কাজ করছেন এমন গবেষকরা। রোম স্ট্যাটু অব ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট ১৯৯৮-এ বলা হয়েছে, ‘যেসব সদস্য দেশ রেকটিফাই করে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের (আইসিসি) পূর্ণাঙ্গ সদস্য হয়েছে তারা যদি এ ধরনের কোন অপরাধ সংঘটিত করে তাদের বিচার আইসিসি করতে পারবে।’ কিন্তু মিয়ানমার রেকটিফাই করেনি। তবে আইন বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ক্ষেত্রেও উপায় আছে। নিরাপত্তা পরিষদ একটি রেজ্যুলেশন পাস করে সরাসরি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টকে (আইসিসি) বিচারের জন্য বলতে পারে। এছাড়াও বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমারের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে। যেহেতু মিয়ানমার নির্যাতন করে তাদের নাগরিকদের আমাদের দেশে পাঠিয়েছে, সেহেতু ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) গিয়ে রোহিঙ্গাদের খাবার, আশ্রয়, ভরণপোষণ চেয়ে ক্ষতিপূরণ চাইতে পারবে বাংলাদেশ। কেবল ফিরিয়ে নিলেই হবে না, হাজার হাজার মানুষ হত্যার দায়ে মিয়ানমারকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, ‘এ ধরনের গণহত্যার বিচারের জন্য বিশ্বে একটি স্থায়ী আদালত আছে। রোম স্ট্যাটু অব ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট ১৯৯৮-এর অনুচ্ছেদ ১৩ অনুযায়ী আইসিসিতে মিয়ানমারের বিচার করা সম্ভব।’ কিভাবে বিচার করা যাবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তা কাউন্সিল রেজ্যুলেশন পাস করে সেটা রেফার করে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে পাঠাতে পারে। এরপর আইসিসি স্বপ্রণোদিত হয়ে অনুসন্ধান করে মামলা নিতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের সাম্প্রতিক বক্তব্য গণহত্যাকে উস্কানি দেয়ার শামিল। আমাদের মনে রাখতে হবে সেরু সাগু একজন সিভিলিয়ান ছিলেন এবং তার বিচার রুয়ান্ডাতে হয়েছে। সে ক্ষেত্রে মিয়ানমারের ‘সুপিরিয়র রেসপনসিবিলির’ দায়ভার আউং সান সুচিকে নিতে হবে।’ বাংলাদেশের আইনে কিভাবে বিচারটি করা সম্ভব প্রশ্নে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল বলেন, ‘আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন অনুসারে বিচার করতে হলে অপরাধটি বাংলাদেশে সংঘটিত হতে হবে। কিন্তু আইনের সর্বজনীন এখতিয়ারও রয়েছে। সে অনুযায়ী, অন্য দেশে মানবতাবিরোধী কোন অপরাধ করে যদি আমাদের দেশে আশ্রয় নেয় তাহলে আমরা আমাদের আইন অনুযায়ী ওই ব্যক্তির বিচার করতে পারব। অর্থাৎ অপরাধীকে বিচার করতে হলে তাকে কখনও না কখনও বাংলাদেশে আসতে হবে।’ তবে আইনের কিছু সংশোধন করে বাংলাদেশেও বিচার সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। গণ-আদালতের রায় আমলে নিতে পারে আইসিসি ॥ গত ২২ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা ইস্যুতে মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক গণ-আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে মিয়ানমার। দেশটির বিরুদ্ধে এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রসিকিউশন বিভাগ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত করতে পারে। তদন্তকালে ওই গণ-আদালতের রায়, গণমাধ্যমের ছবি ও ভিডিও রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে পারে প্রসিকিউশন। এরপর আইসিসিতে মামলা হলে সেই আদালতও এগুলো রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। কেনিয়াসহ কয়েকটি দেশের বিরুদ্ধে আইসিসির এমন তদন্ত কার্যক্রম এখন চলছে। রোহিঙ্গা নিধন প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক গণ-আদালতের রায়ের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের আইনজ্ঞরা এসব কথা বলেন। তারা বলেন, মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক গণ-আদালতের রায়ের আইনগত ভিত্তি না থাকলেও এর প্রভাব রয়েছে। এই রায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিশ্বে জনমত সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে। তারা আরও বলেন, যদিও গণ-আদালতে প্রতীকী বিচার হয়েছে, বিচারকরা প্রতীকীভাবেই আইসিসির বিধানগুলো অনুসরণ করেছেন, এর উদ্দেশ্য ছিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিল যাতে আন্তর্জাতিক আইনের বিধানগুলো অনুসরণ করে সুচিসহ মিয়ানমারের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইন মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে। এ বিষয়ে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, এ গণ-আদালতের রায়ের আইনগত ভিত্তি না থাকলেও এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জনমত সৃষ্টিতে ও প্রভাব বিস্তারে সক্ষম। যেখানে গণহত্যার বিচারের জন্য একটি স্থায়ী আন্তর্জাতিক আদালত আছে, সেখানে আন্তর্জাতিক বিশ্বের উচিত সেই স্থায়ী আদালত অর্থাৎ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) মিয়ানমারের নেতৃবৃন্দের বিচারের জন্য চাপ সৃষ্টি করা। আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, মিয়ানমার যে তাদের দেশে গণহত্যা চালাচ্ছে, গণ-আদালতের এই রায়ে তা প্রমাণিত হয়েছে। এই রায়কে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জোরালোভাবে তুলে ধরতে পারে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এ বিষয়ে ভূমিকা নিতে পারে। মিয়ানমারে সংঘটিত গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের বিচারের জন্য রুয়ান্ডার মতো ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যেতে পারে বলে মনে করেন এই বিচারপতি। এদিকে মালয়েশিয়ার গণ-আদালতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক অংশ নিয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে বলেছেন, মিয়ানমারের নাগরিকদের হত্যা ও নির্যাতনের করণে জাতিসংঘ, আসিয়ান, ওআইসিসহ বিশ্বের অন্যান্য আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান যেন মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। যাতে এই নির্যাতন বন্ধ হয় এবং যেসব নাগরিক বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে তাদের যেন নিজ দেশে ফেরত নিয়ে যাওয়া হয়। নির্মূল কমিটির নাগরিক কমিশন ॥ মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালতের মুখোমুখি করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা দিতে নাগরিক কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। সম্প্রতি এক সেমিনারে এই ঘোষণা দেন সংগঠনের সভাপতি শাহরিয়ার কবির। অনুষ্ঠানে শাহরিয়ার কবির বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে পাঁচ দফা এটা আমরা দৃঢ়ভাবে সমর্থন করি এবং এটা বাস্তবায়নের জন্য নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে যা কিছু করা প্রয়োজন তাই করব। তিনি বলেন, এর সঙ্গে আমরা নতুন করে আরেকটি বিষয় যুক্ত করতে চাই। আমরা কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে, সে দেশের সরকারকে আন্তর্জাতিক আদালতে দাঁড় করাতে চাই। এই উদ্যোগের জন্য যদি সরকার সহযোগিতা চায় নির্মূল কমিটি তা করবে। এর প্রস্তুতি হিসেবে আমরা আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে মিয়ানমারের গণহত্যা এবং সন্ত্রাসের বিষয়ে তদন্তে জন্য নির্মূল কমিটি নাগরিক কমিশন গঠন করবে। আর এক মাসের মধ্যে এই কমিশন কক্সবাজারে যাবে এবং গণশুনানির ব্যবস্থা করবে। নির্যাতিতদের বক্তব্য নেবে। আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে হলে এই কমিশনের স্বেতপত্র কাজে লাগবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
×