ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হা-ডু-ডু খেলা

প্রকাশিত: ০৪:২১, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

হা-ডু-ডু খেলা

চিরায়ত বাংলার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চিত্ত বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হা-ডু-ডু খেলা। ঐতিহ্যবাহী এই হা-ডু-ডু খেলা লোকসংস্কৃতির একটি অংশ। আবহমানকাল ধরে দেশের গ্রামীণ জনপদের খেটে খাওয়া বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আনন্দ উপভোগের বিশেষ স্থান দখল করে আছে এই হা-ডু-ডু খেলাটি। এ খেলার প্রচলন ধীরে ধীরে হ্রাস পেলেও একবারে হারিয়ে যায়নি সমাজ থেকে। জনপ্রিয় এই খেলাটি বিভিন্ন উৎসবের সময় অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তবে আষাঢ় থেকে আশ্বিন মাস অর্থাৎ নতুন ধান না ওঠা পর্যন্ত গ্রামের মানুষের হাতে কোন কাজ থাকে না। এই অলস সময়ে গ্রামগঞ্জে হা-ডু-ডু খেলার প্রচলন দেখা যায়। দীর্ঘ চার মাসের মধ্যে কোনো উৎসব না থাকলে বিভিন্ন তিথিতে খেলার আয়োজন করা হয়। উত্তেজনাপূর্ণ হা-ডু-ডু খেলাটি উপভোগ করে সকল বয়সের মানুষ। গ্রামের কোন স্কুল মাঠে বা খোলা পতিত জমিতে কিংবা ফসল কাটা শূন্য ক্ষেতে প্রতিযোগিতামূলকভাবে খেলা আহ্বান করা হয়। প্রতিযোগিতার ক’দিন আগে থেকে এলাকায় টিনের চোঙ অথবা মাইক দিয়ে প্রচার করা হয়। নির্ধারিত দিনে হাজারো দর্শক এ প্রতিযোগিতা উপভোগ করে। আগের দিনে বিজয়ী ও বিজেতা দলকে শিল্ড, মেডেল, রেডিও, পিতলের কলস দিয়ে পুরস্কৃত করা হতো। আধুনিককালে পুরস্কারের ধরন পাল্টে গেছে। এখন পুরস্কার হিসেবে দেয়া হয় ট্রফি, মোটরসাইকেল, স্বর্ণের চেন, ফ্রিজ, টেলিভিশন, মোবাইল সেট, টাকা ইত্যাদি। কোন দলের তুখোড় ও শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়কে দেয়া হয় বিশেষ পুরস্কার। শুধু বিজয়ী ও বিজেতা দলকেই পুরস্কৃত করা হয় এমন নয়, প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া সকল খেলোয়াড়কে দেয়া হয় সান্ত¦না পুরস্কার। গ্রাম-বাংলায় প্রচলিত খেলার মধ্যে হা-ডু-ডু খেলার আবেদন একটু বেশি জনপ্রিয় এবং উত্তেজনাপূর্ণ। এ খেলায় মল্লযুদ্ধের অবতারণা ঘটে এবং শক্তি পরীক্ষার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ অঞ্চলে হা-ডু-ডু খেলা দুই পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ১. একজন খেলোয়াড়কে প্রতিপক্ষের একজন খেলোয়াড় দম বন্ধ করে থাকা অবস্থায় ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে তাদের নিজেদের কোটের সীমানার ধরে রাখতে হবে। ২. একই পদ্ধতিতে যৌথভাবে ধরে রাখতে হবে। তবে ওই খেলোয়াড় এক বা একাধিক খেলোয়াড়কে ছুঁয়ে নিজেদের কোটে ফিরে আসতে পারলে প্রতিপক্ষের সে বা তারা মরা বলে গণ্য হবে এবং পরবর্তী রাউন্ডে খেলতে পারবে না। প্রতি দলে ৫ থেকে ৯ খেলোয়াড় থাকে। দম বন্ধ করে একদমে ডুগ্ ডুগ্, ট্যাক্ ট্যাক্ বা কাবাডি কাবাডি উচ্চারণ করতে হবে। এখানে দম চুরি করার কোন সুযোগ নেই। ওই শব্দগুলো এমনভাবে উচ্চারণ করতে হবে যাতে পার্শ্ববর্তী দর্শক ও রেফারি শুনতে পায়। দর্শকনন্দিত এ হা-ডু-ডু খেলায় কখনও কখনও পক্ষ-প্রতিপক্ষের মধ্যে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে। পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উত্থাপন করে কোথাও কোথাও রেফারিকে মারধর করা হয়। অপ্রীতিকর ঘটনায় মাঝে মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়। কাবাডি বা হা-ডু-ডু খেলাটি বাংলাদেশের জাতীয় খেলা হলেও এর উৎপত্তি ও ইতিহাসের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ খাদ্য সংগ্রহ করার পাশাপাশি নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য একক ও দলীয়ভাবে শিকার করত। তখন তারা বন্যপ্রাণীর আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে যে কৌশল অবলম্বন করতো, সেই কৌশলের ধারণা থেকে কাবাডির সূচনা হয় বলে ইতিহাসবিদদের ধারণা। ভারত উপমহাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় কাবাডির প্রচলন থাকলেও এর উৎপত্তিস্থল পাঞ্জাব। তবে কাবাডির উৎপত্তি সম্পর্কে মতবিরোধ রয়েছে। এসব মতবিরোধের একটি হলো- মহাভারতে বর্ণিত আছে অভিমন্যু কর্তৃক কৌরব সৈন্যদের চক্রব্যূহ ভেদ করার ব্যর্থ চেষ্টার ঘটনা থেকে ধারণা নিয়ে কাবাডি খেলার সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয়ত- কাবাডি খেলার উৎপত্তি সম্পর্কে ধারণা করা হয় এ খেলার শুরু হয়েছে তামিলনাড়ু থেকে। সে দেশের দুটি শিশু ছেলের ছুঁয়োছুঁয়ির খেলা থেকে ধারণা নিয়ে এ খেলার সৃষ্টি হয়। তবে দম বন্ধ করে খেলোয়াড় ধরে রাখার প্রচলন অনেক পরে যুক্ত হয়। তামিলনাড়ুতে এ খেলাটি কাবাডি, সাডুগুডি, গুডুগুডু, পালিঞ্জাডুগুডু এবং সাডুগুডাত্থি নামে পরিচিত। ধারণা করা হয় কাবাডি শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে তামিল ভাষায় ‘কাই’ (হাত) ও ‘পিডি’ (ধরা) শব্দ থেকে। পরবর্তীতে খেলাটি ভারত ও পাকিস্তানে কাবাডি, বাংলাদেশে হা-ডু-ডু, নেপালে ডুডু, শ্রীলঙ্কায় গুডুগুডু, থাইল্যান্ডে থিকাব ও মালয়েশিয়ায় গুডুগুডু নামে প্রচলিত ছিল ব্যক্তিগত ও দলগতভাবে প্রতিপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করা এবং দ্রুত পাল্টা আক্রমণের কৌশল আয়ত্ত করতে গিয়ে এ খেলার উদ্ভব হয়েছে। সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে
×