ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পরেশ দাসের হস্তশিল্প

বেত ও বাঁশের নৌকা পালকি, রিক্সা- দাম নাগালের মধ্যেই

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বেত ও বাঁশের নৌকা পালকি, রিক্সা- দাম নাগালের মধ্যেই

মোঃ খলিলুর রহমান ॥ বেত ও বাঁশ গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য। বেত ও বাঁশ দিয়ে নিপুণ হাতে বানানো হয় নৌকা, পালকি, ফুলের ঝুড়ি, ভ্যান গাড়ি ও রিক্সাসহ নানান ধরনের শোপিস। যা এখন শোভা পাচ্ছে সৌখিন পরিবারের বাসাবাড়িতেও। গ্রাম-গঞ্জের ঐতিহ্যবাহী বেত ও বাঁশ দিয়ে নানান ধরনের শোপিস বানিয়ে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও পৌরসভার বাগমুসা গ্রামের শ্রী পরেশ চন্দ্র দাস বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন। বেশ খ্যাতিও রয়েছে তার। তিনি ৫০ বছর ধরে এ হস্তশিল্প তৈরির কাজে যুক্ত রয়েছেন। পরেশ চন্দ্র দাস শোপিস হিসেবে আরও বানাচ্ছেন সিএনজি গাড়ি, ট্রাক, ল্যাম্পের ঝাড়, ওয়ালসেল, কর্নারসেল, বেতের সাজি ও ফুলের সাজিও। তিনি শুধু শোপিসই নয় কাচের ফ্রেম, ট্রে, সোফা, চেয়ার টেবিল ও ধান-চাল মাপার পাত্রসহ প্রায় শতাধিক আইটেমের আসবাবপত্র তৈরি করছেন। বিক্রি করছেন সোনারগাঁয়ের বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে ছুটে আসা বিনোদন প্রিয়াসী নারী-পুরুষদের কাছে। পরেশ চন্দ্র দাস নিজের শো-রুমে বসেও বেত ও বাঁশ দিয়ে এসব জিনিসপত্র তৈরি করে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এছাড়াও বাসায় বসেও তিনি এগুলো তৈরি করছেন। রাজধানী ঢাকাসহ দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসা দর্শনার্থীদের মন কাড়ে পরেশ চন্দ্র দাসের বিভিন্ন শোপিস। পরেশ চন্দ্র দাসের বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই। ১৬-১৭ বছর বয়স থেকেই ঝুঁকে পড়ে বেত ও বাঁশ দিয়ে শোপিস ও জিনিসপত্র তৈরির কাজে। নিপুণ হাতে তৈরি ফুলের ঝুড়ি ১০০-২০০ টাকায়, পালকি- ১৫০-২৫০ টাকায়, রিক্সা ১৬০-২০০ টাকায়, ভ্যান গাড়ি ১৫০-১৬০ টাকায়, নৌকা- ২০০০ টাকায়, বেতের সোফা ১৮-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়। পরেশ চন্দ্র দাস বলেন, বেত দিয়ে বানানো একটি নৌকা সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে উপহার দিয়েছেন। তিনি খুশি হয়ে তাকে দুই টাকা বখশিশও দিয়েছেন। এছাড়াও তিনি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরকেও বেতের তৈরি নৌকা উপহার দিয়েছেন। একটি নৌকা তৈরি করতে ৬-৭ দিন সময় লাগে। কারণ নৌকা বানাতে বেত চিকন করে কাটতে হয়। খুবই ধৈর্যের প্রয়োজন। তিনি জানান, বছরের প্রতিদিনই বেশ ও বাঁশের তৈরি শোপিস ও আসবাবপত্র বিক্রি হয়। তবে যখন সোনারগাঁও জাদুঘরে লোকজ মেলা হয় তখন বেচা-বিক্রি বেড়ে যায়। তখন এসব শোপিস তৈরির ধুম পড়ে যায়। এসব জিনিসপত্র তৈরি করতে বেত, বাঁশ, তাঁরকাটা ও বাঁশের খিল প্রয়োজন হয়। এগুলো তৈরি শেষে বার্নিশ করতে হয়। বার্নিশ করলে তৈরি শোপিস কিংবা আসবাবপত্র জ্বল জ্বল করতে দেখা যায়। দেখতেও সুন্দর ও মসৃণ। বেত ও বাঁশের তৈরির শোপিস কিংবা আসবাবপত্র নি¤œ মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে ধনী শ্রেণীর লোকজনের কাছেও কদর রয়েছে। বিশেষ করে এ ধরনে শোপিস জাদুঘরে ঘুরতে আসা নারী দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে সব চেয়ে বেশি। তিনি জানান, বেত ও বাঁশ ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মাদারীপুর ও শরীয়তপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে কিনে আনতে হয়। তবে এখন পাইকারাও বেশ ও বাঁশ সরবরাহ করে থাকেন। আবাদ কমে যাওয়ায় বেতের দামও দিন দিন বাড়ছে। বেতের আবাদ আরও বাড়ানো দরকার বলে তিনি জানান। বেতের তৈরি শোপিস কিংবা আসবাবপত্র ঘুণ পোকায় ধরার ভয় থাকে না। পরেশ চন্দ্র দাসের তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। স্ত্রী মারা গেছে দুই বছর আগে। টাকার অভাবে লেখাপড়া করতে পারেননি। ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। তবে মেয়ে শিউলিকে এমএ পাস করিয়েছেন। সে এখন একটি প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করছে। পরেশ চন্দ্রের তিন ছেলে রাজ কুমার, স্বপন কুমার দাস ও মাধবও একই কাজের সঙ্গে জড়িত। পরেশ চন্দ্রের বাড়িতেই শোপিস ও আসবাবপত্রে তৈরির কারখানাও রয়েছে। এ কারখানা থেকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এসে তৈরি শোপিস কিংবা আসবাবপত্র কিনে নিয়ে যায়। পরেশ চন্দ্র দাস এখন শুধু বাত ও বাঁশ দিয়ে শোপিসসহ জিনিসপত্রই তৈরি করছেন না, দিচ্ছেন হস্তশিল্পের ওপর নানান ধরণের প্রশিক্ষণও। তিনি বহু নারী-পুরুষকে হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুলেছেন। বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর লোকজ মেলা আসলে তাকে এককালীন ৩০ হাজার টাকা অনুদানও দেন। বিনা ভাড়ায় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ হস্তশিল্পের শোপিস করে দিয়েছেন। তিনি এ ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছেন। তিনি আজীবন এ হস্তশিল্পের পেশায় ডুবে থাকতে চান।
×