ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুমাইয়া ইসলাম নিপা

শিল্পকলা ॥ বাংলার ট্যাপেস্ট্রি রূপকার

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

শিল্পকলা ॥ বাংলার ট্যাপেস্ট্রি রূপকার

বাংলাদেশের আধুনিক শিল্প জগতে অনন্য নাম শিল্পী রশিদ চৌধুরী। যিনি প্রচলিত মাধ্যমের প্রতিবন্ধকতাকে মুক্ত রেখে দেশের নিসর্গ ও মানুষ ঐতিহ্য-পরম্পরা তুলে এনেছেন দেশীয় মাধ্যমে ট্যাপেস্ট্রির বুননে। পাট, পশম, রেশম ও সুতা ব্যবহারে নির্মিত ট্যাপেস্ট্রি কর্মে লোকজ সরার সাদৃশ্য নক্সার নৈপুণ্য এবং বিচিত্র বিমূর্ততার সন্ধি সাধনে যে অক্ষয়কীর্তি গড়েছেন তা সত্যিই শ্রদ্ধাভরে স্মরণীয়।পদ্মার ভাঙ্গা গড়া এবং মন্দিরের দেবদেবী সঙ্গে ভাঙ্গা মন্দির সমেত আশপাশে এলোমেলো বৃক্ষাদি দেখেই শিল্পীর বেড়ে ওঠা যা তার স্মৃতিতে পক্তভাবে গাঁথা হয়েছিল আমৃত্যু। তাইত তার কাজে প্রতিয়মান হয় বাংলার মিথ, বাংলার লোকসংস্কৃতি এবং কাল্পনিক উপলব্ধির প্রতি অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ। মূলত কোন ধর্মকে নয়,আমাদের ঐতিহ্যকেই বুনেছেন পুরনো দিনের সোনালী ফ্রেমে বর্ণিল সুতার বয়নে। রোমান্টিক জীবনমুখী শিল্পী রশিদ চৌধুরী নানা জটিলতার মধ্যেও জীবনবিমুখ হননি কখনও বরং চলমান জীবনের উচ্ছ্বসিত অনুভূতিতেই রাধাকৃষ্ণ, দুর্গা, কালী, হাতি, ঘোড়া,পাখি,কলাগাছ,বটবৃক্ষ, বাংলার মিথে পুঁথিতে লোক কাহিনীর বিষয়বস্তুর অবয়ব নির্মাণে ঝুঁকেছিলেন আজীবন। তবে শিল্পীর যাত্রা ছিল অবয়ব থেকে অবয়বহীন পথে যেথায় তার রূপের ভেতর দিয়েই অরূপের সন্ধিৎসুক চোখ বিচরণ করেছে সূক্ষ্ম গতিতে ধর্ম নিরপেক্ষ বোধকে লালন করেই সংস্কৃতির অঙ্গসমূহ তুলে ধরেছেন কখনও দেবী অপার শক্তিরূপে কখনও বা বিমূর্ত জ্যামিতিক নক্সায়নে। পরিশীলন ও সম্মিলন সাধনে লৌকিক পুতুল প্রতিমা ঐতিহ্য গাথা মিথের অবয়ব এক দ্বিমাত্রিক বিমূর্ত গড়ন ও আলোছায়ার দ্বান্দ্বিক বিন্যাসে গড়ে তোলে পূণর্তা ও সামগ্রিক ঐকতান তারই সূক্ষ্ম অনুভব পাই শিল্পীর সকল সৃষ্টকর্মে। বিবিধ প্রভাব প্রেরণা অভিঘাত অভিজ্ঞতাকে জারিত করে ক্রমশ সুস্পষ্ট নিজস্বতায় উপনীত হয়েছেন একাগ্র অভিনিবেশ, আঙ্গিক, কুশলতা ও চৈতন্যবোধের সমন্বয়ে। যেখানেই নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন তেমন একটি ক্ষুদ্র বিষয়কে চমৎকৃত জাদু জড়িত আকারে, যুক্তিহীন বিশ্বাসে স্বপ্নের আদলের সঙ্গে আবেগজড়িত রঙে নিজস্ব ঢ়ংয়ে তুলে এনেছেন পটে। জীবনের গভীর রহস্যের মূলে তীব্র ছোঁয়ায় অনুভূতিগুলোর ব্যাপ্তি ছড়িয়ে দিয়েছেন তার শিল্পকর্মে। দুর্বার রোমান্টিক গভীরানুভূতি স্বপ্নময়তা ও তীক্ষ্ম কল্পনাশক্তির দ্বারা স্মৃতি সংযোগে অনুপ্রবেশ ঘটেছে লোকসংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বাংলা লোক চেতনায়। আর সেই চেতনার আদিরূপ অবচেতন মনে বহমান জীবনের অনুষঙ্গকে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন হিসেবে প্রতীকী রূপে প্রকাশ ঘটিয়েছেন এই বাঙালীর দৃশ্যমান বিশ্বাসগুলোর। শিল্পী তার শিল্পের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন স্বদেশ ঐতিহ্যের দ্বারা নিজ বোধকে প্রতিস্থাপন এর প্রয়াসে। তবে এতে আধুনিকতার পরশ বুলিয়েছেন স্বকীয়তা ও দেশীয় মানসিকতার যোগ সাধন করে। প্রকৃতি থেকে উৎসারিত প্রেম তাকে চঞ্চলতার বেষ্টনীতে ঘিরে রেখেছিল। প্রকৃতির ও মানবের উৎপত্তির মূলকে একত্রিত করেছেন। আলো অন্ধকারের রহস্যময়তার মধ্যদিয়ে নক্সা জাল বিছিয়ে অনুভবের স্বপ্নিল বোধকে, বাস্তব বোধে পৌছে দিতে চেষ্টা করেছেন। শৈশবের স্মৃতি তার চৈতন্যে এক গভীর প্রণোদনা হিসেবে নস্টালজিক মনেবৃত্তি থেকে শিল্প সৃষ্টির উৎসরণে উদ্বুদ্ধ দান করেছে। কৃষি সামন্ত ঐতিহ্যের আনাগোনা সঙ্গে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি বিশেষ করে রাধাকৃষ্ণ ও দুর্গা মূর্তি, ঢোলবাদন, লাঠিখেলা, মহররমের মিছিল,যাত্রা,পালাগান পুঁথিপাঠ,কথকতা পাঁচালি ইত্যাদির আয়োজন দেখা যায় তার চিত্রে। পটের ছবি লক্ষ্মীর সরা আলপনা চিত্রিত কাঁথা,শখের হাঁড়ি,মাটির পুতুল ও খেলনার গড়ন তার মধ্যে আকর্ষণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। তাইত মূল বিষয়কে কেন্দ্র করে আনুষঙ্গিক বিষয় ক্রমশ ছড়িয়ে পরার রীতি লক্ষণীয় শিল্পকর্মে যা সরাচিত্রের সদৃশ। এই লোকচিত্রের উপস্থাপন নিজস্ব ভাবনায় এবং কম্পোজিশন পাশ্চাত্য প্রভাবে রচিত। যে সৃষ্টির উপরিভাগ খিলানের আকারে এবং নিম্নাংশ একটি আলাদা ক্ষেত্রের ওপর উপস্থাপিত যা দেখতে বেদীর ওপর দ-ায়মান বিষয় বলে মনে হয়। অপ্রত্যক্ষ রূপকাশ্রিত রূপান্তরিত লোকজীবনের গল্পগাথা স্মৃতি ও স্বপ্নের জগৎ বিমূর্তায়িত করেছেন ফলে তার নির্যাসটুকুই অনুভূত ও প্রত্যক্ষ। কাজে সময়ের ধারণাকে অদৃশ্য রেখে স্মৃতির সঙ্গে বর্তমান এবং বর্তমানের মধ্যে স্মৃতিকে একীভূত করে প্রাকৃতিক প্রেমময় ও দেশজ বিষয় আর উপাদানকে প্রবিষ্ট করেছেন ঘন গাঢ় রঙের ভিত বা বেজের ওপর স্থাপিত করে। বর্ণ বা আলোক ছটা ছবির প্রাণ, যে প্রাণ সঞ্চারনে কালো বা গাঢ় রঙের পটভূমির বিপরীতে উজ্জ্বল প্রাথমিক লাল, নীল, হলুদ, সবুজসহ বিভিন্ন বর্ণের বিরোধাভাস এর সুর রচনা করেছেন গতিময়তা বিমৃতায়িত ও ছন্দোবদ্ধ রূপবন্ধে। উলম্ব ও আনুভূমিক রেখা ও আকারের বিপরীতে তার পক্ষপাত কৌণিকতার সৃষ্টি টানাপোড়নের দিকে। এগুলোর মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয় ফোটাফুটকি আঁচড় স্ট্রোক প্রভৃতি সংযোগে জোড়ালো স্থিতি ও টান টান অস্থিরতার বিপরীতে যে চাপ তা দর্শকের দৃষ্টিকে টেনে রাখে শিল্পীর শিল্পতে। সমসাময়িকদের থেকে ভিন্নতর শৈল্পিক উদ্দেশ্যে ও জীবনাচার অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। শিল্পী রশিদ চৌধুরী তেলরং, টেম্পেরা, জলরং, গোয়াশ, পোড়ামাটিতে ভাস্কর্য এবং ছাপাই ছবির বিভিন্ন মাধ্যমে বহু কাজ করেছেন তবে ট্যাপেস্ট্রিতে তিনি স্বকীয় মাধ্যম ও শৈলীর স্বাতন্ত্র এষণা খুঁজে পেয়েছিলেন। তাইত কারুশিল্প সংগঠন, ট্যাপেস্ট্রি কারখানা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করেন উদ্যোগী সাংগঠনিক মনেবৃত্তি সম্পন্ন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা এই শিল্পী রশিদ চৌধুরী। শিল্পে শিক্ষাগ্রহণ যেন কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পারে বাউহাউস ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত শিল্পীর হৃদয়জুড়ে চিন্তা জগতের ঢেউ তুলেছে সদাসর্বদা।এবং দৃষ্টিগ্রাহ্য বিষয়কে ক্রমশ অস্পষ্ট অচেনা আকার দ্বারা যা বিমূর্ত নয়, আবার পুরোপুরি মূর্ত বললেও ভুল হয় এমন অধরাকে ধরার প্রয়াস পরিলক্ষিত হয় তার সৃষ্টিতে।
×