ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কর্মসংস্থানের জন্য ছোট ছোট উদ্যোগের প্রতি নজর দেয়া দরকার

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

কর্মসংস্থানের জন্য ছোট ছোট উদ্যোগের প্রতি নজর দেয়া দরকার

হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা যথারীতি ‘অগ্রহায়ণী’ ফসলকে সামনে রেখে শুরু হয়েছে। দেবী এবার নৌকায় এসেছেন, শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাবেন ঘোটকে। এই উপলক্ষে সারাদেশে উৎসবের আমেজ। নিরাপত্তার ব্যবস্থা চারদিকে। কিন্তু মনে হয় প্রকৃতি উৎসব পালনের সময়টাতে বৈরী থাকবে। বুধবার ছিল মহাসপ্তমীর দিন। সকাল বেলাতেই দেখেছি আকাশ মেঘে ভারি। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিও হয়েছে। এমনটা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে পুণ্যার্থীদের জন্য তা হবে খারাপ সংবাদ। মানুষ বেরোবে কম। তবে ঢাকার রিকশাওয়ালারা করবে দারুণ ‘ব্যবসা’। তারা রোদ-বৃষ্টি, অফিস সময়, স্কুলের সময় ইত্যাদিতে ভাড়া হাঁকে আকাশছোঁয়া। তা করবে না কেন? কক্সবাজারের হোটেলওয়ালা, বিমান কোম্পানিওয়ালারা যদি বিনোদনে গমনকারী পর্যটকদের কাছ থেকে ছুটির সময় গলকাটা ভাড়া নিতে পারে তাহলে রিকশাওয়ালারা নেবে না কেন? সে যাই হোক এটাই তো ‘বাজার অর্থনীতি’। বাজার যা বলবে তাই হবে। কিন্তু সপ্তমী পূজার দিনে রিকশাওয়ালারা বলেছে বাজার মন্দা। এর অর্থ বুঝলাম না। বৃষ্টিতে লোক অফিসে যাবে, ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাবে, কলেজে যাবে, পুণ্যার্থীরা যাবে দেবী দর্শনে। যাত্রীর অভাব কোথায়? বৃষ্টি হবে তো কী হয়েছে? না, রিকশাওয়ালার জওয়াব ভিন্ন। তাদের কথায় রিকশার সরবরাহ এখন বেশি, যাত্রী আগের মতোই। কারণ কী? তাদের কাছ থেকে জানলাম এটা আশ্বিন মাস। সামনে কার্তিক, যা শুরু হবে ১৬ অক্টোবরে। এ সময়টাতে গ্রামে কোন কাজ নেই। কাজের আকাল। তা বলছে গাইবান্ধার রিকশাওয়ালা, বলছে রংপুরের রিকশাওয়ালা, তা বলছে নীলফামারীর রিকশাওয়ালা, বগুড়ার রিকশাওয়ালা। এমনকি নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের রিকশায়ালারাও। আমি গত কয়েকদিনে যতজন রিকশাওয়ালার সঙ্গে কথা বলেছি সবারই কথা গ্রামাঞ্চলে কাজ-কাম এখন কম। কিছুদিন আগেই দুই দুইটা বন্যা হয়ে গেছে। গ্রামের মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছে। তাদের খাবারের টাকা যোগাতে হয়, যোগাতে হয় অন্যান্য প্রয়োজনের টাকা। ‘ক্যাশের’ অভাব। কাজ কম। সামনে ফসল, যাকে গ্রামাঞ্চলে বলা হয় ‘অগ্রহায়ণী’ ফসল। আমরা একে আমনও বলি, যা এক সময় বাংলার প্রধান ধানি ফসল ছিল। স্থানভেদে ঐ ফসল উঠতে বেশ সময় লাগবে। দেরিতে যে আউশ লেগেছে তা কিছু কিছু উঠছে এখন। বন্যার ধাক্কা এখনও মানুষ সামলে উঠতে পারেনি। উত্তরবঙ্গের অনেকের বাড়িঘর ছিল মাটির। বন্যায় তা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। সরকারের সংস্কার কাজ এখনও শুরু হয়নি। এই অবস্থার মধ্যেই যারা পারছে তারাই ছুটে আসছে ঢাকায়। এখানেই দেশের প্রায় অর্ধেক ‘ক্যাশের’ আমদানি। মধু এখানেই। তাই সাময়িক শ্রম দেয়ার জন্য এই সময় উত্তরাঞ্চলের লোকেরা ঢাকায় আসছে। অথচ ঢাকায় আর আগের মতো কাজ নেই। বড় কাজের যোগানদাতা ছিল আবাসন শিল্প। এটা মন্দাক্রান্ত। এছাড়া অন্যান্য খাতেও চাহিদা কম। অতএব অগত্যার গতি রিকশা। এখানে কোন শিক্ষা-প্রশিক্ষণ লাগে না। লাইসেন্স লাগে না। ‘পরিচিতির’ হাত ধরে কোন এক রিকশা গ্যারেজে আশ্রয় নিলেই হয়। টাকা দিয়ে দুইবেলা খাবার সংগ্রহ সেখানেই। থাকার পয়সা লাগে না। রিকশা নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যায়। রাস্তাঘাট চিনতে হয় না, ভাড়াও জানতে হয় না। যাচ্ছেতাই করলেই চলে। কিন্তু এখন চলছে মন্দা। প্রয়োজনের তুলনায় রিকশার আমদানি বেশি। রাস্তার দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। শত শত রিকশা, খালি রিকশা এদিক-ওদিক করছে। কোথাও কোন শৃঙ্খলা নেই। শৃঙ্খলা রক্ষা করাও কঠিন। যদি এত ভাড়ার লোক থাকত তাহলে কোন রিকশাই খালি থাকত না। প্যাসেঞ্জারের অভাব তা এখন বোঝাই যায়। এই রিকশাওয়ালারা গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে কিছু ‘ক্যাশের’ সন্ধানে। এখানে পাচ্ছেও তাই। কিন্তু আশানুরূপ নয়। কারণ রিকশার সরবরাহ বেশি। রোজগার কম, দৈনিক আয় কম। এই অবস্থাকে আমরা কী বলব? বেকারত্ব, অর্ধ বেকারত্ব, পূর্ণ কর্মসংস্থান, না অন্য কিছু। গত সপ্তাহেই একজন সরকার সমর্থক বড় সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তার বাড়ি ফরিদপুর অঞ্চলে। তিনি বলছিলেন শিক্ষিত বেকার সমস্যার কথা। আত্মীয়স্বজন, পরিচিতজনদের চাপে তিনি টিকতে পারছেন না। সবাই চাকরি চায়। বিবিএ, এমবিএ, এমকম থেকে শুরু করে সবাই কমপক্ষে গ্র্যাজুয়েট। সবাই চায় চাকরি। কিন্তু তিনি বললেন, গত এক বছর চেষ্টা করে একটা চাকরির ব্যবস্থাও তিনি করতে পারেননি। আমি বললাম, আপনি তো বলছেন নতুন চাকরির কথা। যাদের চাকরি আছে তাদেরটাই তো চলে যাচ্ছে। মতিঝিল পাড়ায় অফিসে অফিসে আর্তনাদ। বড় বড় ‘এনজিও’তে চাকরি যাচ্ছে। হাজার হাজার লোক চাকরি হারাচ্ছে। ‘আইটি’ খাতেও একই অবস্থা। সেখানে রীতিমতো আন্দোলন হচ্ছে চাকরিচ্যুতির পর। দাবি-দাওয়া তাদের অনেক। এই যে পরিস্থিতি একে কিভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে। ব্যাখ্যার সূত্র পেলাম একটা কাগজে। পরিকল্পনা কমিশনের জন্য তৈরি করা পেপারে একটা গবেষণা সংস্থা ‘এসডিজি’ (সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল) অর্জনে কী কী চ্যালেঞ্জ আছে তা তুলে ধরেছে। সংস্থাটির মতে দেশ ‘জবলেস গ্রোথের’ সম্মুখীন। তাদের মতে ২০১৩-১৬ সালের মধ্যে প্রথমবারের মতো দেশের শিল্পখাতের অবদান কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কমেছে। কৃষিতে নতুন কর্মসংস্থান হয়নি, বরং কমেছে। শিল্পখাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার হ্রাস পেয়েছে। সেবা খাতের অবদান আনুষ্ঠানিক নয়। তারা বলছে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে; কিন্তু শিল্পে কমেছে। রিপোর্টের মোদ্দা কথা হচ্ছে ‘জবলেস গ্রোথ’। আমাদের দেশে কথাটা সেভাবে আলোচনায় আসছে না, যদিও প্রধানমন্ত্রী অনেকবার উন্নয়নের সঙ্গে কর্মসংস্থানের সম্পর্কের কথা গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করেছেন। সুযোগ পেলেই তা তিনি করেন। আমাদের এখানে বিষয়টি এখনও গুরুত্ব না পেলেও প্রতিবেশী দেশে তা এখন বহুল আলোচিত বিষয়। সর্বশেষ খবরে দেখা যাচ্ছে ভারতের ‘জিডিপির’ প্রবৃদ্ধির হার আট শতাংশ থেকে ছয় শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। কারণ হিসেবে ‘বিমুদ্রাকরণ’ (ডিমানিটাইজেশন), জিএসটি (গুডস এ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স) নামীয় ‘এক দেশ এক কর’ নীতি প্রবর্তন, বেসরকারী বিনিয়োগ হ্রাস, আমদানি-রফতানি হ্রাস, উচ্চমূল্যের ক্ষুদ্রশিল্প পুঁজির কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। এসব আলোচনার মধ্যেই চলে এসেছে ‘জবলেস গ্রোথের’ কথা। এবং তা বলছেন ক্ষমতাসীন দলের লোকেরাই। বস্তুত ‘জবলেস গ্রোথ’ এখন সর্বত্রই আলোচনার বিষয়বস্তু। শত হোক উন্নয়ন যদি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না করে তাহলে এই উন্নয়ন দিয়ে কী হবে? উন্নয়ন মানে তো দুই-চারজনের উন্নয়ন নয়। উন্নয়ন মানে এক শতাংশ লোকের হাতে সকল সম্পদ নয়। উন্নয়নের ফসল সকলকে ভোগ করতে হবে। আমাদের সমস্যা এখনও জটিল নয়। তবে সমস্যাটা দৃশ্যমান হচ্ছে। অতএব এখনই সাবধান হতে হবে। দেখা যাচ্ছে গার্মেন্টস খাত আর নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারছে না। অথচ এই খাত বিগত দুই দশকে ৩০-৪০ লাখ মহিলা-পুরুষের চাকরির সুযোগ করেছে। ব্যাংকিং খাতও সরাসরি কোন কর্মসংস্থান করতে পারছে না। শিল্প খাত যে ধীরে ধীরে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে পিছিয়ে পড়ছে তাও এখন স্পষ্ট হচ্ছে। কৃষি খাতে বিনিয়োগ নেই। কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগও সেখানে তৈরি হচ্ছে না। বিদেশে শ্রমিক রফতানি দেখা যাচ্ছে নানা সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে। শ্রমিক আমদানিকারক দেশগুলোতে দেখা যাচ্ছে অর্থনৈতিক স্থবিরতা। এই বাস্তবতায় এখন করণীয় ঠিক করা দরকার। আমার একটা কথা মনে হয় এবং তা বলা দরকার। বড় বড় প্রকল্প হচ্ছে, ব্রিজ হচ্ছে, ওভারপাস হচ্ছে, অর্থনৈতিক জোন হচ্ছে, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে- এসবই দৃশ্যমান এবং বড় প্রয়োজনীয় প্রকল্প। এসবের পাশাপাশি আমাদের ছোট ও মাঝারিদের প্রতি নজর দেয়া দরকার। সরকারী বিভাগ, কর্মকর্তা, পরিকল্পনাকারীদের কিছুটা সময় ব্যয় করা দরকার ছোট ছোট কাজে। বড় কাজের জন্য যদি ছোট ছোট মেরামতি কাজ আড়ালে পড়ে যায় তাহলে তো বিপদ। এই মুহূর্তে দরকার গ্রামীণ অবকাঠামো পুনঃনির্মাণ। গ্রামাঞ্চলের রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ। এগুলো মেরামত করা দরকার জরুরীভিত্তিতে। শহরের রাস্তাঘাটের অবস্থাও খারাপ। কৃষিতে বড় ধরনের বিনিয়োগ দরকার। কৃষি খাতে কিন্তু বরাদ্দ শতকরা হিসাবে কমছে। অথচ কৃষি খাতই এখনও সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থানদাতা। কৃষি খাতে সারা বছর, গ্রামীণ খাতে সারা বছর কাজ থাকলে গ্রামের মানুষ ঢাকায় ছুটে আসত কী? আমার মনে হয় না। শোনা যায় ‘স্টার্ট আপের’ কথা। এর অর্থ কী আমার কাছে স্পষ্ট নয়। দুই-চার লাখ টাকায় যদি ছোট ছোট কাজ করা না যায় তা হলে ‘স্টার্ট আপের’ কথা বলে লাভ কী? অথচ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি এখন দেশে ছোট পুঁজিতে আর কিছুই করা সম্ভব নয়। ‘হাইলি টেকনিক্যাল’ কাজ, আইটির কাজ ঘরে বসে সবাই করবে না। উৎপাদনমূলক, এমনকি সেবামূলক কাজও যদি কেউ করতে চায় তা হলে বেশ বড় পুঁজির দরকার আজকের দিনে। ঢাকা শহরের ব্যবসায়িক অঞ্চলে একটা ছোটখাটো অফিস নেয়া রীতিমতো যুদ্ধের ব্যাপার। দরকার প্রচুর টাকার। এসব পুঁজি ‘স্টার্ট আপ’ ওয়ালারা কোত্থেকে সংগ্রহ করবে? ব্যাংক ‘কোলেটারেল’ ছাড়া কী কোন ঋণ দেবে? অতএব সরকারকে বলব ছোট ছোট উদ্যোগের দিকেও নজর দিতে। এতে পুঁজি কম লাগবে এবং কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাও বেশি। কাগজে দেখলাম ‘প্রাইমারি টেক্সাটাইল’ খাতে নাকি বিনিয়োগের পরিমাণ ৪৮ হাজার কোটি টাকা। গত দুই বছরে বিনিয়োগ হয়েছে আরও ১৩শ’ কোটি টাকা। প্রশ্ন হচ্ছে, এতে কত লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে? এসব হিসাব এখন করা দরকার। উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে যাতে ‘জব’ সৃষ্টি হয় তার দিকে নজর দেয়া দরকার। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×