ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অজয় দাশগুপ্ত

প্রবাসে আওয়ামী রাজনীতি ও প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা

প্রকাশিত: ০৪:২৬, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

প্রবাসে আওয়ামী রাজনীতি ও প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা

প্রধানমন্ত্রী আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি এমন কথা প্রায়ই বলে থাকেন, তবে মাঝে মাধ্যে তার ঝলকানি দেখে মনে হয় এটা তো আগে ভাবিনি। আগে বলে রাখি প্রধানমন্ত্রীর সফরকে নিয়ে এবারও দ্বিধাবিভক্ত বাংলাদেশীরা দেশের মানমর্যাদার কথা ভাবেনি। একমাত্র আমাদের দেশের মানুষ ছাড়া বাকি কোন দেশের মানুষের ভেতর এই প্রবণতা দেখা যায় না। বিশেষত কোন দেশ বা সমাজ যুদ্ধংদেহী কোন পরিবেশে না থাকলে সামান্য রাজনৈতিক মতবিরোধের জন্য তারা রাস্তায় নেমে বা বিদেশীদের হাসিয়ে প্রতিবাদের নামে দেশকে ছোট করে না। ভিডিওতে দেখলাম জাতিসংঘের সামনে দু’দল বাংলাদেশীর মারামারিরত চেহারা। সমানে ইটপাটকেল ছুড়ছিল তারা। আর আমেরিকান পুলিশ একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে দৌড়াদৌড়ি করছিল। তাদের এই গলদঘর্ম চেহারা আর বয়ে নিয়ে যাওয়া অভিজ্ঞতা কাদের ছোট করল আসলে? কি কারণ ছিল বিএনপির এমন করার? তাদের নেতারা তো দেশেই যা বলার বলছে। প্রায় প্রতিদিন রিজভী কৌতুক বলছেন আর জনগণ হাসছে। এরপর আর কি বলার আছে তাদের? মির্জা সাহেব পরিমিত ভাষায় ছিদ্র খুঁজছেন। বাকি থাকল কি? তাছাড়া এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যাওয়াটা ছিল দেশ, জাতি ও আমাদের সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এবার তিনি জাতিসংঘে কি নিয়ে বলবেন সেটা আমাদের অজানা কিছু নয়। আমরা এও জানি সঙ্কটে ঐক্য আর বন্ধন ছাড়া মুক্তি নেই আমাদের। তারপরও পারা গেল না। গদিলোভী রাজনীতি আর বিভেদের অতীত বর্তমানকে যেমন বিষিয়ে রেখেছে, ভবিষ্যতকেও ছাড় দিচ্ছে না। বিদেশীরা দেখল আমরা আসলে ঐক্যহীন। অথচ মিয়ানমার যার সঙ্গে আমাদের এখন দা-কুমড়া সম্পর্ক চলছে তাদের ভেতর এই ঝামেলা নেই। তারা এক ঢিলে অনেক পাখি মারছে। তাদের হিসাব মতো ক্রমবর্ধমান রোহিঙ্গাদের সমস্যা মনে করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। জাতিগত সংঘাতকে সন্ত্রাস বলে চালিয়ে দিচ্ছে। আর আউং সান সুচিকে এমন ফাঁদে ফেলেছে তার সামনে এখন আর কোন পথ খোলা নেই। ফাঁদটা এমন, তিনি এতকাল ধরে বিশ্বের নজরে ছিলেন গণতন্ত্রের প্রবক্তা হিসেবে, তাকে মনে করা হতো বর্মা বা মিয়ানমারের মুক্তিদূত। সামরিক শাসনে দীর্ঘকাল আটকেপড়া সুচি স্বামীকে দেখতেও যেতে পারেননি। এমন মহীয়সী টাইপের মহিলাকে সামরিক জান্তারা ফেলেছে তাদের ফাঁদে। দেশ আর গদি বা শাসনকার্য এক বিষয় নয়। সেটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দেয়া হচ্ছে তাকে। বলাবাহুল্য, আমি তার জন্য মায়াকান্না কাঁদার লোক না। বরং অবাক হচ্ছি আমাদের দেশের নোবেলজয়ী আর তার ভেতরে কেমন মিল। কেউই দেশের কঠিনতম পরিবেশে বা ভয়াবহ কোন অবস্থায় রুখে দাঁড়াতে পারেন না। এটা কি সময়ের সঙ্গে বদলে যাওয়া মেরুদ-হীন মানুষের প্রমাণ? না এর ভেতর আছে আন্তর্জাতিক চাপ? সে যাই হোক, সুচি এখন ঘোর বিপাকে। অন্যদিকে আমাদের নেত্রী শরণার্থী সঙ্কটের দায় নিয়ে আরও বেশি সপ্রতিভ ও উজ্জ্বল। যেটা দেখছি শেখ হাসিনার সমস্যা এখন দেশের কিছু উল্টাপাল্টা নেতা আর বিএনপি-জামায়াতের ফসিল। প্রান্তিক নামে পরিচিত দরিদ্র ও হেভ নট সমাজের মানুষদের মগজ ধোলাই করা রাজনীতি এদের এখনও এগিয়ে রাখে বলেই এরা সুবিধাভোগী। মিডিয়ায় দেখুন, বিগত দশ বছর ঘরবন্দী বিএনপি নেতাদের কভারেজ দেয়ার জন্য কেমন মুখিয়ে আছে। তারা কি একবারও জানতে চেয়েছে নতুন প্রজন্ম বা আমাদের সন্তানরা আসলে রিজভী সাহেবদের চেনে কি-না? আর এক সমস্যা আওয়ামী লীগের নিজেদের ভেতর। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে প্রবাসীদের বলেছেন আচার-আচরণ ও ভাষা সংযত করতে। কারণ, এতেই ভোট বাড়ে। এটা তিনি দেশের নেতাকর্মীদের বেলায়ও বলেছেন। তিনি ব্যস্ত মানুষ। তাঁর অনেক কাজ। আমি তো ভাবি যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান না হলে তিনি তৃণমূলের এত খবর রাখতেও পারতেন না। তাঁর কাঁধে দেশ রাজনীতি এখন রোহিঙ্গা ভারত চীন চাপিয়ে কি আনন্দেই না সরকার চালাচ্ছেন অন্যরা। আমি বলি দেশ চালান প্রধানমন্ত্রী আর সরকার চালায় বাকিরা। তাই তিনি জানতে পারেন না এই সিডনিতেও আওয়ামী রাজনীতির কি ভয়াল চেহারা। প্রবাসে দেশের রাজনীতির দরকার সেদিনই আর থাকবে না যেদিন আমরা সবাই মিলে বঙ্গবন্ধু, জাতীয় সঙ্গীত, মাটি ও বাঙালী সংস্কৃতিকে ধারণ করে মৌলবাদকে বিদায় জানাতে পারব। তার আগে এমনটি চাইলেও হবে না। ফলে এটুকু দরকার থাকার পরও আওয়ামী লীগের বিদেশী নেতারা মনে করেন তারাই সর্বেসর্বা। ভাঙতে ভাঙতে এমন হাল কর্মী পাওয়া যায় না। খালি নেতা আর নেতা। যারা বছরের পর বছর ধরে নেতা ছিলেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ আওয়ামী ঘেঁষা আওয়ামী লীগের কল্যাণকামীদের সঙ্গে এমন আচরণ করেন যা জামায়াতীরাও করে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি আপনাকে বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি এখানে অস্ট্রেলিয়ায় মুষ্টিমেয় আওয়ামী নেতার পাগলামি আর উন্মাদসুলভ আচরণে দলের ইমেজ ভয়াবহভাবে আক্রান্ত। তারা আমাদের মতো নিরীহদের ওপর সব সময় খ—গহস্ত। কারণ, তাদের ধারণা বাংলাদেশের মিডিয়ায় তাদের নামধাম, কাজগুলো প্রথম পাতায় ছাপাতে হবে। দেশ রাজনীতি সমাজে বিন্দুমাত্র অবদানহীন এই মানুষগুলোকে আপনার মন্ত্রীরা আসলে ডিনার খাইয়ে সভা করা ছাড়া আর কি করেন আমি জানি না। আমি এও বলব, এই মুষ্টিমেয় নেতাদের চাইতে বিএনপি বা অন্য রাজনীতির নেতাদের আচরণে মানুষ সন্তুষ্ট। এটা কি দলের জন্য ভাল? আপনি কতটা দূরদর্শী বলে এই সমস্যার কথা বলেছেন এবং ইঙ্গিত করেছেন ভেবে অবাক হই। উত্তরণ ও সমাধানহীনভাবে একের পর এক শাখা খোলার পরিণতি জনবিচ্ছিন্নতা। আমি সাধারণ প্রবাসীদের ভেতর যতটা আওয়ামী লীগ ও আপনার জন্য দরদ দেখি, ততটাই এদের প্রতি ভয়ভীতি দেখি। মজার ব্যাপার এরা সবাই দেশ থেকে অনুমোদন নিয়ে আসে। বাইরের এই পরিবেশে আমরা এখন উদ্বিগ্ন। কারণ, এটা অনেকটা হাসির খোরাক বলেই সবাই বলে একটা হলে আরেকটা নাকি ফ্রি পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন আহমদ সৈয়দ নজরুল মনসুর আলী কামরুজ্জমান আর শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এমন হতে পারে না। আপনি তাদের নির্দেশ দিন প্রবাসের রাজনীতি মানে দুর্দিনে দেশ ও দলের পাশে দাঁড়ানো। প্রবাসে পথভ্রষ্ট বা আদর্শচ্যুত কিংবা ভুল বুঝতে থাকা বাঙালীকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনা। আর বিদেশে খাম্বা রাজনীতির ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা। এর বাইরে তাদের কাজ নেই। একমাত্র আপনিই পারবেন পথ দেখাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
×