ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মাহির দীপন

এক অদম্য নারীর এগিয়ে যাওয়া

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

এক অদম্য নারীর এগিয়ে যাওয়া

‘রেহানা আক্তার’। তিনি বিশ্বাস করেন, নারীদের আত্মা দুটি। একটি তাকে জীবিত রাখে, আরেকটি তার সুশিক্ষা। যে শিক্ষা না থাকলে তার জীবিত রাখার আত্মাটি নিথর হয়ে যায়। তিনি সব সময় বিবেকের সঙ্গে কথা বলেন। আমাদের চারপাশের যা কিছু আছে তা অন্যের, পরিচয়ও অন্যের, তাহলে আমার কী? যেটা আমার নিজস্ব। তিনি উত্তর পেয়ে যান, সেটা হলো শিক্ষা। জন্মটা মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উপজেলার হাজিপুর গ্রামের বিত্তবান সম্ভ্রান্ত পরিবার নানা বাড়িতে। দাদার বাড়ি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার বারাহির চর গ্রামের মোল্লা বাড়ি। বাবার চাকরির কারণেই পাঁচ বছর বয়স হতেই দিনাজপুরে অবস্থান। পরিবারের বড় মেয়ে। বেড়ে উঠেছিলেন জীবনের স্বাভাবিক নিয়মেই। হঠাৎই জীবনের ঘটল ছন্দপতন। দাদির পীড়াপীড়ির কারণেই তেরো বছরের মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দিলেন বাবা। তবে শর্ত ছিল বিয়ের পর মেয়েকে লেখাপড়া করার সুযোগ দিতে হবে। হয়ত এটাই ছিল জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ কিংবা সাফল্যের প্রথম ধাপ। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে হঠাৎই আবিষ্কার করলেন তিনি এখন আর সেই ছোট মেয়েটি নন। তিনি এখন বাড়ির বউ। কিছুদিনের মাঝেই বুঝতে পারলেন লেখাপড়াটাই তার আর শ্বশুরবাড়ির মানুষগুলোর মাঝের সবচেয়ে বড় বাধা। বছর দূয়েকের মধ্যেই অনুভব করলেন তিনি মা হতে চলেছেন। ‘শিশুর পেটে আর এক শিশু’? এটা তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছিল। গর্ভের সন্তানকে নিয়েই ক্লাস করলেন, পরীক্ষা দিলেন। ১ম বিভাগে লেটার মার্ক নিয়ে এসএসসি পাস করলেন। সন্তান জন্মের পর দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল মানুষটার। সন্তান জন্মের পর অনেকেই চাপ দিলেন লেখাপড়া সাময়িক বন্ধ রাখতে। হাল ছাড়েননি তিনি। বুঝতে পেরেছিলেন, একবার থেমে গেলে নতুন করে চলাটা শুরু করা অনেক বেশি কঠিন হবে। তিনি বাবা আর মার সহযোগিতা এবং নিজের ওপর অগাধ আত্মবিশ্বাস নিয়ে একটু একটু করে নিজের লক্ষ্যে এগিয়েছেন। ২য় বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর ভর্তি হলেন স্নাতকে পলিটিক্যাল সায়েন্সে রংপুর কারমাইকেল কলেজ এ্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, এখানে উল্লেখ্য যে তিনি সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েও শুধুমাত্র সন্তান ছোট থাকার কারণে সুদূর দিনাজপুর হতে ঢাকায় পড়তে আসাটা তাঁর সে সময় হয়ে উঠেনি কিন্তু তাঁর পণ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ তিনি মাড়াবেন। এদিকে লেখা পড়ার পাশাপাশি চাকরির সুযোগও পেয়ে যান। তাই চাকরি করার সুবাদে স্নাতকের মাঝেই দিয়ে ফেললেন বি এ পরীক্ষা। ২য় বিভাগে বি এ পাস করেন দিনাজপুর কেবিএম কলেজ থেকে। মায়ের অনুপ্রেরণায় তাঁর ১৯৯২ সালে চাকরিতে আসা, প্রথম চাকরিটি ছিল বিআরডিবির আরডি ১২ প্রকল্পে। একই সঙ্গে রংপুর কারমাইকেল কলেজে এম.এ. পড়ার জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন। এবার আর ভাগ্য সহায় হল না। দুটি পরীক্ষার পর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এছাড়া পারিবারিক চাপ তো ছিলই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক সময় ইজউইর চাকরি ছেড়ে চষধহ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ, চউইঋ, ঈধৎরঃধং, ঞসংং এসব প্রতিষ্ঠানে সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন। .২০০৪ সালের ডিসেম্বর হতে ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অমর্ত্য সেনের প্রতীচী ট্রাস্ট হতে সুযোগ পান সাংবাদিকতায় সালমা সোবহান ফেলোশিপ করার, সেই সুবাদে বহুদিন মুক্ত সাংবাদিকতাও করেছেন। ঢাকাতে আাসার পর তিনি চাকরি সংসার সামলিয়ে এই মেধাবী মানুষটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনিস্টিটিউট থেকে এমএসএস ডিগ্রী ২য় বিভাগে অর্জন করেন ২০১০ সালে। দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে রোটারেক্ট ক্লাবের সঙ্গে ফলে তৈরি হয়েছেন একজন মানুষ গড়ার কারিগর। তাছাড়াও তিনি বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কর্মাসের একজন সদস্য, সম্পৃক্ত আছেন কিছু এনজিওর গভর্নিং বডিতেও। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি কাজ করেছেন, ট্টেনিং, পাবলিক রিলেশন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশাসন, এ্যাকাউন্টস্, মিড়িয়া, মাইক্রোকেডিট এবং মানবাধিকার নিয়ে। তিনি সরকারী, স্বায়িত্তশাসিত এবং এনজিও তে কাজ করার পর চিন্তা করলেন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এবার কাজ করবেন সেই সুবাধেই ২০১৪ সাল থেকে অদ্যাবধি স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের ঝঃঁফবহঃ ডবষভধৎব এর উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত আছেন। ভবিষ্যতে তিনি নারী উদ্যোক্তা হিসেবে সমাজে কাজ করতে চান। কিছু লেখালেখি করছেন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যা কোন এক বই মেলাতে প্রকাশ পাবে। নারী এবং পথ শিশুদের নিয়ে কাজ করার আছে নানা পরিকল্পনা। তিনি বিশ্বাস করেন নারীরা যদি একটু সচেষ্ট হন তাহলেই তারা নিজেদের সমাজের তথাকথিত নিয়মের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করতে পারবেন। পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমাজের সকল কাজে নিজেদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্র প্রসারিত করতে পারবেন। আর তিনি মনে করেন কোন কন্যা শিশুকে যেন বাল্য বিবাহের বেড়াজালে পড়তে না হয় সেজন্য প্রথমেই বাবা মা কে সচেতন থাকতে হবে, কারণ বাল্য বিবাহ হলো সমাজের একটি ব্যাধি, এই ব্যাধি নির্মূল করতে হলে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। এই দীর্ঘ সময়ের চাকরি জীবনে একা একা নিজের সঙ্গে, সমাজের প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। সফলতার ঝুড়ি তেমন পরিপূর্ণ না হলেও তারপরও তিনি সন্তুষ্ট কারণ মফঃস্বল শহরের তেরো বছর বয়সের একটি মেয়ে বাল্য বিবাহের স্বীকার হয়েও সমস্ত প্রতিকূলতাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে আজ তিনি নিজ নামের পরিচয়ে পরিচিত হয়েছেন, এখানেই তিনি তৃপ্ত। মুখের হাসি, আর একাগ্রতা দিয়ে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা দৃঢ় মনোবল নিয়ে অতিক্রম করেছেন তিনি। কারও প্রতি রাগ কিংবা ক্ষোভ রাখেননি। একমাত্র সন্তানটি তাঁর সকল কাজের প্রেরণার উৎস। তাঁর সন্তানটি একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। এই সন্তানকে নিয়েই পাড়ি দিয়েছেন দীর্ঘ পথ। সমাজে একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কাজ করছেন আরও হাজারো নারীর স্বপ্ন পূরণের সোপান হিসেবে। পড়ন্ত বিকেলে চোখের কোণে একটু অশ্রু এসে গেলো মানুষটার, আর সেটা হলো জীবনের পথ চলার সাফল্যের আনন্দ অশ্রু।
×