ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নীলনক্সা নিয়েই এগোচ্ছে মিয়ানমার

রাখাইনে চীনা বিনিয়োগে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন, আজ করিডর চুক্তি

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রাখাইনে চীনা বিনিয়োগে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন, আজ করিডর চুক্তি

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ রোহিঙ্গা নিধন নিয়ে বিশ্ব যাই বলুক, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষে যত আহ্বান জানানো হোক, জাতিসংঘ বা নিরাপত্তা পরিষদে সর্বোচ্চ যে সিদ্ধান্তই হোক না কেন মিয়ানমার তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে অটল অবস্থানে থেকে এগিয়ে চলেছে। এ স্বার্থ পুরো মিয়ানমারবাসীর পক্ষে নয়, গুটি কয়েক অবসরপ্রাপ্ত ও বর্তমান উর্ধতন সেনা কর্মকর্তাদের। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের গণহত্যা, নিধন, জ্বালাও পোড়াও ও বিতাড়ন প্রক্রিয়ার নেপথ্যে যে মূল ঘটনা রয়েছে তা বাস্তবায়নে দেশী-বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগে যৌথ উদ্যোগ প্রকল্প প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। বিদেশী বিশেষ করে চীনের জন্য নিñিদ্র নিরাপত্তার করিডর প্রতিষ্ঠায় মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আজ শুক্রবার স্থানীয় সময় বেলা ১১টায় হতে যাচ্ছে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ)। এদিকে, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনের প্রধান ফিলিপ গ্র্যান্ডিও আগাম সতর্কবাণী জানিয়ে বলেছেন, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের আর কিছুই নেই। তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়া কঠিন। জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে, রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবে কিনা তা নিয়েও তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এর আগে তিনি ৩ দিনের সফরে বাংলাদেশে এসে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা আশ্রিত ক্যাম্প সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন। অগণন রোহিঙ্গার রক্তেভেজা ও গণকবর এবং লাখ লাখ বিতাড়িত রোহিঙ্গা মুসলমানদের বসতি ও সন্নিহিত এলাকার ওপর প্রথম দফায় রাখাইন রাজ্যের নাফ নদ সংলগ্ন উপকূলবর্তী এলাকায় মংডুর কানইয়াং চাউন গ্রাম এলাকা জুড়ে এই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) গড়ে তোলা হবে। এরপরে সেখানকার কিয়াপফুতে হবে আরও একটি বিশেষ অর্থনৈতিক জোন। এসব বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পেয়েছে নাফ রিভার গ্যালাক্সি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট গ্রুপ নামের একটি জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি। এ কোম্পানিতে রয়েছে মিয়ানমারের বেশ কয়েকজন ধনাঢ্য ব্যক্তি ও চীনের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ। মূলত রাখাইন রাজ্য দিয়ে একটি অর্থনৈতিক করিডর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই চীনের সার্বিক সহায়তা নিয়ে মিয়ানমারের জান্তা সমর্থিত সুচি সরকার বহু আগে থেকেই পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা এখন পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। এর পাশাপাশি রাখাইন রাজ্য ও মিয়ানমার সীমানার অভ্যন্তরে রয়েছে হাইড্রো কার্বন ও গ্যাসের বিপুল রিজার্ভ। এই হাইড্রো কার্বন এবং গ্যাস নিয়েও আছে রাশিয়া ও ভারতের বিশেষ স্বার্থ। আর এ কারণে রোহিঙ্গাদের গণহারে হত্যা ও নিধন এবং বিতাড়ন প্রক্রিয়ায় চীন, রাশিয়া ও ভারত শুধু উদ্বেগ প্রকাশ ছাড়া সোচ্চার কোন ভূমিকায় নেই। সীমান্তের ওপারের সূত্র এবং বিভিন্ন অনলাইন গণমাধ্যমে গোপন তৎপরতার এসব খবর ফাঁস করলেও মিয়ানমার সরকার বাণিজ্যিক স্বার্থের কারণে রাখাইনে রক্তাক্ত যে অভিযান শুরু করেছে তা শেষ পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছে। গত ২৪ আগস্ট জাতিসংঘের আনান কমিশন রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের রিপোর্ট পেশের আগেই রাখাইনে সেনা মোতায়েন শুরু হয়ে যায়। প্রণীত নীলনক্সা অনুযায়ী ২৫ আগস্ট রাত থেকে শুরু হয়ে যায় বর্বর অভিযান। এর কারণ হিসেবে মিয়ানমার সরকার পক্ষে সে দেশের সীমান্তবর্তী রাজ্য রাখাইনের একটি সেনাসহ ৩০টি পুলিশ চৌকিতে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ‘আরসা’ হামলার কথা ফলাও করে জানান দিয়ে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা শুরু করে। আরসার পক্ষ থেকেও হামলার দায়-দায়িত্ব স্বীকারের কথা প্রচার করা হয়। কিন্তু দিন যতই গড়িয়েছে পুরো বিষয় নিয়ে কেবলই রহস্য দানা বেঁধেছে। সেখানকার কয়েকটি গণমাধ্যমও এ রহস্য ফাঁস করেছে। সূত্রগুলো বলছে, গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর তড়িঘড়ি করে মিয়ানমার সরকার একটি কোম্পানি গঠন করে এসইজি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। ওই সময়ে সিদ্ধান্ত হয় নাফ রিভার গ্যালাক্সি ডেভেলপমেন্ট গ্রুপ এসব এসইজি প্রতিষ্ঠা করবে। এ জন্য উক্ত কোম্পানিকে বিপুল পরিমাণ জমিও বরাদ্দ দেয়া হয়। আর এসব জমির ওপর ছিল সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের জনবসতি। কয়েকটি স্থানে রাখাইনদের বসতিও ছিল। তাদেরকে সামরিক অভিযান শুরুর পূর্বেই সতর্কতার সঙ্গে সরিয়ে নেয়া হয়। সূত্র জানিয়েছে, রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের নাফ নদ উপকূলবর্তী এলাকাটি গ্যাস ও খনিজ সম্পদে ভরপুর। এ সম্পদের প্রতি নজর রয়েছে কয়েক শক্তিশালী দেশের। যার মধ্যে চীন অন্যতম। চীন আগে থেকেই মিয়ানমারে বিপুল অঙ্কের অর্থের বিনিয়োগ করে রেখেছে। বিশেষ করে চীনের পক্ষে মিয়ানমারের তেল ও গ্যাস টার্মিনালে অর্থায়ন করেছে চীনা পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন। জমি অধিগ্রহণের জন্য তাদের পক্ষে অর্থও বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যা পরিশোধ করা হয়নি। সূত্রমতে, রাখাইন রাজ্যে প্রথমে একশ’ একর ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ৪ হাজার একর জমির ওপর পর্যায়ক্রমে এসব এসইজি প্রতিষ্ঠা করা হবে। সূত্র আরও জানায়, যেহেতু সংখ্যালঘু রাখাইন মুসলিমরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বছরের পর বছর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে সে কারণে পুরো এলাকাটি গোলযোগপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। কিন্তু দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা তাদের আর্থিক বিনিয়োগ নির্বিঘœ করতে সকল গোলযোগের অবসান চায়। আর এ অবসান ঘটাতে হলে রোহিঙ্গাদের সমূলে উৎখাত ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। এরই ফলশ্রুতিতে গত ২৫ আগস্টের রাত থেকে রাখাইন রাজ্যজুড়ে সশস্ত্র সামরিক অভিযান শুরু হয়েছে। সিটওয়ে, মংডু, রাচিদং, বুচিদং এ চার শহর এলাকার যেখানে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা বছরের পর বছর বসতি গেড়ে আছে ওইসব এলাকায় চলেছে অভিযান। শুধু তাই নয়, এ অভিযান ইতোপূর্বেকার তুলনায় হ্রাস পেলেও এখনও দমন নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে। উল্লেখ্য, গত ২০১২ সালে মিয়ানমারের পার্লামেন্টে যে আইন পাস হয়েছে তাতে বিদেশী বিনিয়োগ আনার লক্ষ্যে ৭০ বছরের জন্য জমি লিজ দানের সুযোগ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে সিটওয়ে (সাবেক আকিয়াব) বন্দরটি সম্পূর্ণ আধুনিকায়ন হয়েছে চীনা বিনিয়োগে। এ বন্দর দিয়ে গ্যাস ও তেল আসবে বিদেশ থেকে এবং সে তেল ও গ্যাস চলে যাবে চীনের কুনমিং শহর এলাকা পর্যন্ত। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে গ্যাস ও তেল সরবরাহের লাইন প্রতিষ্ঠাও করা হয়েছে চীনের অর্থায়নে। এছাড়া সিটওয়ে বন্দরকে ঘিরে বিশাল বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে চীন একটি আধিপত্য বিস্তারেও পরিকল্পনায় রয়েছে। অপরদিকে, এ বন্দর থেকে সমুদ্র তলদেশ দিয়ে ভারতের সঙ্গে রয়েছে গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা। ভারতও চায় তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ নির্বিঘœ করতে। এছাড়া চীনের একক আধিপত্য রোধে ভারত মিয়ানমারে তাদের নিজেদের অবস্থান সংহত রাখতে খুবই তৎপর। সূত্র জানায়, সাবেক আরাকান (বর্তমানে রাখাইন) রাজ্যটি একদিকে খনিজ, অপরদিকে বনজ সম্পদেও ভরপুর। এছাড়া নাফ নদের উপকূলে রয়েছে একাধিক গ্যাসক্ষেত্র, যাতে রয়েছে বিপুল পরিমাণ গ্যাসের ভা-ার। চীন চায় তাদের ইউনান প্রদেশের শহর কুনমিংকে মিয়ানমারের বন্দর শহর কিয়াউক হিয়াউকে যুক্ত রেখে তেল ও গ্যাস সরবরাহের সুযোগ নিশ্চিতকরণ। আর এ কারণেই মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যকে নিয়ে এ পর্যন্ত যত অপকর্ম চালিয়েছে চীন সে নিয়ে কখনও বিরোধিতা করেনি, উল্টো বরাবরই মিয়ানমারের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়ে আসছে। সর্বশেষ ২৫ আগস্ট রাত থেকে মিয়ানমার সরকারের জান্তা বাহিনী অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর যে হিং¯্র ছোবল মেরেছে তাতেও চীন নীরব ভূমিকায় রয়েছে। উল্টো মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এমনকি নিরাপত্তা পরিষদেও চীনের ভূমিকা মিয়ানমারের পক্ষে। সূত্রে আরও জানা গেছে, রাখাইন সমুদ্র বেসিনে বর্তমানে কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাজ্যের শেল অয়েল, যুক্তরাজ্যের শেভরন, ফ্রান্সের টোটাল অয়েল, অস্ট্রেলিয়ার উড সাইট এনার্জিসহ বিদেশী একাধিক তেল অনুসন্ধানকারী ও উত্তোলন কাজে নিয়োজিত কোম্পানিগুলো। উল্লেখ করা যেতে পারে, রাখাইন সমুদ্র সীমানায় মোট ১০টি গ্যাস ব্লক রয়েছে। যাতে এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ গ্যাস ভা-ারের অবস্থান রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা প্রকাশ করেছে। মিয়ানমারের নিজস্ব কোন বিশেষজ্ঞ ও প্রযুক্তিগত খাতে সক্ষমতা নেই। ফলে নিজেদের অর্থনীতির ভীতকে মজবুত করতে এরা বিদেশী বিশেষজ্ঞ মহলের মুখাপেক্ষী। ইতোমধ্যে রাখাইন সমুদ্র উপকূলে যে গ্যাস পাওয়া গেছে, সে গ্যাস উৎপাদিত হয়ে পাইপ লাইনের মাধ্যমে চলে যাচ্ছে চীনে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বাহিনী তাদের জনগণের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে এই প্রক্রিয়া শুরু করেছে বহু আগে। সে প্রক্রিয়া থেকে সুচির বেরিয়ে আসার কোন সুযোগ রাখা হয়নি। ফলে সুচিও রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞে তার সমর্থন রেখেই চলেছেন। এদিকে, জয়েনভেঞ্চারের এ চুক্তি নিয়ে নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে সে দেশে রয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের মাঝে। আজ এ চুক্তি সম্পাদনের আগে-পরে নতুন করে সহিংসতা জন্ম নিতে পারে বলেও আশঙ্কার জন্ম নিয়েছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল চুক্তি স্বাক্ষরের দিন হিসেবে সংশ্লিষ্ট এলাকায় নিñিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এখন মাইকিং নয়, রোহিঙ্গা পল্লীগুলোকে কেন্দ্র করে সেনাবাহিনীর পক্ষে ঢোল পিটিয়ে সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছে। এদিকে, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কর্মকা- নিয়ে সিটওয়েতে সরকারী উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠকও হয়েছে। বলা হয়েছে, এ ধরনের অঞ্চল গড়ে তোলার কাজটি বর্তমান সরকারের সিদ্ধান্ত নয়। এটি পূর্বের সরকার গ্রহণ করেছিল। সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নেই বর্তমান সরকার কাজ করছে। জানানো হয়েছে, এ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীরা করবিহীন সুবিধা যেমন পাবেন, স্বল্পমূল্যে জমিও তাদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। ওপারের সূত্রগুলো বলেছে, রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতায় সেনাবাহিনী যেসব বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে সেসব ভূমিজুড়েই এ জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। অপরদিকে, রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব করেন এমন কয়েকটি সূত্রে জানানো হয়েছে, রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে এ পর্যন্ত তিন শতাধিক রোহিঙ্গা গ্রাম ও ৪০ হাজারেরও বেশি বাড়িঘর পুড়িয়ে দেযা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশে চলে আসা রোহিঙ্গা যাতে পুনরায় ফিরে যেতে না পারে সে লক্ষ্যেই তাদের বসতি এলাকাগুলো প্রহরায় রাখা হয়েছে এবং সীমান্তে নষ্ট হয়ে যাওয়া কাঁটাতারের বেড়া দ্রুত মেরামত যেমন চলছে, তেমনি অসম্পন্ন এলাকায় নতুন কাঁটাতারের বেড়াও প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সকালেও নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, তুমব্রু ও জলপাই সীমান্তে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ বিজিপি সদস্যদের কাঁটাতারের বেড়া মেরামত করতে দেখা গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত বসতিগুলোতে যাওয়া বন্ধ মিয়ানমারের জিরো লাইনে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, সীমান্তের খুব কাছে অবস্থান নেয়ার একটি উদ্দেশ্য ছিল যেন রাখাইনের পরিস্থিতি সামান্য শান্ত হলে তারা দেশে ফিরে যাবেন। তাদের কারও কারও বাড়ি সীমান্তের এক থেকে তিন কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে। এমনিতে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে তারা দিনে একবার হলেও নিজের ক্ষতিগ্রস্ত বসতিগুলো দেখতে যেতেন। আর এখন কাঁটাতারের বেড়া আরও মজবুত করায় সেটি আর সম্ভব হচ্ছে না। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যকার সীমান্ত পথ রয়েছে ২৭১ কিলোমিটার। এর মধ্যে ২০৮ কিলোমিটার স্থলপথ ও ৬৩ কিলোমিটার জলসীমান্ত। পাঁচ বছর আগে থেকেই মিয়ানমারের অভ্যন্তরের অধিকাংশ সীমান্তজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেছে সে দেশের সরকার। প্রসঙ্গত, ১৭৮৪ সালে বার্মার তৎকালীন রাজা আরাকান দখলের পর থেকে রোহিঙ্গাদের ভাগ্যবিড়ম্বনার সূচনা হয়। ১৭৯৯ সালে পঁয়ত্রিশ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বার্মিজদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে আরাকান থেকে নিকটবর্তী চট্টগ্রাম অঞ্চলে চলে আসে। ওই সময় আরাকানের হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। ব্রিটিশরা এ অঞ্চল ছেড়ে যাওয়ার পর ১৯৬২ সালে বার্মার সামরিক জান্তা দেশটির ক্ষমতা দখল করে। মূলত এরপর থেকেই রোহিঙ্গাদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। ১৯৭০ সালে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সনদ দেয়া বন্ধ করে দেয় বার্মিজ কর্তৃপক্ষ। তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয় ১৯৭৪ সালে। ১৯৭৭ সালে অপারেশন নাগামিন বা ড্রাগন কিং নামে একটি অভিযান শুরু করে মিয়ানমার সরকার। তখন দাবি করা হয়েছিল এর উদ্দেশ্য হচ্ছে কোন বিদেশী মিয়ানমারে অবস্থান করছেন কিনা তা যাচাই করা। তবে প্রকৃতপক্ষে এটি রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানে পরিণত হয়। সে সময় (১৯৭৮) সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে আসে বাংলাদেশে। তবে সরকারী হিসেবে তা আড়াই লাখ। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি প্রত্যাবাসন চুক্তি হয়। এর অধীনে অধিকাংশ রোহিঙ্গা ফেরত যায় মিয়ানমারে। ১৯৮২ সালে মিয়ানমার নাগরিক আইন জারি করে। ওই আইনে দেশটিতে বসবাসরত ১৩৫টি জাতিকে স্বীকার করে নিলেও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়। এই আইন এখনও বলবৎ আছে। রোহিঙ্গারা সরকারী অনুমতি ছাড়া ভ্রমণ করতে পারে না। জমির মালিকানা অর্জন করতে পারে না। দুটির বেশি সন্তান না নেয়ার অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করতে হয় রোহিঙ্গাদের। ১৯৯১ সালে রাখাইনে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে সরকারীভাবে দ্বিতীয় দফায় শুরু হয় রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান। এ সময় (১৯৯১-৯২) প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা আবার বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। ১৯৯৩ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ১৯৯৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে দুই লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত যায়। ২০০৫ সাল থেকে প্রত্যাবাসনের অপেক্ষায় বাংলাদেশে রয়ে গেছে প্রায় ৩৩ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী। ২০১২ সালেও রোহিঙ্গাবিরোধী দাঙ্গায় মিয়ানমারে নিহত হয় শতাধিক রোহিঙ্গা। তখনও লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর মংডুর কাউয়ারবিলে পুলিশের তিনটি ঘাঁটিতে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে ৯ পুলিশ সদস্যকে হত্যা করেছে বলে দাবি রয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষের। শতাধিক রোহিঙ্গা জঙ্গী তাদের ওপর হামলা করার সময় পাল্টা হামলায় আট হামলাকারীও নিহত হয়। পুলিশের দাবি, রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন ও আল ইয়াকিন নামে একটি সামরিক গোষ্ঠী এ হামলা চালিয়েছে। পরদিন ১০ অক্টোবর রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। বিভিন্ন শহরে সেনা মোতায়েন করা হয়। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ করেছে প্রায় ৮৫ হাজার রোহিঙ্গা। চলতি বছরের ২৫ আগস্ট একই সঙ্গে ৩০টি পুলিশ ও সেনা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা জঙ্গীদের হামলা দেশটির সৈনিক হত্যা ও অস্ত্র লুটের অভিযোগ এনে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু করে সেনাবাহিনী ও পুলিশ। ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬ লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় নিয়েছে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে। অনুপ্রবেশ অব্যাহত টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, উনচিপ্রাং, উখিয়ার বালুখালী, আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত ও সমুদ্র পথে শামলাপুর বস্তিতে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে ওসব সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অন্তত ৭ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা আগমনের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। ককটেলসহ রোহিঙ্গা আটক টেকনাফের হোয়াইক্যং কেরুনতলী থেকে একটি ককটেলসহ শফিকুল ইসলাম নামে এক রোহিঙ্গা যুবককে আটক করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার সকালে হোয়াইক্যং কেরুনতলীতে নতুন করে গড়ে ওঠা রোহিঙ্গা বস্তি থেকে হেঁটে যাওয়ার পথে গোপনে সংবাদ পেয়ে পুলিশ এ অভিযান চালায়। ধৃত রোহিঙ্গা মিয়ানমারের মংডু থানার ঢেঁকিবনিয়ার জিয়াবুল হকের পুত্র। রোহিঙ্গাদের জন্য ১৫ হাজার ল্যাট্রিন রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা অসহায় রোহিঙ্গাদের জন্য উখিয়া ও টেকনাফের ১০টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৩৯২টি নলকূপ স্থাপন করেছে একটি এনজিও সংস্থা। ৩০ হাজার ৬০০ রোহিঙ্গা ব্যবহারের জন্য ৭৬৫টি ল্যাট্রিনও স্থাপন করা হয়েছে। ১৫ অক্টোবরের মধ্যে ১৫ হাজার ল্যাট্রিন ও ১ হাজার ১২০টি টিউবওয়েল বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে এ সংস্থাটির। সামগ্রিক কাজে জেলা প্রশাসনের তত্ত্ব¡াবধানে ও সেনা সহযোগিতায় উখিয়া-টেকনাফে ১২টি ক্যাম্প করা হয়েছে। এসব ক্যাম্পে ত্রাণ সংগ্রহের পাশাপাশি বিতরণও কাজও চলছে। তালিকা ও বিশেষ কার্ড বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ ও শৃঙ্খলা আনতে তালিকা করার উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এ তালিকার কাজ চলছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে, তালিকা প্রস্তুত হওয়ার পর রোহিঙ্গা পরিবারগুলোকে বিশেষ কার্ড দেয়া হবে। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খালেদ মাহমুদ জানিয়েছেন, বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন কার্যক্রমও এগিয়ে চলেছে। সেনাবাহিনী মোতায়েনের পর আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে ব্যাপক শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে।
×