ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাজধানীতে ‘সম্পদে নারীর অভিগম্যতা’ শীর্ষক কর্মশালা

ভূমি, কৃষিসহ সকল সম্পদে নারীর সমঅধিকার দাবি

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ভূমি, কৃষিসহ সকল সম্পদে নারীর সমঅধিকার দাবি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশের মোট শ্রম শক্তির প্রায় ৪৮ শতাংশ কৃষি খাতে নিযুক্ত। কালের বিবর্তনে কৃষিতে নতুন নতুন প্রযুক্তি আসায় কাজের ধরনের যেমন পরিবর্তন এসেছে, তেমনি নারী-পুরুষের কাজেরও পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে প্রেক্ষাপটে একদিকে যেমন কৃষি খাতে পুরুষের সরাসরি সম্পৃক্ততার আনুপাতিক হার কমছে, অন্যদিকে বাড়ছে কৃষিতে নারীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ কিন্তু নারীর ভূমি মালিকানা ও অন্যান্য সম্পদে অভিগম্যতার প্রশ্নে বৈষম্য বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৯.৪ শতাংশ নারী, অথচ, ভূমিতে গ্রামীণ নারীর কার্যকর মালিকানা মাত্র ২-৪ শতাংশ। কৃষিতে নারীর সকল প্রতিবন্ধকতার মূলে রয়েছে ভূমিতে সীমিত প্রবেশাধিকার। ভূমিতে নারীর প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাসমূহ যেমন নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ, সামাজিক উন্নয়ন ইত্যাদি কোন লক্ষ্যমাত্রাই অর্জন সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কৃষিতে নারীর কার্যকর অংশগ্রহণ, নারীর ভূমি মালিকানা, নারী কৃষকের স্বীকৃতি ও নারী সমবায় গঠনের লক্ষ্যে এএলআরডি এবং সাংগাতের যৌথ উদ্যোগে বুধবার সকাল দশটায় রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘সম্পদে নারীর অভিগম্যতা’ শীর্ষক জাতীয় কর্মশালায় কৃষিতে নারীর বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার চিত্র উঠে আসে। কর্মশালায় নারীর ভূমি ও অন্যান্য সম্পদে প্রবেশাধিকার বিষয়ক একটি পর্যবেক্ষণপত্র উপস্থাপন করেন এএলআরডির উপ-নির্বাহী পরিচালক রওশন জাহান মনি। কৃষি কাজে নারীর অংশগ্রহণ এবং ক্রমবর্ধমান অন্তর্ভুক্তি, সম্ভাবনা, প্রতিবন্ধকতা, ভূমিতে এবং বাজার ব্যবস্থায় নারীর প্রবেশাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে এএলআরডি সহযোগী সংস্থার সহায়তায় মাঠপর্যায়ের বাস্তব চিত্র পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করছে। এই কাজের অংশ হিসেবে এএলআরডি তার সহযোগী সংস্থা বেনিফিশিয়ারিজ ফ্রেন্ডশিপ ফোরাম (বিএফএফ) ফরিদপুর, পটুয়াখালী ও রাজশাহীর চারটি উপজেলায় ২১ ও ২৮ আগস্ট এবং ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ‘নারীর ভূমি অধিকার’ বিষয়ে তৃণমূল পর্যায়ে চারটি মতবিনিময় সভার মাধ্যমে দরিদ্র, প্রান্তিক ও আদিবাসী নারী কৃষকদের বিভিন্ন সমস্যার কথা জানা হয়। চারটি এলাকায় আলোচনায় ৮৪ অংশগ্রহণকারীর ১০০ শতাংশ নারী-পুরুষ ‘খাসজমি’ বলতে যে ‘সরকারী জমি’ বলে তারা তা জানেন। অন্যদিকে, ৮০ ভাগ অংশগ্রহণকারীই খাসজমি কিভাবে পায়, কারা পায় এবং দলিল কার কার নামে হয় তা তাদের জানা নেই। বাকি ২০ ভাগ নারী খাসজমি পাওয়ার পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে জানেন না। মোট অংশগ্রহণকারী ৮৪ জনের মধ্যে ১১ নারী যৌথ নামে খাসজমি পেয়েছেন। অনেকেই আবার খাসজমি পাওয়ার জন্য এ পর্যন্ত কখনও আবেদনই করেননি। আদিবাসী রাখাইনরা একাধিকবার দরখাস্ত করেও খাসজমি পাননি। পরের বার খাসজমি দেয়ার আশ^াস দিয়ে তাদের ফিরিয়ে দিয়েছেন ভূমি অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। অন্যদিকে, দশমিনায় ৩ নারী যৌথমালিকানায় খাসজমি পেয়েছেন চর এলাকায়। ফলে, তারা সেখানে নিজেরা গিয়ে চাষাবাদ করতে পারছেন না। দুইজন বিধবা নারী খাসজমির জন্য দরখাস্ত করেছেন চার বছর আগে। কিন্তু এখনও পাননি। নারী খাদ্য উৎপাদনে, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে, পরিবারের আয় বর্ধনে, খাদ্য ও পুষ্টি সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও আমরা সার্বিক পর্যবেক্ষণে দেখতে পাই নারীর না রয়েছে কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি না আছে ভূমির মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণ। একজন নারী তিনভাবে ভূমির মালিক হতে পারে বললেন অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কয়েকজন। প্রথমত, বাবার বাড়ির জমি পেয়ে, দ্বিতীয়ত, স্বামীর সম্পত্তির অংশ পেয়ে এবং তৃতীয়ত, ক্রয়সূত্রে বা দানসূত্রে। পিতার মৃত্যুর পর সম্পত্তির ভাগ পায় সন্তান এ বিষয়টি সম্পর্কে অংশগ্রহণকারীরা জানলেও আইনী পরিভাষা ‘উত্তরাধিকার’ শব্দটির সঙ্গে তেমন একটা পরিচিত নন তারা। অনেকে ‘বাপের বাড়ির সম্পত্তি’ আবার কেউ কেউ ‘দৌহত্রী সম্পত্তি’ বলে থাকেন। দৌহিত্র সম্পত্তির ভাগ নেয়ার বিষয়টি কেউ ভাল চোখে দেখেন না। তারা মনে করেন, দৌহিত্র সম্পত্তির দাবি করলে ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হবে। তবে, অনেকে বাপের বাড়ির সম্পত্তিকে ভবিষ্যতের সঞ্চয় বলে মনে করেন। অন্যদিকে, সনাতন ধর্ম পালনকারী হিন্দু এবং আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের নারীরা পিতা বা স্বামীর সম্পত্তিতে কোন ভাগ পায় না। অন্যদিকে, রাখাইন আদিবাসী নারীরা তাদের প্রথাগত নিয়ম অনুযায়ী, উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পেয়ে থাকেন। উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সম্পত্তি বিভাজনের নিয়ম সঠিক নিয়ম নয় বলে দাবি জানান অংশগ্রহণকারীরা। এটা সমান হওয়া দরকার এবং সরকার চাইলে এ আইনটি পরিবর্তন করতে পারেন বলে মন্তব্য করেন নারী কৃষকরা। কর্মশালায় প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রিইবের নির্বাহী পরিচালক মেঘনাগুহ ঠাকুরতা। তিনি বলেন, ‘কৃষিতে বর্তমানে নারী কৃষকদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু মজুরি বৈষম্যসহ সম্পদে নারী প্রবেশাধিকারে বাধা রয়েই গেছে। এ সমস্যা সমাধানে খাসজমি নীতিমালায় শর্তহীনভাবে (সক্ষম পুত্রসন্তানসহ) নারীপ্রধান খানার একক নামে খাসজমি বরাদ্দ দিতে হবে। সেই সঙ্গে কৃষি কার্ড বিতরণের জন্য কৃষক বাছাইয়ের প্রক্রিয়ায় ইউনিয়ন পর্যায়ে গঠিত কমিটিতে নারী কৃষককে অন্তর্ভুক্ত করা; তৃণমূল পর্যায়ে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ডের উপকারিতা সম্পর্কে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি করতে হবে।’ সভাপতির বক্তব্যে মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির কৃষিঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘সাধারণত নারী কৃষকরা এলাকার মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকেন। আবার অনেকে এনজিও থেকে ঋণ নেন। কিভাবে ঋণ পেতে হয় বা ঋণ পাওয়ার জন্য কি করতে হয় সে সম্পর্কেও তারা কেউ কিছু জানেন না। সেই সঙ্গে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ এবং অবদান উল্লেখযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও ভূমিহীনতা নারীকে প্রান্তিক অবস্থায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। তাই নারীর ভূমি অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারকে অনতিবিলম্বে স্বল্প, মধ্যম, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।’ কর্মশালায় উপস্থিতরা এ সময় বেশকিছু সুপারিশ দাবি করেনÑ নারী কৃষি শ্রমিকদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে; বাজার ব্যবস্থায় গ্রামীণ নারীর অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে যথাযথ সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগ গ্রহণ এবং নারীবান্ধব বাজার ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশের উন্নয়ন করা; নারীর গৃহস্থালি কাজ/অনুৎপাদনশীল কাজকে অর্থনৈতিক মূল্যায়নে নিয়ে আসা এবং মর্যাদায় সমতা প্রতিষ্ঠা। সকল রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে এবং অন্যান্য কার্যসূচীতে ভূমি, কৃষিসহ সকল সম্পদে নারীর সমঅধিকারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা এবং বাস্তবায়নের জন্য কর্মসূচী গ্রহণ ও জবাবদিহিতা তৈরি করা; স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ভূমি ও কৃষি উন্নয়নে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল কৃষকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা; খাসজমিতে, জলাভূমিতে নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করা প্রভৃতি। কর্মশালায় আরও উপস্থিত ছিলেনÑ এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, বিআইজিডির জেন্ডার স্টাডিজ ক্লাস্টারের হেড সিমিন মাহমুদ, সাংগাত কোর গ্রুপের সদস্য ফওজিয়া খোন্দকার ইভা প্রমুখ।
×