ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাইফুজ্জামান

রতনতনু ঘোষ ॥ স্মৃতির পাতা থেকে

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রতনতনু ঘোষ ॥ স্মৃতির পাতা থেকে

রতনতনু ঘোষ প্রাবন্ধিক, গবেষক, কবি। তাঁর মৃত্যুর পর এক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু মনে হয় কিছুক্ষণ আগেও তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ শেষে আমার অফিসে এসে বসবেন, নতুন লেখা পাঠ করে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইবেন। বাস্তব বড় সত্য, তিনি নেই এ সত্য আস্থা রাখতে হবে। তাকে নিয়ে লিখতে গেলে স্মৃতির পাতা ফুড়ে কত কিছুই না ভেসে আসে। রতনতনু ঘোষের সঙ্গে প্রথম পরিচয় দৈনিক ‘আজকের কাগজ’ পত্রিকা অফিসে ঝিগাতলায়। উপ-সম্পাদকীয় পাতায় ও সাহিত্য পাতায় আমরা নিয়মিত লিখেছি। সাহিত্য আড্ডায়ও অংশ নিচ্ছি। তিনি প্রবন্ধ লিখছেন। আমরা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি। ঢাকা শহরের দৈনিক পত্রিকা অফিস ঘিরে আমাদের আড্ডা দীর্ঘায়িত হয়েছে। অনেকেই চলে গেছেন প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে। এর সঙ্গে যুক্ত হলো রতনতনু ঘোষের নাম। বই মেলা আসলে কী তার উৎসাহ! অত্যন্ত ১০/১২টা বই প্রকাশ ও সম্পাদনা ছাড়া তার দিনরাত অর্থহীন মনে হয়। প্রতিদিন বই মেলায় তার উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। নিজের বই-এর কথা বইমেলার অন্য লেখকদেও শ্রেষ্ঠ বই-এর কথা তার আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত থাকত। রেফারেন্স গ্রন্থ ব্যবহারের সময় আমরা তার কাছ থেকে জানতে চাইতাম রতনতনু ঘোষ রচিত প্রবন্ধগ্রন্থ : (১) বাংলাদেশের রাজনীতি : প্রত্যাশা ও বাস্তবতা (২) আলোকিত বাংলাদেশের পথ (৩) বাংলাদেশে সংখ্যালঘু (৪) অপারেজয় বাংলাদেশ (৫) অগ্রসর বাংলাদেশ (৬) ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা (৭) বাংলাদেশের রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি (৮) বাংলাদেশের সাহিত্য। কাব্যগ্রন্থ : রতনতনু ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতা ও রতনতনু ঘোষের নির্বাচিত কবিতা। রতনতনু ঘোষ মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ছিলেন অটল। গণতান্ত্রিক যাত্রাপথে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। কিন্তু, দলীয় পুরস্কার ও সম্মাননার জন্য তিনি কাঙাল ছিলেন না। রতনতনু ঘোষের জন্ম : ৩১ ডিসেম্বর ১৯৬৪, মুন্সীগঞ্জ। মাধ্যমিক কে.কে উচ্চ বিদ্যালয় ১৯৮০, উচ্চ মাধ্যমিক হরগঙ্গা কলেজ (১৯৮২), ¯œাতক (সম্মান) সমাজ কল্যাণ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় (১৯৮৫), ¯œাতকোত্তর সমাজ কল্যাণ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় (১৯৯৬) রতনতনু ঘোষ প্রবন্ধের জন্যে গণগ্রন্থাগার (১৯৮৫) পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। বাংলা একাডেমীর তরুণ লেখত প্রকল্প পুরস্কার ও সম্মাননা ও তার জুটেছিল। বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্প থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ প্রকাশের পর তার গ্রন্থ নিয়মিত মননশীল প্রবন্ধ রচনায় রতনতনু ঘোষের প্রসিদ্ধি ছিল। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অমর্ত্যসেন, কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়সহ এদেশের জাতীয় ব্যক্তিত্বদের সাক্ষাৎকার গ্রহণে তিনি তার তেজদীপ্ত প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। এদেশের তরুণ ও বুদ্ধিজীবীরা তার সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছেন। তার তিনটি সাক্ষাতকার ধর্মী গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। লোক কমে যাচ্ছে যখন চারপাশে দেখছি পড়ার তখন মনে হচ্ছে রতনতনু ঘোষ পড়–য়া ও লেখক ছিলেন। তাৎক্ষণিক প্রবন্ধ রচনার ক্ষমতা ছিল বিস্ময়কর। মনের ভাব, নিঃসঙ্গতা ও প্রেম অবলম্বন করে তিনি রচনা করেছেন ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ও ‘নির্বাচিত কবিতা’। ঢাকার মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজে রতনতনু ঘোষ অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ছাত্র-ছাত্রী, স্বজন-প্রিয়জন ঘিরে মখুর থাকলেও তিনি একাকীত্ব অনুভব করতেন। এই একাকীত্ব থেকে তার কবিতা লেখার উপকরণ সংগ্রহ করতেন। অভিমান আর বাস্তব ঘাত-প্রতিঘাত, বঞ্চনা ও তার কবি চিত্তে আলোড়ন তুলেছে। কবিতা ও আত্মকথনে বাস্তবতার গল্প উঠে এসেছে। তিনি ছিলেন পরিশ্রমী লেখক ও পাঠক। তার অনুসন্ধান শেষ না হলে পাঠে বিরত হতেন না। রতনতনু ঘোষ সংগঠক ও পরোপকারী ছিলেন। সাহিত্য সংগঠকগুলোতে তার সম্পৃক্ততাও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তাকে অনায়াসে চিহ্নিত করে। অন্যের বিপদে এগিয়ে আসা তার ব্রতের মতো ছিল। লেখক বন্ধু ও সংগঠকদের পাশে বন্ধুর মতো থেকেছেন। দৈনিক যায় যায় দিন অফিসে একটি লেখা জমা দেয়ার জন্য ৩ অক্টোবর ২০১৬ তারিখ তিনি যান। লেখা জমা দিয়ে ফেরার পথে রতনতনু ঘোষ হৃদরোগে আক্রান্ত হন। শমরিতা হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন। শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য মৃত্যুর পর তার মরদেহ বাংলা একাডেমিতে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ জানান বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠান করা যাবে না। রতনতনু ঘোষ বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য ছিলেন। প্রতিবছর বাংলা একাডেমির পুরস্কার ঘোষণার সময় তিনি তরুণ লেখকের পুরস্কার পাচ্ছেন কিনা আলোচনায় মুখর থাকতেন। তাকে কোন প্রতিষ্ঠান পুরস্কার ভূষিত করেছে কিনা আমাদের জানা নেই। তার মরণোত্তর প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকুÑ একথা আলোচনায় আসে। রতনতনু ঘোষের রচনা সংখ্যার দিক থেকে কম নয়। গুণগতমান ও বিষয় বৈচিত্র্যের দিক থেকে রতনতনু ঘোষের রচনা সমৃদ্ধ। তার মৃত্যুর পর তার সমগ্র রচনা প্রকাশের উদ্যোগ কোন প্রকাশনা সংস্থা নিয়েছে কিনা আমাদের জানা নেই। খ্যাত-অখ্যাত অসংখ্য পত্রিকায় তার রচনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এগুলো গ্রন্থিত হওয়া জরুরী। আমরা যদি আমাদের কৃতী সন্তানদের সম্মান করতে না জানি এ সম্মান অমর্যাদা আমাদের সকলের। কবি লেখকদের জন্মদিন পালনের উৎসাহ তার ছিল। তার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমরা জমায়েত হয়েছিলাম। তার পঞ্চাশতম জন্মদিন উপলক্ষে একটি গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। অনেকে লেখা পাওয়া গিয়েছিল, স্বনামখ্যাত দুই একজন লেখকের লেখা না পাওয়ায় যে অসম্পূর্ণতা থাকে এ যুক্তিতে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়নি। মৃত্যুর পর তিনি আলোচনায় আসবেন না সঙ্গত। রতনতনু ঘোষ আমাদের স্মৃতিতে বেঁচে থাকবেন। আমরা যারা আমাদের বন্ধু হারিয়েছি। তাদের জন্য তার মৃত্যু দিনে স্মরণসভায় দাঁড়ানো বেদনার। যারা চলে যায় তারা যায় ... তাদের স্মৃতি নিয়ে অন্যরা বেঁচে থাকে এটাই প্রকৃতির নিয়ম। রতনতনু ঘোষ সারাজীবন সত্য, ন্যায় ও ইতিহাসের দায় থেকে সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনে নিবেদিত ছিলেন। শোষণমুক্ত সমাজ নির্মাণে তিনি ব্রতী হয়েছিলেন। শিক্ষকতা, লেখালেখিতে তিনি ছিলেন। প্রতিটি সৎ উদ্যোগ কখনো বৃথা যায় না কিংবা হারিয়ে যায় না। রতনতনু ঘোষের চিন্তায় শক্তিতে একদিন জনগণ জ¦লে উঠবে। রেস্তোরাঁ, পত্রিকা অফিস, রমনা, আজিজ মার্কেট, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, শাহবাগের সবুজ চত্বর ঘিরে আমাদের আড্ডা গভীর রাত পর্যন্ত চলেছে। লেখার উপাদান, নতুন আড্ডায় বিষয় নিয়ে আমরা যে যার ঘরে ফিরে গিয়েছি। দীর্ঘ এক বছর আমাদের আড্ডায় রতনতনু ঘোষ অনুপস্থিত আছেন। ‘মৃত্যু’ তাকে আড্ডা থেকে সরিয়ে নিয়েছে। রতনতনু ঘোষ স্মৃতিতে সরব আছেন। তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।
×