ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আকিল জামান ইনু

লিওনার্ড কোহেন ॥ গায়ক-কবি

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

লিওনার্ড কোহেন ॥ গায়ক-কবি

২১ সেপ্টেম্বর ছিল লিওনার্ড কোহেনের মৃত্যু পরবর্তী প্রথম জন্মদিন। কৈশোরে যার মনোজগতে শেকড় গেঁড়েছিল স্প্যানিশ কবি- গার্সিয়া লোরকা। সেই থেকে বিচরণ নিঃসঙ্গ, ছায়াচ্ছন্ন, মায়াময় পরাবাস্তবতায়। আবার সে ভুবন থেকে বেরিয়ে এসে পা রেখেছেন নির্মম বাস্তবে, অন্য সব মহৎ লেখক, শিল্পীর মতোই। ছিল আত্মজিজ্ঞাসা। পথ খুঁজেছেন নিজে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে ভাবতে শিখিয়েছেন। অদ্ভুত আঁধার থেকে উঠে আসা তার গান আমাদের বিহ্বল করে। তার রচনা আমাদের সামনে উন্মোচিত করে ধর্ম, রাজনীতি, নিঃসঙ্গতা, যৌনতা, ব্যক্তিগত সম্পর্ক আর ভালবাসার ভিন্ন এক জগত। জন্ম ২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৪ এক সম্ভ্রান্ত ইহুদী পরিবারে। কানাডার মন্ট্রিলে। পিতা নাথান কোহেন, মা মার্শা ক্লোনিস্কি। সঙ্গীতের প্রতি ভালবাসা মাতৃসূত্রে পাওয়া। তার ভাষায়, ‘মা ছিলেন রাশিয়ান। গান গাইতেন বাড়িজুড়ে, তার গান ও সুরের খেলা আমাকে প্রভাবিত করেছে গভীরভাবে।’ ১৯৪৮-এ ভর্তি হন ওয়েস্টমন্ট হাইস্কুলে সেখানে তার অধ্যয়নের বিষয় ছিল সঙ্গীত ও কবিতা। তার আমূল বদলে যাওয়া এখান থেকেই শুরু। আসক্ত হয়ে পরেন গার্সিয়া লোরকার কবিতায়। মেটাল স্ট্রিং এ্যাকুয়াস্টিক গিটারের স্থান দখল করে ক্লাসিকাল গিটার। গিটার শেখেন এক স্প্যানিশ ফ্ল্যামেনকো গিটার বাদকের কাছে। গঠন করেন তার প্রথম কান্ট্রি ফোক ব্র্যান্ড বাকস্কিন বয়েজ। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লেট আস কম্পেয়ার মাইথোলজিস’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৬ তে। তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ১৯৬১তে- ’দি আইস বক্স অফ আর্থ।’ আর্থিক সাফল্য না এলেও গ্রন্থটি তাকে সাহায্য করে কানাডার মূল ধারার সাহিত্যে জায়গা করে নিতে। ১৯৬৪তে প্রকাশ পায় ‘ফ্লাওয়ার্স ফর হিটলার।’ এরপর ক্রমাগত লিখে গেছেন গান ও কবিতা। সর্বশেষ প্রকাশনা ২০১১তে অমনিবাস- পয়েমস এ্যান্ড সংস। উপন্যাস রচনা করেছেন দুটি ১৯৬৩তে প্রকাশিত ‘দি ফেভারেট গেম’ এবং ১৯৬৬তে ‘বিউটিফুল লুসারস।’ দ্বিতীয় উপন্যাসটি পরবর্তীতে সারাবিশ্বে তিন মিলিয়নের বেশি বিক্রি হলেও প্রাথমিক আর্থিক সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। তিনি সঙ্গীত রচনায় ভাগ্য পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেন অতঃপর নিউইয়র্ক গমন। অন্তরে বাউল এই মানুষটি ভালবাসার টানে অন্তর বাজিয়েছেন বার বার। প্রথম প্রেম মারিয়ানে ইলেন যাকে নিয়ে তার অমর সৃষ্টি-সো লং মারিয়ানে। জুলাই ২০১৬তে মারিয়ানের ফিউনারেল এ তার লেখা যে বার্তাটি পড়া হয় তা এমন, ‘আমাদের শরীর ভেঙে পরছে। ধারণা করি খুব শীঘ্রই আমিও তোমাকে অনুসরণ করতে যাচ্ছি। তুমি জান আমি তোমার কত কাছে, হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবে আমায়।’ নিজের মৃত্যুর চার মাস আগে লিখা এ বার্তা! সত্তরের দশকে সম্পর্কে জড়ান লস এঞ্জেলসের শিল্পী সুজানা ইর্লডের সঙ্গে। যিনি তাকে দুটি সন্তান উপহার দেন। মেয়ের নাম রাখেন প্রিয় কবির নামে লোরকা। ইলর্ডের পর তিনি সম্পর্কে জড়ান ফরাসী চিত্রগ্রাহক ডমিনিক ইসারম্যান, ফরাসী অভিনেত্রী রেবেকা ডি মরনির সঙ্গে। এর বাইরেও ভালবাসার তরী ভিড়িয়েছেন অসংখ্য বন্দরে, কিন্তু বিয়ে নামক নোঙর ফেলা হয়নি কোথাও। ছিলেন চিরকুমার। কোহেনের সঙ্গীত জীবনের লক্ষণীয় দিক হলো তিনি সমসাময়িক শিল্পীদের চেয়ে একটু বেশি বয়সে ক্যারিয়ার শুরু করেন। আর সঙ্গীত চার্ট তাকে সেভাবে প্রতিফলিত করেনি কখনই। তার গান প্রথমে জনপ্রিয়তা পেয়েছে অন্যদের কণ্ঠে যেমন ‘সুজানে’, ‘হ্যালেলুইজা’ যা তারপর উঠে এসেছে তার কণ্ঠে। তিনি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন ধীরে, সেই সঙ্গে নিজের আসন শক্ত করেছেন সঙ্গীত ভুবনে। নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, বব ডিলানের পরে সঙ্গীত ভুবনকে তার মতো আর কেউ প্রভাবিত করেনি। তার রচিত সঙ্গীতের তালিকাটি বিশাল- সুজানে, হ্যালেলুইজা, ডেমোক্র্যাসি, টাওয়ার অফ সংস, এভরিবডি নো’স, এঞ্জেলস আইস, লাভার লাভার লাভার, ফেমাস ব্লু রেইনকোট, আই এ্যাম ইয়োর ম্যান এমন অসংখ্য অমর গানের রচয়িতা ও গায়ক তিনি। হ্যালেলুইজা গানটি সম্পূর্ণ করতে তিনি সময় নিয়েছেন ৫ বছর। নিউইয়র্ক টাইমস এ জেনেট ম্যাসলিন এই গানটি নিয়ে লিখেন, ‘এটি সম্ভবত মার্কিন সঙ্গীত ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গীত গান।’ একই সঙ্গে সঙ্গীত সংশ্লিষ্ট মহলকে প্রভাবিত করায় নিউইয়র্ক টাইমস তাকে ঠাঁই দিয়েছে বব ডিলনের উপরে। সর্বশেষ ১৪তম এ্যালবামটি রিলিজ পায় গত ২১ অক্টোবর। অদ্ভুত আঁধার থেকে উঠে আসা বিষণœ ভারি কণ্ঠে রানিংবেস আর সিøয়ার্সের সমন্বয়ে তিনি গেয়ে ওঠেন ‘ইউ ওয়ান্ট ইট ডার্কার’ যা তার এ্যালবামের শিরোনামও। লিওনার্ড কোহেন বেঁচে থাকবেন তাঁর গানে ও কবিতায়।
×