ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

গল্প ॥ খোয়াড়

প্রকাশিত: ০৬:৫৪, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

গল্প ॥ খোয়াড়

যমরাজ এবার তার সহস্র হাত প্রসারিত করে এগিয়ে যায়। অদ্ভুত ভঙ্গিমাতে অপ্সরীর শরীরী বাঁক স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকলে দেবরাজ ইন্দ্রের আঘাতে তা আরও স্পষ্টতর হয় এবং হাতের নৃত্য চলে সারাশরীরে। মাথার ওপর টিনের চালায় ঝমঝমিয়ে ওঠা বৃষ্টি অন্য কাউকে ভেজায় কিনা জানা যায় না, তবে নন্দ দুলালের পরনের হাঁটু অবধি ওঠা কটকেটা ভিজিয়ে দেয়। পায়ের ধাক্কায় গড়িয়ে পড়া জলের পাত্র ধরতে যাওয়ার বিড়ম্বনায় মাটির তৈরি পাত্রটা ভেঙ্গে মানুষের মতো কয়েক টুকরো হয়ে যায়। শরীরী বাঁক চলে কিংবা চলে না অথবা পশ্চিমা নৃত্যে কারও কাপড় ভেজে কি ভেজে না, তবে, উঠতি বয়সী নাবালকের অথবা কিশোর যুবার চোখ হাত অনবরত স্থানচ্যুত হয় এবং তা এক সময় আদালতের সীমানা পেরিয়ে উচ্চ আদালতে কারও বা জায়গা করে নেয়ার মতো অবস্থা হয়। খ- টুকরো পড়ে থাকা মাংসে কার নাম লেখা থাকে জানা যায় না, তবে কুকুর শকুনের খাদ্যের ইদানীং তেমন আর অভাব হয় না। শকুনেরা লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নেয় গরুর ভাগাড়ে আমাদের স্বজাতির মৃতদেহ দেখে। বাতাসে ধান-পোড়া গন্ধে এখন আমোদ জাগে না শিশুর। অল্প পয়সায় কেনা কনডমের আমেজে এখন আর আমেজ খোঁজে না, সিনেমা হলে না গিয়ে পর্নো ছবিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলে- গোয়ালন্দ ঘাটের ছোট খুপরিতে অথবা ভিন্ন আ-লয়ে গমনে বাধা দেয়ার মানসিকতা না থাকলে পুলিশ পিতার ভুঁড়ি আকাশের দিকে উঠতে থাকে। বাড়ির কাজের মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা হলে তাকে ফেলে দেয়া হয় ছাদ থেকে কিংবা ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে...। অতপর সংবাদ শিরোনাম ‘কাজের মেয়ের আত্মহত্যা’। এই শীতে নয়, অন্য শীতে। কটকেতে পায়ের হাঁটু অবধি ঢাকে না। এ যেন বোম্বে নায়িকার মিছেমিছি স্বল্প বসন টেনে শরীর ঢাকার ব্যবস্থা, তপ্ত বালুতে খই ফোটার আনন্দে নেচে ওঠে যেন ধান পুড়ে যাওয়া কষ্ট নয়। ভূমিষ্ঠ হওয়ার গৌরবে গর্বিত ওরা। ক্ষীণ আশা মনে জাগলে পরবর্তী বছরে শীতে কাপড় কেনার আশায় শিয়ালের কাঁথা কেনার গল্প মনে হয় এবং তা অট্টহাসিতে রূপান্তরিত হয়। পবনের বাপ চান করব্যের যাও- শব্দে স্বপ্নচ্ছেদ ঘটে তার। মালশার আগুনের আশায় বসে থাকলে পুনরায় গালির অংশ বিশেষ শোনা যায়। মেঘেরা উদাসভাবে উড়ে গেলে মনটা উড়–উড়– করে। মেঘের সঙ্গে নদীর সাদৃশ্য খুঁজে পেলে স্বপ্ন গভীর হয় আরও বেশি। নদী ভাঙ্গে চারদিক নিয়ে। ভাঙ্গে বড় ঘর। পুবের ঘর। দক্ষিণ ঘর। গোয়াল ঘর। গোরাজ নামের বিশাল লেজের গরুটা নদী ভাঙ্গার উথাল-পাথাল ঢেউকে বুকের নিচে নিয়ে সেদিন রক্ষা না করলে আজ এ ৬৫ পেরোনো কিছুতেই হয়ে উঠত না। নারী কণ্ঠের চিৎকারে পুনরায় স্বপ্ন ভঙ্গ হলে মাগীর মিয়্যা বলে গালটা মুখগহ্বরেই ধাক্কা খায়। নারী কণ্ঠ উচ্চতর হতে থাকে- ‘পবনের বাপ ধান কলে দিয়ে আসপা না? প্যাটে আজ আর ভাত পড়িবেনানে।’ ঢেঁকিতে চাল ভানা আর কলে ভানা কত তফাৎ- পান্তা ভাতের থালে মা যদি মরিচ দিত, তয় সামলায়ে পিঁয়াজ দিয়ে খেতে কত স্বাদ লাগত। আজও জিভেয় জল আসে। ‘ফুটানি করে‌্য বাবু ম্যারে বসে রইচো? যাও। এই ন্যাও আগুন তামুকটা খায়্যা যাও কচ্চি।’ পবনের মায়ের কণ্ঠ পুনরায় শোনা যায়। মালশার আগুন কলকিতে ভরে নিয়ে হুকোয় টান দেয় আর লাটি খেলার দৌলতে পাওয়া গেঞ্জিটা পরে নেয়। হাত বুলিয়ে চোখটা জলে ভরে যায়। একদিনে গায়ের জোরে লাঠি খেলাতে কেউ হারাতে পারত না। দবির মোল্লা কতবার ডেকে নিয়ে গেছে। এখন আর লাঠি খেলার বয়স নেই। তবুও ডাক পড়ে; সম্মানে গেঞ্জিও পায়। কষ্ট হয়। ধানের বস্তাটা এই বয়সে মাথায় নেয়া কষ্টের তবুও পবনের মা ধরাধরি করে তুলে দেয়। সরু রাস্তার দুধারে সবুজ ধানের চারা দোল খায় বাতাসের স্পন্দনে। চারা গজিয়ে জোয়ান হয়- ফল ধরে, পাকে, ঝরে পড়ে। ধান ক্ষেতের পাড়ে শুকিয়ে যাওয়া কাদা মাটি এবড়ো-খেবড়োভাবে মাটিতে বিছানা বিছিয়েছে। সে মাটি পায়ের নিচে সামান্য কষ্ট দেয় বটে কিন্তু এক ধরনের সুড়সুড়ি সুখ অনুভূত হয়। ফাটার আড়ালে লুকানো কীট মাথা চাড়া দেয়। পবন থাকে শহরে। আগে টাকা পাঠাত এখন শহরে জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় টাকা দিতে পারবে না বলে চিঠি আসে। আর এক ছেলে রবি বাড়িতেই থাকে। আলাদা খায়। মেয়ে দুটো পরের ঘরে। ছোট মেয়ে শ্যামলী...! বুকে কষ্ট বাড়লে লাঙ্গলের ফালে মাটি ভেদ করে যায়। দুমুখো সাপে পেঁচিয়ে ধরে পা। গরু“ পেটানো বাঁশের লাঠিটা সজোরে পেঁচানো পায়ের মধ্যে চালান করে দেয়Ñ তাতেই ছিটকে দশ বারো হাত দূরে চিৎ হয়ে পড়ে ফুঁসে ওঠে মিশন ব্যর্থের ব্যর্থতায়। তারপর দৌড়ে গিয়ে লাঙ্গলের ফাল দিয়ে গেথে দেয় সাপটার বুক বরাবর। মনে পড়ে যুদ্ধের বছর। ভাবনায় অদ্ভুত ঢেউ তোলে। পুলকিত হয় দেহমন। গরুর খাবার কিছু নেই। খেড় পাওয়া যায় না। কুশোরের পাতা, ঘাস সে তো অমূল্য। নিজেদের খাওয়ার কষ্ট। গরুর খাওয়ার জন্য ছাল-খোল কেনার টাকা জোটে না। গরুর চেহারার মতো চেহারা তার। পিঁয়াজ খেতের দিকে চোখ গেলে নিজের অজান্তেই ধানের বস্তা নামিয়ে কয়েকটা পিঁয়াজ কোমরে জড়ানো গামছাতে বেঁধে নেয়। আশপাশে একবার চোখ ঘুরিয়ে হাঁটতে থাকে আপন গতিতে। পরের জিনিস চুরি করার দায়ে বউয়ের গালিতে উত্তর খোঁজে। অবশেষে জবাব মেলে। তার খেতের জিনিস অন্যজন নিয়ে যায়। সেও নিয়ে আসছে। বউয়ের গলা চড়ায় উঠলে শোনা যায়- তুমি আর ছাওয়ালের মানসুম্মান কিছু রাহলে না। অত মানসুম্মানের কাম নাই। তোমার না থাকপার পারে, তোমার ছাওয়ালের আচে। তোমার ছাওয়ালত একটা টাহা দিয়েও পোচে না। ঐই রহম ছাওয়ালের সুম্মান দেহে আমার কাম নাই। আখাতে ডরলা ঠেলে দিয়ে চাটাইয়ে ধানগুলো নেড়ে ওদিকটায় গুড়ের ড্রাম এসে গেছে দেখে ঘরের তালা খুলে কোলার কাছে যায় নন্দর বউ। গরম গুড় ঢালার নাচনে মনটা খইয়ের মতো নেচে ওঠে। খোলায় এবার খই দেয়া হয়নি। ধান ছিল না। পবনের বাপ তাকিয়ে দেখে। কোন কথা না বলে পিছন দরজা দিয়ে হাঁটতে থাকে খোলার উদ্দেশ্যে। জলের অভাবে ধান-পোড়া গন্ধ ওঠে। দৌড়ে চলে যায় উঠানের আখার দিকে। বারান্দায় বসে আচো। ধান তো দেখপ্যার পারতে। ধান পুড়ে এহেবারে ধুমো ওঠচে- পবনের মা গলা চড়ায়। তখন খোলার বানের পাড়ে বসে গুড়ের জাল ধরে। এক হাতে হুকা টানতে টানতে গুড়ের টগবগানো দেখে পুরান রক্ত জাগায় না বটে তবে দোল দিয়ে যায়। কলকের আগুনের আলো আরো ঘনীভূত হয়ে পূর্ব ভূমিতে চাঁদ উঁকি দেয়। মালশার আগুন কলকেতে শোভা না পেয়ে কুড়ে ঘরের মালায় আর তীব্রভাবে জ্বলে ওঠে। আসন্ন মার চোখে আগুন জ্বলে তীব্রতর। রাতের আকাশে নবজাতকের চিৎকারে নন্দদুলালের ঘুম ভেঙ্গে যায়। বিরক্ত মুখে একচিলতে হাঁসির ঝিলিক খেলে যায়। শরীরটা কেমন যেন করে ওঠে। দম আঁটকে বুকের মধ্যে দলা পাকায়। মরা বাপ মা কোথা থেকে যেন ডাক দেয়। শ্যামলী বাবা বলে ডাকে। গ্রাম্য সালিশে পার পেয়ে যায় শ্যামলী ধর্ষকরা। চোখের সামনে শ্যামলীর শুধু ঝুলে থাকা পা দুটো ভেসে ওঠে। পবনের মা জল... অস্পষ্ট স্বর পবনের মার নাক ডাকার বাদ্যে কানে পৌঁছায় না। সেই পঁয়ষট্টি বছর আগে যেমন একা এসেছিল এই মাটিতে আজও তেমনি দেহটা নিঃশব্দে নিঃসাড় হয়ে যায়! পবনের মা টেরও পায় না। একই ঘরে একসঙ্গে এত বছর কাটানো মানুষটি তাকে বড় বেশি একা করে গেছে। ভোরের আলো দেরিতে স্পষ্ট হয় তীব্রতর শীতে। কাপড়ের দৈন্যয় পবনের মা ঘর থেকে বেরোনোর আগে ধাক্কা দেয় পবনের বাপকে... সারাবাড়িতে কান্নার রোল ওঠে। শুধু চুপ করে বসে থাকে পবনের মা।
×