ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

তিনদিনে বাংলাদেশে এসেছে ৩৫ সহস্রাধিক

এখনও জ্বলছে রাখাইন ॥ রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধন ও বিতাড়ন কোনভাবেই থামছে না

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

এখনও জ্বলছে রাখাইন ॥ রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধন ও বিতাড়ন কোনভাবেই থামছে না

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ অব্যাহত রয়েছে। সেখানকার জান্তা বাহিনী ক্ষমার অযোগ্য বর্বরতা চালিয়েই যাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান অলৌকিকভাবে সমাধানের কোন পথ বেরিয়ে না আসলে পুরো রাখাইন রাজ্য রোহিঙ্গা শূন্য হতে আর খুব বেশি সময় নেবে না। সামরিক অভিযানে চলমান বর্বরতায় বাংলাদেশে এখনও অনুপ্রবেশ ঘটে চলেছে রোহিঙ্গাদের। বুধবার পর্যন্ত গত তিনদিনে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেছে ৩৫ সহস্রাধিক। মঙ্গলবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এসেছে নতুন ১৫ হাজার। এর আগের দু’দিনে এসেছে ২০ সহস্রাধিক। ফলে বেসরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে আশ্রিত রোিহঙ্গার সংখ্যা ৬ লাখে উন্নীত হয়েছে। তবে জাতিসংঘের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে এ সংখ্যা ৪ লাখ ৮০ হাজারেরও বেশি দাবি করা হয়েছে। সামরিক অভিযানের মাধ্যমে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গণহত্যা শুরু হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে এ বর্বরতা বন্ধের আওয়াজ উঠলেও সামরিক জান্তা নিয়ন্ত্রিত সুচি সরকার এতে কোন তোয়াক্কাই করছে না। মানবিকতার কারণে বাংলাদেশ অঘোষিতভাবে সীমান্ত উন্মুক্ত রেখেছে অসহায় রোহিঙ্গাদের জন্য। ইতোমধ্যে আশ্রয় লাভকারী রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ সহায়তা ও চিকিৎসা সেবাও শুরু করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে-এর পর কি? রোহিঙ্গা সঙ্কট যে দীর্ঘস্থায়ী হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। সব মিলিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুটি বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতে বড় ধরনের অশনি সঙ্কেত হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞদের অনেকে। এদিকে গুটি কয়েক দেশ বাদে সারা বিশ্ব যখন এ ইস্যুতে সোচ্চার হয়েছে, তখন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের অনুরোধে আজ বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে। এর আগে নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষ থেকে অনানুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়া হয়েছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে। এবার কি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি আসবেÑ এ আশা নিয়ে বাংলাদেশসহ শান্তিকামী সকল দেশের উদ্বিগ্ন মহলগুলোতে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। বাংলাদেশে আশ্রিত এবং রাখাইন রাজ্যে এখনও থেকে যাওয়া রোহিঙ্গারা রয়েছে অজানা শঙ্কায়। আবার অনেকে আশায় বুকও বেঁধেছে। কেননা, সবকিছু ফেলে এসে অনেকেই স্বভূমে ফিরে যেতেও অপেক্ষার প্রহর গুনছে। আর যারা সর্বস্বান্ত হয়েছে বাড়িঘর পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে, জমিজমা দখল করেছে মগ সন্ত্রাসীরা তাদের অনেকেই রয়েছে দোটানায়। আবার অনেকে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছাকে বিসর্জন দিয়েছে। যেভাবেই হোক রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশ এদেশে থেকে যেতে ইচ্ছুক। বাংলাদেশ তাদের প্রতি মানবতার যে হাত সম্প্রসারণ করে রেখেছে তাতে তারা ন্যূনতম পক্ষে প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছে। সর্বশেষ পরিস্থিতি মিয়ানমারের বুচিদং মিনগিছিতে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনা বাহিনীর সদস্যরা এখনও বর্বরতা অব্যাহত রাখায় দলে দলে ওরা পালিয়ে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করছে বাংলাদেশে। বুধবার ভোরেও মংডুর কাউয়ারবিল এলাকার দওরাবিলের স্কুলের পেছনে আশ্রয়ের জন্য ছুটে আসা রোহিঙ্গাদের পথরোধ করে মিয়ানমার সেনা সদস্যরা ব্যাপক নির্যাতন চালিয়েছে। এ ঘটনায় প্রায় পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা দেশটির মায়ু পর্বতের গীরিপথ ধরে মংডু সীমান্তে প্রবেশ করার সময় কাউয়ারবিল এলাকায় সেনা বাহিনী ও রাখাইন সন্ত্রাসীরা তাদের ওপর হামলে পড়ে। গত শুক্রবার থেকে মিনগিছিতে সেনা অভিযান শুরু হলে বুচিদং শহরতলীর উত্তর-পশ্চিমের থাইম্ম্যাখালী, কেপ্রুদং, লাবাদক ও নয়াপাড়া এলাকার রোহিঙ্গারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সিদ্ধান্ত নেয়। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রওনা দেয় প্রায় পাঁচ হাজার রোহিঙ্গার বিরাট একটি দল। মায়ু পর্বতের গিরিমুখে স্থানীয় রাখাইন সন্ত্রাসীরা তাদের ঘেরাও করে মোবাইল ফোন, নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কারসহ সবকিছু কেড়ে নেয়। এরপর অসহায় রোহিঙ্গারা রাতের আঁধারে প্রায় ১৩ কিলোমিটার গিরিপথ পাড়ি দিয়ে মংডু সীমান্তে পৌঁছে। ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে, রাখাইন সন্ত্রাসীদের ঘেরাও কবলে পড়ে এসব রোহিঙ্গাদের মাঝে বিপর্যয় নেমে এসেছে। বুধবার ভোরে মংডুর কাওয়ারবিল এলাকার দওরাবিলের স্কুলের পিছনে তাদের পথরোধ করে সেনা সদস্যরা। রোহিঙ্গা পুরুষ ও নারীদের আলাদা আলাদা করে হাত উপুর করে বসিয়ে রাখা হয়েছে। এ সময় নারী ও শিশুদের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে সেখানকার বাতাস। গত দু’দিনে নতুন করে ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। সেনা তৎপরতার সুফল পাচ্ছে রোহিঙ্গারা রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তায় সেনা বাহিনী মোতায়েনের পর শৃঙ্খলা আনয়ন, ত্রাণ তৎপরতা ও আশ্রয়ের ক্ষেত্রে দ্রুত সুফল আসছে। উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিতরণে সেনা বাহিনীর তৎপরতা শুরু না হলে পরিস্থিতির কি অবনতি হত তা চিন্তাও করা যায় না। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সরকারী কর্মকর্তা, এনজিও, দেশী-বিদেশী দাতা সংস্থা ও বিভিন্ন সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকরা দিবারাত রোহিঙ্গাদের জন্য সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। নাইক্ষ্যংছড়ি পরিস্থিতি সীমান্তের ওপার থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে। এসব রোহিঙ্গাদের এখনও উখিয়ার কুতুপালংয়ে পুরোপুরি সরিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। উখিয়া থেকে বহু রোহিঙ্গা বান্দরবানের বহু এলাকায় ছড়িয়ে গেছে। আবার অনেককে উদ্ধার করে কুতুপালং ক্যাম্পে প্রেরণ করা হয়েছে। জিরো পয়েন্ট পরিস্থিতি দুদেশের সীমান্তের জিরো পয়েন্টে এখনও হাজার হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। বিশেষ করে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে রয়েছে হাজার হাজার। এদের মাঝে নানা শঙ্কা বিরাজ করছে। আবার অনেকে সীমান্ত পেরিয়ে এপারে চলেও আসছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে এদের সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। শাহপরীরদ্বীপ উপকূল দিয়েই আসছে বেশি বর্তমানে টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ উপকূলে সাগর পথেই দলে দলে রোহিঙ্গারা আসছে। ছোট বড় বিভিন্ন নৌযানে করে এরা উত্তাল ঢেউ উপেক্ষা করে প্রাণ হাতে নিয়ে বাংলাদেশমুখী হচ্ছে। অনুপ্রবেশে যেহেতু বর্তমানে কোন বাধা নেই, সেহেতু ওরা প্রাণ রক্ষায় এপারে চলে আসছে। স্থলসীমান্তে একদিকে মাইন স্থাপন করে রাখা, অপরদিকে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কড়া টহল বলবৎ থাকায় বর্তমানে সাগর দিয়েই রোহিঙ্গারা বেশি আসছে। ফের মাইন বিস্ফোরণে এক রোহিঙ্গা নিহত বাংলাদেশ-মিয়ানমার চাকঢালা সীমান্তে ৪৩নং পিলারের কাছে মিয়ানমার অভ্যন্তরে ফের মাইন বিস্ফোরণের ঘটনায় এক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। নিহত রোহিঙ্গা দেশটির বলিবাজারের পুরান মাইজ্জা পাড়ার বাসিন্দা মোহাচ্ছের আলীর পুত্র মোঃ নূর আলম। মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর সীমান্তের ৪৩নং পিলারের কাছে এ ঘটনা ঘটে। রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন কার্যক্রমে ব্যাপক সাড়া উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নতুন আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন কার্যক্রমে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা ইতোপূর্বে নিবন্ধন সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা না থাকলেও বর্তমানে এ কার্যক্রমে তারা ব্যাপকভাবে এগিয়ে আসছে। নিবন্ধনে নিয়োজিত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিবন্ধনের আওতায় আসা সব রোহিঙ্গা সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবে। তা নিশ্চিত হওয়ার পর সাড়া পড়েছে বলে তাদের ধারণা। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁডিয়ে রোহিঙ্গারা নিজেদের নাম বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন করছে। এ প্রক্রিয়ায় বুধবার পর্যন্ত ২০ সহস্রাধিক রোহিঙ্গার নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে বলে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে দায়িত্বরত সেনা কর্মকর্তা লে. কর্নেল মাহবুবুর রহমান জািনয়েছেন। এর পাশাপাশি উখিয়া ও টেকনাফের অনুরূপ নিবন্ধন কার্যক্রমে ৫০টি বুথে কাজ চলছে। রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা সেবা টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য সেবায় ১৬টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে। টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ সুমন বড়ুয়া জানান, উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্প এবং গ্রামের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়া রোহিঙ্গারা প্রয়োজনের তুলনায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে। ইতোপূর্বে রোহিঙ্গাদের মাঝে ডায়রিয়াসহ নানা পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার যে আগাম বার্তা দেয়া হয়েছিল সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি এখনও অনুকূলে রয়েছে। চার দালালের সাজা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অবরুদ্ধ করে টাকা আদায়ের অভিযোগে র্যাবের হাতে আটক ৪ জনকে ৬ মাস করে বিনাশ্রম কারাদ- দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ একটি আদালত। কক্সবাজারের টেকনাফ মগপাড়া এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়। নাফ নদীতে মাছ ধরতে দেয়ার দাবি টেকনাফের জেলেরা এবার নাফনদীতে মাছ ধরতে দেয়ার দাবি জানিয়েছে। জেলেরা জানান, মাছ ধরা বন্ধ থাকায় শত শত জেলে মানবেতর জীবন যাপন ছাড়াও অনেক পরিবারের স্কুল পড়ুয়া সন্তানরা আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে। অবিলম্বে নাফ নদীতে মাছ ধরার অনুমতি দিয়ে সীমান্তের জেলে পরিবারগুলোর জীবন জীবিকার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি জানান জেলে নেতারা।
×