ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নিষিদ্ধ লোবান ॥ কয়েকটি খণ্ডিত বিশ্লেষণ

প্রকাশিত: ০৬:৫৪, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

নিষিদ্ধ লোবান ॥ কয়েকটি খণ্ডিত বিশ্লেষণ

সৈয়দ হক ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে গভীর ও নিবিড়ভাবে ধারণ করা একজন মানুষ। তার অসংখ্য লেখায় মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করা হয়েছে। এটি যেমন কবিতায় এসেছে, তেমনি গল্পে ও এসেছে উপন্যাসে। অধিকাংশ লেখকের মতো সৈয়দ হক একাত্তরের নয় মাসকে গড়পড়তা তুলে ধরেননি। ঘটনার মধ্যে যে ঘটনা থাকে, করুণের ভেতরে যে করুণতর অবস্থা থাকে সৈয়দ হক তার দৃষ্টি সেদিকে নিবদ্ধ করেছেন। ফলত, তার লেখাগুলো হয়ে উঠেছে বিশেষ ও অনবদ্য। আলোচ্য লেখায় আমি কেবল মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে লেখা ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাসের দিকে দৃষ্টি দিতে চাই এবং খ- খ- কিছু অভিমত ও প্রতিক্রিয়া জানাতে চাই। পাঠককে সেই লক্ষ্যেই এই লেখার শব্দসম্ভারে আমন্ত্রণ জানাই। দুই. উনিশ শ’ একাত্তর শব্দবন্ধে প্রথমে মনে আসে বাঙালীদের ত্যাগ, তিতিক্ষা ও গৌরবের কথা। আসে হানাদারদের নির্মমতা ও নৃশংসতার কথা। স্বাধীনতার প্রশ্নে নারী-পুরুষ সবাই যার যার অবস্থান থেকে লড়ে গেছে, জীবন দিয়েছে, স্বীকার করেছে অশেষ ত্যাগ। ‘নিষিদ্ধ লোবান’ এক নারীর আবর্তনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে দেখা। নারীটির নাম ‘বিলকিস’। বিলকিসের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে এ উপন্যাসে পাঠক পরিশ্রান্ত হয় না। বরং উপলব্ধি করে একাত্তরকে। সাধারণ মানুষের অকাতরে দেশের প্রতি ভালবাসা এবং হানাদারদের প্রতি চরম ঘৃণাও সমানভাবে উপলব্ধি হয়। বিলকিস তার গ্রাম জলেশ্বরীতে যাবে। জলেশ্বরীতে যুদ্ধের থমথমে অবস্থার মধ্য দিয়েও পৌঁছে সে। তার সঙ্গী কিশোর যোদ্ধা প্রবীর। এরপর উপন্যাসের কাহিনী চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সমাপ্তিতে এসেছে। এখানে সৈয়দ হকের মনস্তত্ত্ব নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে আমরা উপন্যাসে প্রধান দুটি চরিত্র পাই। এক. বিলকিস। দুই. প্রবীর। বিলকিস নারী। অন্যদিকে প্রবীর কিশোর। সে হিন্দু। দুটি কোমল চরিত্রকে সৈয়দ হক সচেতনভাবেই এ উপন্যাসে স্থান দিয়েছেন। তাদের দৃষ্টিতে দেখেছেন তৎকালীন মানুষের অনুভূতিগুলোকে। ‘নিষিদ্ধ লোবান’-এর চরিত্র দুটি টগবগে দু ’জন যুবকও হতে পারত। কিন্তু হয়নি। কারণ, তাহলে যুদ্ধের যে নির্মমতা, যুদ্ধে নারী ও কিশোরদের যে অংশগ্রহণ তা কি এই উপন্যাসে এতটা অর্থবহভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হতো? এই প্রশ্নের উত্তরÑঅর্থবহ হতো না। চরিত্র নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রথম ‘নিষিদ্ধ লোবান’ ভিন্নতার পথে পা রাখল। তিন. জলেশ্বরী সব্যসাচীর কল্পিত গ্রাম। যদিও তার জন্মস্থান কুড়িগ্রামের প্রতিস্থাপনের চেষ্টা আছে জলেশ্বরীতে। আর একথা সৈয়দ হকও বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন। জলেশ্বরীতে এখন যুদ্ধকাল। বিলকিস জলেশ্বরীতে যাবে। কিন্তু সে ট্রেন থেকে আগের স্টেশন নবগ্রামে নেমে দেখে চারদিকে থমথমে ভাব। লেখক তখনকার থমথমে ভাবকে যথার্থভাবেই তুলে ধরতে পেরেছেন। উপন্যাসের প্রেক্ষাপটের বিবেচনায় পরিবেশে যে গাম্ভীর্য বিদ্যমান থাকার কথাÑতাই বিদ্যমান ছিল। আমরা দেখি বিলকিসের গ্রামে যাবার বর্ণনা দেন লেখক এভাবে : ‘বাঁকটা পেরিয়ে যায় সে। পেছনের ইস্টিশান আর চোখে পড়ে না। এবার সমুখে দেখা গুমটি ঘর। আর অনেক দূর পর্যন্ত ফসলের খোলা মাঠ। রেললাইনটাও দৃষ্টির শেষ সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত। হঠাৎ করে সে যেন একটা অনন্তের মধ্যে পড়ে। মুহূর্তের জন্যে অবসন্ন বোধ করে।’ জলেশ্বরীতে বিলকিসের পরিবার থাকে। পরিবারের জন্য চিন্তাগ্রস্ত বিলকিস জলেশ্বরীতে যাবেই। এমন থমথমে পরিবেশের মধ্যে, অনন্তের মধ্যে পড়েও সে হেঁটে যায় গ্রামের দিকে। পথিমধ্যে তার সঙ্গী হয় সিরাজ নামধারী কিশোর প্রবীর। প্রবীরকে নিয়ে বিলকিস গ্রামে পৌঁছে। উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত প্রবীর বিলকিসের সঙ্গী ছিল। লড়াইটাও তারা একসঙ্গে করে। প্রবীরের মুখেই বিলকিস শোনে হানাদারদের নির্মমতার কথা। তার আপন ভাইয়ের মৃত্যুর কথা। কিশোর ছেলেটি এ উপন্যাসের অর্ধেক আলো ধরে রেখেছে। লেখক এই কিশোরের মুখ দিয়েই যাবতীয় নির্মমতা ও নৃশংসতার কথা পাঠকদের বলেছেন। কিশোর ছেলেটিকে যুদ্ধই অনিবার্যভাবে পৌঢ়ত্ব এনে দিয়েছে। রাবেয়া খাতুন, সেলিনা হোসেন প্রমুখদের লেখাতেও এমন চরিত্রের সরব উপস্থিতি আমরা পাই। চার. হানাদারদের যে নির্মমতা তা লেখায় উপস্থাপন করা কঠিন। লেখকরা সেই কঠিন কাজটিই করার চেষ্টা করেন। সৈয়দ হক আলোচ্য উপন্যাসে ছোট ছোট ঘটনা বর্ণনার মাধ্যমে পাকিস্তানীদের নির্মমতার কথা তুলে ধরেছেন। উপন্যাসের পার্শ¦ চরিত্র জাঁদরেল মোক্তার আলেফ মাস্টার। তার প্রতি বিহারী ও হানাদারদের নির্মমতা : ‘একদল (বিহারীরা) এসে দেখা পায় মোক্তার সাহেবের। তারপর অন্ধ দেখে বদমাশগুলোর ফুর্তি হয়। আলেফ মোক্তারের গলায় জুতার মালা দিয়ে, বুকের ওপর জয়বাংলা নিশান লাগিয়ে, কোমরে গরু বাঁধার দড়ি বেঁধে সারা শহর তাকে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ায়। অন্ধ মানুষ, হাঁটতে পারে না, বারবার পড়ে যায়, বাঁশ দিয়ে খুঁচিয়ে তাকে খাড়া করে, লাথি মারে, টেনে নিয়ে বেড়ায়। তারপর ফিরিয়ে এনে একা বাড়িতে রেখে যায়। ...মজা করার জন্যে বাঁচিয়ে রেখেছে।’ শুধু আলেফ মোক্তারকে নিয়ে নির্মমতা নয়, সাধারণ মানুষদের হত্যা করে তাদের লাশ নিয়েও চলে নির্মমতা, বীভৎস্য উৎসব। নির্মমতা স্বীকার আলেফ মোক্তারের মুখ থেকেই শুনতে পাই বিলকিসের ভাই খোকার লাশসহ অন্য মানুষের লাশ নিয়ে পাকিস্তানীরা কী করেছে। আলেফ মোক্তার বলছেনÑ‘এত বড় পাষাণ, মানুষের অন্তঃকরণ নেই, হুকুম দিয়েছে, লাশ যেখানে আছে সেখানে থাকবে। কেউ হাত দিতে পারবে না। কচি ছেলেগুলোকে কাক শকুনে ছিঁড়ে খাবে, দাফন হবে না।’ পাঁচ. যুদ্ধের বীভৎসতা এতটা গভীর ছিল, বাঙালীরা শোক প্রকাশ করতেও ভুলে গিয়েছিল। শোককে তারা পরিণত করেছে শক্তিতে। অন্তরে প্রিয়জন হারানোর বেদনা রেখে তারা পুষে রেখেছিল প্রতিশোধের আগুন, শত্রুর প্রতি প্রবল ঘৃণা। বিলকিসকে দেখি এমনই প্রতিক্রিয়া দেখাতে। ভাইয়ের মৃত্যু ও লাশ দাফন না হওয়ার সংবাদ শুনে বিলকিস লাশ দাফন করতে চায়। হানাদারদের আদেশ ও ভয় তার মনে স্থান পায় না : ‘ খোকাকে গুলি করে মেরেছে, খোকার লাশ পড়ে আছে, খোকার লাশ কেউ ছুঁতে পারবে না, কই আমার চোখে তো পানি আসছে না, পানি এল না। ছ’ মাস আগেও কেউ যদি খোকার মৃত্যু সংবাদ আমাকে দিত, পৃথিবীটা চৌচির হয়ে যেত না? এখন তো আমি ঠিক পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। খোকাকে কবর দেয়ার কথা ভাবছি। কেউ ভীত নয় সিরাজ। কেউ ভেঙ্গে পড়ে না, শোক কখনও এত বড় নয় যে, মানুষ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না।’ তার এই উক্তি আমাদের সফোক্লিসের ‘আন্তিগোনে’ নাটকের আন্তিগোনে চরিত্রটির কথা মনে করিয়ে দেয়। আন্তিগোনেও চায় রাজার আদেশ অমান্য করে তার ভাই পলেনেসিসের মৃতদেহ সৎকার করতে। আমাদের মনে রাখতে হবে, উপন্যাসে বিলকিস এখানে একটি প্রতিকী মাত্র। একাত্তরের সম্মিলিত অভিব্যক্তিই বিলকিসের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন লেখক। ছয়. বিলকিস ও প্রবীর হানাদারদের ভয়ের তোয়াক্কা না করেই বাজারে পড়ে থাকা লাশগুলোর কবর দিতে গিয়েছিলো। প্রথম রাতে কয়েকজনকে তারা কবর দিলেও সবাইকে কবরস্থ করতে পারে না। পরের রাতের জন্যেও তারা অপেক্ষা করে। কারণ, বিলকিস জানায়, ‘সবাইকে কবর দিয়ে, তবে আমি যাবে।’ তারা বাজারের গুদামঘরের মধ্যে লুকিয়ে পরের রাতের জন্যে অপেক্ষা করে। কিন্তু পরের রাতেই তারা ধরা পড়ে হানাদারদের হাতে। তাদের স্থান হয় পাকিদের ক্যাম্পে। উপন্যাসের শেষের দিকে মেজর চরিত্রটির সন্ধান আমরা পাই। যে কিনা বাঙালীদের বলে, ‘কুকুরের কখনো কবর হয় না।’ অসমর্থ হলেও সে নারীলিপ্সু ও বিকৃতমনা। সিরাজ নামধারী প্রবীরকে মেজর বলে, ‘বোনের সঙ্গে শুতে জান?’ এতটুকু বলেই ক্ষ্যান্ত হয় না। তার নির্দেশে এক পর্যায়ে বিবস্ত্র বিলকিসের সামনে উলঙ্গ প্রবীরকে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। মেজর বলে, ‘বাঙালীরা কুকুরের অধিক নয়। কুকুরের ভাইবোন নেই।’ এক পর্যায়ে সিরাজ হানাদারদের হাতে প্রাণ দেয়। বিলকিস সেই মুহূর্তেও মেজরকে দৃঢ় কণ্ঠে জানায়, ‘আমার ভাইয়ের সৎকার আমি করব।’ মেজর বিলকিসকে জয় করার লোভে, তাকে পাবার লোভে প্রবীরকে নদীর তীরে সৎকার করতে রাজি হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রবীরের চিতাতেই মেজরকে ভষ্ম করে বিলকিস, নিজেও ভষ্ম হয়। লেখক উপন্যাসটি শেষ করেছেন এভাবেÑ‘ঠিক তখনই বিলকিস তাকে (মেজরকে) আলিঙ্গন করে। সে আলিঙ্গনে বিস্মিত হয়ে যায় মেজর। পর মুহূর্তেই বিস্ফারিত দুই চোখে সে আবিষ্কার করে, রমণী তাকে চিতার ওপর ঠেসে ধরেছে, রমণীর চুল ও পোশাকে আগুন ধরে যাচ্ছে, তার নিজের পিঠ বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। রমণীকে সে ঠেলে ফেলে দিয়ে লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে পারত। কিন্তু রমণীকে আগুন দিয়ে নির্মিত বলে এখন তার মনে হয়। ...মশালের মতো প্রজ্বলিত সমস্ত শরীর দিয়ে তাকে ঠেসে ধরে রাখে বিলকিস।’ বিলকিসের প্রতিশোধের মধ্য দিয়ে এ উপন্যাস শেষ হয়। সাত. ‘নিষিদ্ধ লোবান’ চলচ্চিত্র হয়েছে। অসাম্প্রদায়িক চেতনা এ উপন্যাসের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। এ দেশটা আমাদের, সব ধর্মের মানুষের। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও আমাদের সব ধর্মের মানুষই হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। ত্যাগ স্বীকার করেছে। নারীরাও এগিয়ে এসেছিল। নারী ও কিশোরের চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধের বয়ান ‘নিষিদ্ধ লোবান’। বইটির উপস্থাপনে কখনো কখনো কাব্যিকতার ছোঁয়া আমরা পাই। সবশ্রেণীর পাঠকদের জন্যে ‘খেলারাম খেলে যা’ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ১৯৭৯ সালে লিখিত ‘নিষিদ্ধ লোবান’ও অবশ্য পাঠ্য।
×