ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘লেখাপড়া অইল নিজের উন্নয়ন ॥ ভাগ দেয়া লাগে না’

প্রকাশিত: ০৪:২০, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

‘লেখাপড়া অইল নিজের উন্নয়ন ॥ ভাগ দেয়া লাগে না’

তামাটে বর্ণের শরীরটাই একমাত্র পুঁজি আলমগীর ঘরামির। ত্রিশটি বছরই কেটেছে সাগরে ইলিশ ধরে। খুটা জেলে। কুয়াকাটায় জন্ম এ মানুষটির। এখন আর শরীর সায় দেয় না। কুলোয় না। তাই সাগরে যান না। অন্যের ছেড়া জাল সেলাই করেন। দৈনিক চার শ’ টাকা মজুরি পান। তা দিয়েই সংসারের যোগান দেন। জন্ম থেকে অভিজ্ঞতা সাগরে মাছ শিকার। বুঝতে পেরেছেন শুধু শরীরের পুঁজিতে জীবন চলে না। তাই চার সন্তানের জনক এ মানুষটির স্বপ্ন ছিল সকল সন্তানকে শিক্ষিত করার। করেছেনও তাই। জীবনের লড়াই ছিল যেমন সাগরের সঙ্গে, তেমনি মানুষটির স্বপ্ন বাস্তবায়নের দৃঢ় ইস্পাতকঠিন মনোবল রয়েছে। অদম্য দৃঢ়চেতার আলমগীরের চার জনই পুত্র সন্তান। বড় ছেলে শাইখুল ও মেজ বেল্লাল বিএ পড়ছে, ঢাকায়। সেজ ছেলে হেল্লাল উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে। কুয়াকাটা খানাবাদ কলেজ। আর ছোট শফিকুল ক্লাস টুতে পড়ছে। যেন স্বপ্নের বাস্তবায়ন করছেন। কোন ছেলের লেখাপড়ার পথকে রুদ্ধ হতে দেননি। এখন স্ত্রী শাহীনুরসহ ছয় জনের সংসারে নিজের যোগানের পাশাপাশি বড় দুই ছেলেও সাধ্যমতো যোগান দেয়। অভাব জিজ্ঞেস করতেই একটু ভেবে বললেন নেই। আবার বললেন, দেনা রয়েছে। প্রায় দুই লাখ টাকা। ব্যাংকসহ কয়েকজনের কাছ থেকে নেয়া। সাগরের তীব্র ভাঙ্গনের কোলে ঐতিহ্যবাহী ফার্মস এ্যান্ড ফার্মসের টিনশেড অফিস কাম বাংলোর নিচে ছেঁড়া জাল সেলাই করছিলেন আলমগীর ঘরামি। বললেন, ‘এহন সাগরের ঢেউ এই ঘরডাও গিইল্যা খাইবে। সাগরের পানির ধারে যাইতে আরও আড়াই মাইল হাঁটতে হইত। এহন সব শেষ। জীবনের তরুণ বয়সে একটি মাত্র বিল্ডিং দেখেছেন কুয়াকাটায়। সাইক্লোন শেল্টার। বর্তমানে এলজিইডির বাংলো। এহন তো শত শত। অভাব নেই। তয় সাগরের ভাঙ্গন ঠেহাইতে না পারলে সব আবার শ্যাষ অইয়া যাইবে।’ জেলে পেশায় জীবনের যৌবনকাল প্রায় শেষ করেছে আলমগীর ঘরামি। এখন আর পারেন না। সামর্থ্যকালও পার করে চলেছেন এসব কাজে। তাই ছেলেদের যে কোন মূল্যে মানুষ করার অনাবিল প্রয়াস এ মানুষটির। আর যেন সফলতার হাতছানিও তাঁকে ইশারা দিচ্ছে। দুই ছেলে বিএ পাশের পরে কোন চাকরি জুটে যাবে এমন দৃঢ় মনোবল আলমগীরের। তখনই জীবনের আরেক অধ্যায় শুরু করবেন এমন দৃঢ়বিশ^াস মানুষটিকে স্বপ্নিল করে রেখেছে। দুই বিঘা জমিতে রয়েছে একটি বাড়ি। ধানি জমি নেই। আলমগীর ঘরামির চোখে মূল উন্নয়ন হচ্ছে মানুষের শ্রম মজুরি বেড়েছে। বললেন- যৌবনকালে, (অর্থাৎ আশির দশকেও) একজনের কামাই (আয়) দিয়া একজনে খাওয়া যাইত না। আর এহন একজনের কামাইতে একটা সংসার চলে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে এমনটি হয়েছে বলে এ মানুষটির স্পষ্ট মন্তব্য। শরীর সায় দেয় না। তাই সাগরে যাওয়া বাদ দিয়ে ছেঁড়া জাল সেলাই করেন। তার পরও নিজের জীবন, সংসার, সন্তান, দেশের উন্নয়ন- সব ভাবেন। নিজের মতো করে। স্বকীয়তা রয়েছে তামাটে বর্ণের এই আলমগীর ঘরামির। এক কথায় বললেন, ‘কুয়াকাটার যতই উন্নয়ন ঘটান কামে লাগবে না। আগে সাগর ঠেহায়ন। সাগর যে রহম ভাঙছে কোন কিছু থাকবে না।’ ছেলেদের কেন নিজের পেশায় আনেননি। এক কথায়, নিজের ভাল পাগলেও বোঝে। লেখাপড়া অইল নিজের উন্নয়ন। কাউরে ভাগ দেয়া লাগে না। অগো যেডু শেখানো অইছে এহন অরা কামাই কইর‌্যা খাইতে পারবে। সবশেষ এ মানুষটি হতাশার সুরে জানালেন, ‘ছেলেদের উচ্চ শিক্ষার দৌড়ে টিকে থাকতে পারবেন কী? কারণ জমি পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছে। তার দাবি চারটি ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করতে সরকার কিংবা কোন হৃদয়বান মানুষের সহায়তা প্রয়োজন। মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া থেকে
×