ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আটতলার ৪০ গ্যালারিতে তুলে ধরা হবে পাঁচ শ’ কোটি বছরের বিবর্তনের কথা

কংক্রিটের শহর ঢাকায় হচ্ছে প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

কংক্রিটের শহর ঢাকায় হচ্ছে প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর

মনোয়ার হোসেন ॥ প্রকৃতির মাঝেও রয়েছে অপার বিনোদন। বৃক্ষ থেকে পুষ্প কিংবা তরুলতা জুড়িয়ে দেয় নিসর্গপ্রেমীর নয়ন। সেসব প্রকৃতিপ্রেমীর জন্য দারুণ সুখবর। কংক্রিটের শহর ঢাকায় নির্মিত হবে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের পাশে দৃশ্যমান হবে বাংলাদেশ ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম। তিন একরের বেশি জায়গায় গড়ে উঠবে আটতলাবিশিষ্ট এই জাদুঘর কমপ্লেক্স। বহুতল ওই ভবনের চতুর্থ তলায় থাকবে চল্লিশটি স্থায়ী প্রদর্শনী গ্যালারি। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের প্রকৃতি ও পরিবেশের সাক্ষ্যবহ প্রাণী ও উদ্ভিদজগতকে মেলে ধরা হবে প্রদর্শনালয়গুলোয়। দেখা মিলবে সুউচ্চ পর্বত, গহিন অরণ্য, সাগর, নদী, হাওড়, উদ্ভিদ, পশু-পাখি, বৃক্ষরাজি, মরুভূমি থেকে শুরু করে ভূতত্ত্ব ও জলবায়ুবিদ্যার বহুমাত্রিক বিষয়ের তথ্যচিত্র। মেরিন টানেলের ভেতর দিয়ে দর্শনার্থীরা অবলোকন করবে বিভিন্ন প্রজাতির জীবন্ত মাছসহ জলজ প্রাণীকে। থাকবে ডাইনোসরের কাঠামো কিংবা মিসরের মমি বিষয়ক প্রদর্শনীসহ পৃথিবীর ৫শ’ কোটি বছরের প্রাকৃতিক ইতিহাসের বিবর্তনমূলক তথ্য ও নিদর্শন। দেশের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নির্মিতব্য এ জাদুঘরে আরও থাকবে প্ল্যানেটরিয়াম এবং প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণবিষয়ক গবেষণাগার। সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন এই উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর। সেই লক্ষ্যে ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে ভূমি অধিগ্রহণের কাজটি। কিছুদিনের মধ্যেই দেশের খ্যাতনামা স্থপতিদের কাছ থেকে এই জাদুঘরের নক্সা আহ্বান করা হবে। আশা করা হচ্ছে, আগামী বছরের মাঝামাঝি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের নির্মাণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এগিয়ে যাবে নিসর্গ ও জীবের বৃত্তান্ত তুলে ধরা দর্শনার্থীদের বিনোদনের অভিলাষী এই জাদুঘর। এই প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৫শ’ কোটি টাকা। তিন বছর আগে দেশের প্রথম এই প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর নির্মাণের পরিকল্পনা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের এপ্রিলে জাতীয় জাদুঘরের একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি এই প্রাকৃতিক জাদুঘর নির্মাণের ঘোষণা দেন। এরপর একই বছরের নবেম্বরে প্রধানমন্ত্রী সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে গিয়ে জাদুঘরটির নির্মাণকাজ দ্রুত শুরু করার তাগিদ দেন। সেই থেকে শুরু এই জাদুঘর নির্মাণের প্রাথমিক পর্বের কার্যক্রম। এরই ধারাবাহিকতায় এ জাদুঘর নির্মাণের জন্য সেগুনবাগিচায় মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের পাশে ৩.৩৫৬৮ একর জমি বরাদ্দ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, ইতোমধ্যে এই প্রকল্পের ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) কিছু সুপারিশ দিয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। সেই সুপারিশের ভিত্তিতে এখন কাজ করছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও জাতীয় জাদুঘর। পরবর্তীতে এটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় তোলা হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়কাল ধরা হয়েছে ২০২৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত । এ বিষয়ে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর জনকণ্ঠকে বলেন, প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর নির্মাণের জন্য ইতোমধ্যে আমাদের কর্মপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা চাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকারভিত্তিক এই প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করতে। সে লক্ষ্যে সেগুনবাগিচার ভাষা ইনস্টিটিউটের পাশে ৩ একরের বেশি একটি জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। শীঘ্রই বিশেষায়িত এ জাদুঘরের নক্সা প্রণয়নের কাজটি শুরু হবে। এ জন্য দেশের খ্যাতনামা স্থপতিদের কাছে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নক্সা আহ্বান করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী সেখানে যে গাছ আছে তা রেখেই নক্সা তৈরি করা হবে। আশা করছি, আগামী বছরের মাঝামাঝি এই জাদুঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে। এরপর সচল ও উদ্যমী নির্মাণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যেই জাদুঘর সম্পন্ন করার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। প্রদর্শনীর উপযোগী না হলেও ওই সময়ের মধ্যে প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘরের ভবন নির্মাণের কাজটি সম্পন্ন করার আশা রয়েছে আমাদের। নতুন ভাবনা ও আঙ্গিকের এই জাদু প্রসঙ্গে সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, এই প্রথম দেশে কোন প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর হচ্ছে। আমাদের দেশের প্রকৃতির বিবর্তনকে তুলে ধরা হবে এর মাধ্যমে। উপস্থাপন করা হবে দেশ-বিদেশের জীববৈচিত্র্য। এটি দর্শনার্থীর বিনোদনের পাশাপাশি মানুষের মাঝে প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ে সচেতনতাও বৃদ্ধি করবে। প্রকল্পটি প্রসঙ্গে জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের একটি জাদুঘর বিন্যাসের সম্পূর্ণ সক্ষমতা নেই আমাদের। সে কারণে হয়ত চীন, কোরিয়া বা অন্য কোন দেশ যাদের এ কাজের অভিজ্ঞতা আছে তাদের সহযোগিতা নেয়া হবে । ডাইনোসর, ফসিল বা মমি এগুলো পেতে হলে আমাদের অবশ্যই অন্য দেশের প্রাকৃতিক জাদুঘরের সহযোগিতা নিতে হবে। এছাড়া জাতীয় জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে কাজ হলেও আমরা গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও স্থাপত্য অধিদফতরকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করব। আশা করছি, এই অর্থবছরেই প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর নির্মাণে নক্সা তৈরির বরাদ্দটি পাওয়া যাবে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও জাতীয় জাদুঘর থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, একটি বিশেষায়িত জাদুঘর হবে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর (বাপ্রাইজা)। প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের নিদর্শনাদি সংগ্রহ ও প্রদর্শনের পাশাপাশি প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ সংক্রান্ত গবেষণায় কাজ করবে গবেষণাধর্মী এ প্রতিষ্ঠান। জাতীয় জাদুঘরের মতোই একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হবে এটি। এখানে প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের বস্তুগত ও অবস্তুগত উভয় ধরনের সংগৃহীত নিদর্শন প্রদর্শিত হবে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের সমৃদ্ধি ও পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে ডিজিটাল আর্কাইভ নির্মাণ করা হবে। দেশের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে বিনোদনের পাশাপাশি সর্বসাধারণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করবে এই জাদুঘর। এই জাদুঘরের গ্যালারির মাধ্যমে উপস্থাপিত হবে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবনসহ কক্সবাজার, মধুপুর বন, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি, হাকালুকি হাওড়, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃতি। থাকবে জীববৈচিত্র্যের অপূর্ব উপস্থাপন। এছাড়া প্রায় ৫শ’ কোটি বছরের পৃথিবীর ইতিহাসে হিমশীতল মেরু অঞ্চল থেকে উষ্ণপ্র¯্রবণ, তপ্তমরুভূমি, গহিন অরণ্য, সুউচ্চ পর্বত, গভীর সমুদ্র যে সকলস্থানে উদ্ভিদ ও প্রাণীর বাস রয়েছে তাদের নির্বাচিত সংখ্যকের স্থায়ী প্রদর্শনীর উপস্থাপনা। কোন্ প্রাণী কোন্ দেশের একান্ত নিজস্ব এবং কোন্ কোন্ দেশের প্রাণীর মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে, পৃথিবীর কোন্্ অঞ্চলে বর্তমানে কী কী প্রাণী রয়েছে তার প্রাকৃতিক পরিবেশের উপস্থাপনা। নির্দিষ্ট অঞ্চলের জলবায়ুর সঙ্গে উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের সম্পর্ক এবং লক্ষ-কোটি বছরের আগের অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন মেরুদ-ী প্রাণীর ভৌগোলিক বিস্তার, বাসস্থান, প্রাকৃতিক পরিবেশ ব্যবস্থাপনা। কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলে অথবা বাসস্থানের অন্তর্ভুক্ত সকল জৈব-অজৈব বস্তু, উদ্ভিদ জগতে সালোকসংশ্লেষণের ফলে উৎপাদিত বস্তু, নতুন সব উদ্ভিদ ও উৎপাদিক উদ্ভিজ্জ সামগ্রী প্রদর্শিত হবে। প্রাণিজগতের সব সদ্য এবং উৎপাদিত প্রাণিজ সামগ্রী, এমনকি হাইড্রোকার্বন থেকে উৎপাদিত সামগ্রী যেমন ফসিল, জ্বালানি তেল, গ্যাস; এসব নিয়ামকের বিনোদনমূলক আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রদর্শনীর উপস্থাপন করা হবে। তথ্যসূত্রে জানা যায়, আটতলাবিশিষ্ট এই জাদুঘর কমপ্লেক্সের প্রতি তলায় জায়গা থাকবে ৪ হাজার ৬৪৫ বর্গমিটার। সুপরিসর ভবনটিতে থাকবে একটি বেজমেন্ট। প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর ভবনটির চারতলার মধ্যে চারটি বিশেষায়িত বিভাগের আওতায় থাকবে চল্লিশটি স্থায়ী প্রদর্শনী গ্যালারি। পঞ্চমতলায় থাকবে প্লানেটরিয়াম ও মিলনায়তন। ষষ্ঠ তলায় ঠাঁই পাবে দশটি সংগ্রহশালা ও পাঁচটি গবেষণাগার। সপ্তম তলায় নির্মিত হবে ডাটা সেন্টার ও অফিস। গ্রন্থাগার ও মিলনায়তনে সাজানো হবে অষ্টমতলা। সেই সঙ্গে থাকবে ডরমিটরি ভবন ও সংরক্ষিত উদ্যান। জাদুঘর সূত্র জানায়, দেশের প্রথম এই প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর নির্মাণের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির আহ্বায়ক হচ্ছেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। ওই কমিটির সদস্য হিসেবে সম্পৃক্ত ছিলেন সদ্য প্রয়াত নিসর্গবিদ অধ্যাপক ড. দ্বিজেন শর্মা। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদ, সমুদ্রবিজ্ঞান পরামর্শক অধ্যাপক ড. কাউসার আহমদ, উদ্ভিদবিদ ও পরামর্শক অধ্যাপক ড. শেখ শামীমুল আলম, প্রাণিবিদ ও বন্যপ্রাণী বিশারদ অধ্যাপক ড. মোস্তফা সিরাজ, প্রাণিবিদ ও পাখি বিশারদ অধ্যাপক ড. ফিরোজ জামান, উদ্ভিদবিদ ও জাদুঘরবিদ জাতীয় জাদুঘরের প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগের কিপার ড. শিখা নূর মুনসী।
×