ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাধার মুখে গতি পাচ্ছে না এসটিএস

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বাধার মুখে গতি পাচ্ছে না এসটিএস

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানী ঢাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গতি আনতে বিভিন্ন ওয়ার্ডে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হলেও স্থান সঙ্কুলান, প্রভাবশালী ও স্থানীয়দের বাধা ও মামলার কারণে গতি পাচ্ছে না প্রকল্পটি। প্রথম অবস্থায় কয়েকটি স্থানে নির্মাণ কাজ শুরু হলেও এরইমধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেশ কয়েকটির নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। এ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি ক্ষোভ রয়েছে খোদ দাতাসংস্থারও। এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) ইতোমধ্যে ৫৭টি এসটিএস নির্মাণ করলেও তা পরিবেশবান্ধব নয় বলে অভিযোগ নগরবাসীর। ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, গত (২০১৬-১৭) অর্থবছরে আরবান পাবলিক এ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট হেলথ সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (ইউপিইএইচএসডিপি) আওতায় ডিএসসিসির বিভিন্ন এলাকায় ৫০টি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। এর মধ্যে প্রথম ধাপে ১৫টি এসটিএস নির্মাণ করার কথা। কিন্তু নির্মাণকাজের শুরুতেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম, কাজে ত্রুটি, প্রভাশালীদের বাধা, আদালতে মামলা, জমি নিয়ে বিরোধ ও বেদখলের কারণে কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। দুই-একটি স্থানে প্রকল্পের কাজ শুরু করা হলেও তা বন্ধ রয়েছে। ডিএসসিসির এক হিসাবে জানা গেছে, মূলত জনবহুল ঢাকার পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে ১৯৯৪ সাল থেকে রাস্তার ওপর এসব কন্টেনারে ময়লা রাখার পদ্ধতি চালু হয়। দীর্ঘ ২৩ বছরেও তা পরিবর্তনের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। জনসাধারণের দুর্ভোগ লাঘবে এসব কন্টেনারের বদলে প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে মোট ৫৭টি এসটিএস নির্মাণের উদ্যোগ নেয় ডিএসসিসি। হাজারীবাগে একটি এসটিএস নির্মাণ শেষে তা উদ্বোধন করতেও সক্ষম হয় প্রতিষ্ঠানটি। সূত্র জানায়, ঘনবসতিপূর্ণ এ নগরীতে প্রতিদিন প্রায় ৮ হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে ডিএসসিসিতে উৎপন্ন হয় তিন হাজার ২০০ থেকে সাড়ে তিন হাজার টন। যা থেকে মাত্র দুই হাজার ২০০ থেকে আড়াই হাজার টন বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। বাসাবাড়ি থেকে এসব বর্জ্য সংগ্রহ করে এসটিএসে রাখা হয়। কিন্তু নগরীর এসটিএসগুলো পরিবেশবান্ধব না হওয়ায় সিংহভাগ বর্জ্যই বিভিন্ন মাধ্যম হয়ে নগরীর অলিগলি, ড্রেন ডোবাসহ বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে যায়। এসব বর্জ্য সংগ্রহের জন্য সংস্থাটির নিয়মিত পাঁচ হাজার ২১৮ কর্মীর পাশাপাশি প্রাইমারি কালেকশন সার্ভিস প্রোভাইডার (পিসিএসপি) কর্মী রয়েছেন তিন হাজার ৫০০ জন। এছাড়া অস্থায়ী কর্মী রয়েছেন এক হাজার ৫১৫। সব মিলিয়ে ডিএসসিসিতে পরিচ্ছন্নতা কর্মী রয়েছেন ১১ হাজার ২০৭। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আধুনিকায়ন করতে যে ৫০টি এসটিএস নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তার মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ১৫টির মতো নির্মাণ কাজের উদ্যোগ নেয় প্রতিষ্ঠানটি। বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে নির্মাণ করা হবে। তবে যে কয়টি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, এর মধ্যে ১২টিতেই রয়েছে নানা সমস্যা। ডিএসসিসির নিজস্ব এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। ডিএসসিসির ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, যাত্রাবাড়ী কাঁচাবাজারের উত্তরপাশের খালি জায়গায় এসটিএস নির্মাণ চলাকালে কর্পোরেশনের অঞ্চল-৫ থেকে তা বন্ধ করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে মেয়র প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে ওই বাজারের জন্য ছোট আকারের এসটিএস নির্মাণের নির্দেশ দেন। যে কারণে এই স্থানটির নির্মাণ শেষ করা যাচ্ছে না। নিউমার্কেটের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে এসটিএস নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাধার মুখে তা বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে পান্থকুঞ্চে তা স্থানান্তর করে নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হলে তাতেও হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই স্টেশনটি নিয়ে পরিবেশবাদীদের আপত্তি ছিল। পুরান ঢাকার আনন্দবাজার সংলগ্ন প্রগতি ডেইরি ফার্ম প্রকল্পটির নির্মাণ কাজে বিভিন্ন ত্রুটি ধরা পড়েছে। এর মধ্যে ভ্যান ও লিফটার মোটরের বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ, বৈদ্যুতিক বাল্ব পরিবর্তন, সাইট ওয়ালে বৈদ্যুতিক পাখা স্থাপন ও স্টোর রুমের দরজা না লাগানোসহ একাধিক ত্রুটি ধরা পড়েছে। এ জন্য প্রকল্পের নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। ২০১৬ সালের মধ্যে জুরাইন কবরস্থান স্টেশনটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে প্রকল্পের ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে দাবি করা হলেও বাস্তবে ৬০ শতাংশ কাজও শেষ হয়নি। হাজারীবাগের মেটাডর এলাকার প্রকল্পটির কাজ শুরু করা হলে স্থানীয় এক বাসিন্দা আদালতে রিট করেন। ফলে প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরে সিটি কর্পোরেশন রিটকারীর সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি সমাধান করে। এরপর নির্মাণ কাজ শেষে এসটিএসটি চালু করা হয়েছে। ২০১৩ সালের দিকেই হাজারীবাগের আকাশ অটো মোটর ওয়ার্কশপ প্রকল্পটির পরিবেশগত ছাড়পত্র নেয়া হয়। কিন্তু এরপর থেকে স্থানীয় একটি মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের বাধার কারণে এখনও প্রকল্পের কাজ শুরু করা যায়নি। তাছাড়া, বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য এসটিএস নির্মাণের স্থানটিসহ সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ২৪১ ফুট জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়েছে। যে কারণে প্রকল্পটিও স্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে স্থানীয় সংসদ সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে এ স্থানটিতেই প্রকল্পটি স্থাপন করতে চায় সিটি কর্পোরেশন। এ জন্য কর্পোরেশনের সম্পত্তি বিভাগ থেকে প্রকল্পের সীমানা নির্ধারণ করে প্রকল্পের কাজ শুরুর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আগামী বছরের মধ্যে এর কাজ শেষ করতে হবে। আজিমপুর সরকারী কলোনি স্টেশনটি নির্মাণ নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে ডিএসসিসি এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত অধিদফতর। বিষয়টি নিয়ে একাধিক চিঠি চালাচালির পর থানায় সাধারণ ডায়েরি পর্যন্ত হয়েছে। গণপূর্তের অভিযোগ, সিটি কর্পোরেশন তাদের জায়গায় কোন অনুমতি না নিয়েই এসটিএস নির্মাণ করছে। আর সিটি কর্পোরেশন বলছে, বিষয়টি নিয়ে তাদের একাধিকবার চিঠি দেয়া হয়েছে। জনগণের কথা চিন্তা করে সেখানে এসটিএস নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বর্তমানে প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে। ঢাবির ফিজিক্যাল মাঠের দক্ষিণ পাশের গ্যারেজ সংলগ্ন খালি জায়গায় এরই মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে জমি বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। ঠিকাদারও নির্মাণ কাজের ফেন্সিং করেছেন। কিন্তু এতে আপত্তি তোলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরে বিশ্বদ্যালয়ের উপচার্যকে প্রধান করে এসটিএস নির্মাণের বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয়। কমিটি এ স্থানটির পরিবর্তে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি গেট সংলগ্ন খালি জায়গায় এসটিএস নির্মাণের জন্য মতামত দেয়। সিটি কর্পোরেশনও তাতে সম্মতি দেয়। কিন্তু সেখানে এখনও কাজ শুরু হয়নি। উসমানী উদ্যানের ওয়াকওয়ে বিনষ্ট, পরিবেশবাদীদের মামলা ও পরিবেশ বিনষ্টের কথা চিন্তা করে উদ্যানের খালি জায়গায় এসটিএস নির্মাণ না করার মতামত দিয়েছেন ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ বিলাল। তাছাড়া সংস্থার প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাও পার্কের পরিবেশের কথা চিন্তা করে এ থেকে সরে দাঁড়ানোর প্রস্তাব দেন। ফলে এসটিএস নির্মাণের জন্য বিকল্প স্থান খুঁজছে ডিএসসিসি। ধানম-ি লেক সংলগ্ন খালি জায়গায় এসটিএস নির্মাণে আপত্তি রয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্যের। তবে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে তার সঙ্গে কয়েকবার আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু প্রথম অবস্থায় ইতিবাচক কোন সিদ্ধান্ত না এলেও পরে বিষয়টি সমাধান করা হয়েছে। বর্তমানে এ স্টেশনটির নির্মাণ কাজ চলছে। ধলপুর স্টাফ কোয়ার্টার সংলগ্ন এলাকায় সিটি কর্পোরেশনের এসটিএস নির্মাণের স্থানটি নিয়ে কোন ঝামেলা না থাকলেও এখনও কাজ শুরু করতে পারেনি সংস্থাটি। এ জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংস্থার উর্ধতন কর্মকর্তারা। নবাবগঞ্জ পার্কের পাশের খালি জায়গা সিটি কর্পোরেশনের মালিকানাধীন স্থানটি দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত রয়েছে। কিন্তু এতে এসটিএস নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হলেও স্থানটিতে স্থানীয়দের বাধা রয়েছে। ফলে প্রকল্পটি এখনও বাস্তবায়ন করতে পারছে না সিটি কর্পোরেশন। চলতি বছরের মার্চের মধ্যেই এর কাজ শেষ করার নির্দেশনা ছিল। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থার অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা খন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম বলেন, আমরা ৫০টি এসটিএস নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। এখন পর্যন্ত ২০টির মতো এসটিএসের নির্মাণ কাজ চলছে। কয়েকটির উদ্বোধন হয়েছে। আবার কয়েকটিতে মামলাসহ বিভিন্ন জটিলতা আছে। সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। আশা করি, দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধান হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, প্রথম অবস্থায় এসটিএস নিয়ে মানুষের মধ্যে একটা ভুল ধারণা ছিল। তারা মনে করত, এসটিএস নির্মাণ হলে আশপাশে গন্ধের জন্য থাকা যাবে না। দুই-একটি নির্মাণের পর মানুষের সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। এখন মানুষ আর বাধা দিচ্ছে না।
×