ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

বাঙালীর চেয়েও বাঙালী

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বাঙালীর চেয়েও বাঙালী

১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির গৌরবমাখা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শেখ লুৎফর রহমান ও সাবেরা খাতুনের দৌহিত্রী এবং শেখ মুজিবুর রহমান ও ফজিলাতুন্নেছার প্রথম সন্তান হিসেবে যেদিন তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেদিন কে জানত যে- শেখ হাসিনার ললাটে বাংলা ও বাঙালীর দুঃখ-কষ্ট ঘোচাবার দায় লেখা রয়েছে। দীপ্ত মুখ, শরতের শিউলি ফুলের মতো অমলিন হাসি (শরতে জন্মছিলেন বলেই বোধহয়) এবং উজ্জ্বল চোখের শিশুটিকে দেখে কেউ কি সেদিন ভেবেছিল যে, একদিন তিনিই হবেন বাংলাদেশের বাঙালীর ও বাংলা ভাষার রক্ষাকবচ। শৈশবের বেশ কটি বছর কেটেছে বাংলার ধুলোমাটি, জলবাতাস, প্রকৃতি আর ফুলপাখির নিবিড় সান্নিধ্যে। বাইগার এবং মধুমতির সুশীতল জলের মাঝিদের সঙ্গে পরিচয় সেই সময়েই। আর অতি সাধারণ সারল্যেভরা মুক্তমনের মানুষ, যাদের কাছে শেখ হাসিনা পেয়েছিলেন উদারতা, মানবতা, সহমর্মিতা এবং জীবন সংগ্রামে অটল থাকার প্রথম পাঠ। টলটলে নদীর জলে নানা রঙের পাল তুলে ভেসে বেড়ানো অজস্র ‘টাবুরা নাও’-এর স্মৃতি নিশ্চয় তাঁকে নস্টালজিক করে। কী অদ্ভুত! আওয়ামী লীগের নৌকার হাল এখন তাঁরই হাতে। শেখ হাসিনা আজ বাঙালীর প্রতিটি ঘরের নেত্রী। সাধারণ এবং অসাধারণজনের অতি কাছের মানুষ। যাঁর হৃদয়জুড়ে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষ। তাঁর চোখ ‘কথা বলে চলে, যেন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল।’ তিনি পিতা বঙ্গবন্ধুর মতই একজন খাঁটি বাঙালী যে। পঁচাত্তরের মধ্য আগস্টে দৈবক্রমে বেঁচে যাবার পর একাশি-পরবর্তী সময়ে কতবার যে তাঁর জীবনের ওপর আঘাত এসেছে। প্রত্যেকটির পেছনেই ছিল তাঁর জীবননাশের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। কারণ একটাই। তাঁকে সরিয়ে দিতে পারলেই তো বাঙালীর শাশ্বত দর্শনের প্রাণভোমরা নিষ্পন্দ, নিষ্প্রাণ। তিনি না থাকা মানেই তো হাজার বছরের শুভবাদী জাতিসত্তার পরিচয় মুছে দিয়ে আবার সেই মৌলবাদ, আবার ধর্মান্ধতা, আবার গণতন্ত্রহীনতা। শেখ হাসিনাকে সরিয়ে দিতে পারলে ভূতের পায়ে হেঁটে হেঁটে কেবলই পেছনে চলা। মুক্তিযুদ্ধের সকল অর্জন ধূলিসাৎ হওয়া, আবার পাকিস্তান। তিনি যে বেঁচে থেকে মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিতে পারছেন, পৃথিবীর আলোর স্পর্শ পাচ্ছেন চোখে-মুখে, এটাই আমার কাছে অলৌকিক ব্যাপার বলে মনে হয়। পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টের মসিলিপ্ত যামিনীর নিষ্ঠুরতম রাতে ধানম-ির বত্রিশ নম্বরে তিনিও কি বর্বরোচিত নৃশংসতার টার্গেট হতেন না! মাত্র দিন কয়েক আগে একমাত্র সহোদরা শেখ রেহানা এবং শিশু সন্তান জয় আর পুতুলকে সঙ্গে নিয়ে স্বামীর কর্মস্থল জার্মানিতে না গেল তিনি তো আজ কেবলই ফ্রেমবন্দী ছবি হয়ে যেতেন। তাহলে বাংলাদেশ আর বাঙালী জাতির অবস্থা কেমন হতো! একই অবস্থা তো রেহানা-জয়-পুতুলের ক্ষেত্রেও হতো। নিমগ্ন নিঃসঙ্গতায় এসব অবান্তর সর্বনাশা ভাবনাগুলো যখন আমাকে গ্রাস করে, তখন চমকে উঠি। এক মহাভীতিকর বোধ তখন কেবলই আমাকে আচ্ছন্ন করে। অস্তিত্বহীন অনুভূতির গহ্বরে ডুবতে ডুবতে নিকষ অন্ধকারে বিলীন হতে থাকে আমার ইহজাগতিক অস্তিত্ব। ভাবতেই গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। শেখ হাসিনা বেঁচে গিয়ে আমাদের বাঁচিয়েছেন। আমরা, যারা আবহমন বাংলার শত সহস্র বছরের শাশ্বত দর্শনের উত্তরসূরি। আমরা যারা বায়ান্ন, ছেষট্টি, ঊনসত্তর আর একাত্তরের অহঙ্কার নিয়ে প্রত্যাশার দৃষ্টিসীমার আরও সামনে অনেক দূরে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাই। পৌঁছাতে চাই সমৃদ্ধ বাংলাদেশে। গৌরবের বাঙালী জাতি আর প্রিয় বাংলা ভাষার শিল্পসম্ভার এবং সকল অর্জন নিয়ে। শেখ হাসিনা আছেন বলেই আমাদের এই স্বপ্ন দেখা সম্ভব। স্বপ্নের বাস্তবায়নও আমাদের বিশ্বাস, অসম্ভব নয়। শেখ হাসিনা কি শুধুই একজন বিজ্ঞ রাজনীতিক! শুধুই রাষ্ট্রনায়ক। দেশের প্রাচীনতম এবং সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের প্রধান। এসবের বাইরে আর কোন পরিচয় নেই তাঁর। অবশ্যই আছে। তিনি মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন, সংস্কৃতিমনস্ক একজন সহজিয়া মানুষ। যাকে বলে নিখাঁদ-খাঁটি। প্রাণবন্ত ও রসবোধসম্পন্ন চিরায়ত বাঙালীর প্রতিচ্ছবি তিনি। বই পড়েন এবং লেখেন, গান শোনেন, সিনেমা দেখেন, আড্ডাচ্ছলে হাসি-ঠাট্টাও করেন। প্রিয় পিতার মতই তাঁর অসামান্য জীবনবোধ। হাসতে হাসতে কঠিন ও অমোঘ সত্য অকপটে বলে ফেলার ক্ষমতা তো সকলের থাকে না। সাদা মনের অধিকারীরাই কেবল তা পারেন। বাংলার প্রকৃতির মতই সারল্যমাখা শেখ হাসনার ব্যক্তিজীবন। স্নিগ্ধ রূপ, মিষ্টি হাসি, বসনে-ভূষণে সেই চিরায়ত ভগ্নীরূপ। যেন পাশের বাড়ির আগ্রহ প্রিয় সহোদরা। সামান্য দুষ্টুমি করলে কপট চোখ রাঙাবে আবার হাতে গুঁজে দেবে মিষ্টি চকলেট। আপন ভুবনে তিনি বাঙালীর চেয়েও বাঙালী। বাংলার মাটিলগ্ন চিরায়ত সংস্কৃতির যথার্থ উত্তরসূরি শেখ হাসিনা ইচ্ছা করলেই জনবিমুখ হতে পারেন না। বাড়িভর্তি, উঠোনভর্তি কিংবা চৌহদ্দির বাইরের যারা তারাও তাঁর আপন। এই মহৎগুণটি সম্ভবত তিনি পেয়েছেন দেবতাতুল্য মাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছ থেকে এবং সেটাই স্বাভাবিক। সবশেষে বলি, শেখ হাসিনা শেখ হাসিনাই। দেশের অন্যকারও সঙ্গে তাঁর তুলনা করা মূর্খতা। ধৃষ্টতাও বটে। আজ তাঁর- ৭০তম শুভ জন্মদিন। জন্মদিনের এই পুণ্যতিথিতে অন্তরের শ্রদ্ধা জানাই এবং প্রার্থনা করি তিনি যেন দীর্ঘায়ু লাভ করেন। লেখক : নাট্য ব্যক্তিত
×